(এক) যশোরের মনিরামপুর উপজেলার হানুয়ার গ্রামের হতদরিদ্র তপন সাধু ও বাসনা সাধুর বড় সন্তান, রাজগঞ্জ ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী শ্রাবন্তী মানবিক বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে। বাবার একমাত্র আয়ের উৎস রাজগঞ্জ বাজারের ফুটপাতে একটি চায়ের দোকান। জমি-জমা বলতে দেড় শতকের ভিটে বাড়ি। টানাটানির সংসারে টিউশনি করে নিজের লেখাপড়ার খরচ কিছুটা পুষিয়ে নিত শ্রাবন্তী। কখনো মা বাসনা সাধু অন্যের বাড়িতে কাজ করতেন। ফলাফল দেখে বড় লজ্জা পেয়েছেন শ্রাবন্তীর বাবা-মা। কারণ অভাব আর টানাটানির সংসারে শ্রাবন্তীকে পড়ালেখার খরচ, ভালো পোশাক, দু’বেলা দু’মুঠো খাবার সময়মতো দিতে পারেননি তারা। ফলাফলে খুশি হলেও উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছে শ্রাবন্তী (২২ জুলাই ২০১৮, সংবাদ)।
(দুই) অন্যের পুরাতন বই ধার করে, বিদ্যুতহীন বাড়িতে দিনে পড়ে কাকলী এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার মধ্যে একমাত্র জিপিএ-৫ পেয়েছে। পদ্মার ভাঙনে নিঃস্ব কাকলীর সাত সদস্যের দরিদ্র পরিবারের বসবাস উপজেলার পাচ্চর এলাকায় একচালার জরাজীর্ণ টিনের একটি খুপড়ি ঘরে। মা তাসলিমা বেগম গৃহিণী আর বাবা দিনমজুর হারুন মাদবর অন্যের জমিতে কাজ করে কোন রকমে সংসার চালান। খাতা ফুরিয়ে যাওয়ার শঙ্কায় সে পড়ত বেশি, লিখত কম। যাতায়াত ভাড়া থাকত না অনেক সময়। খরচ চালাতে প্রাইভেট পড়াত কাকলী। দিনমজুর হারুন মাদবর টাকা না থাকায় মিষ্টি কিনতে পারেননি বলে শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে মসজিদে মিলাদের যে একটি জিলাপি পেয়েছিলেন তা দিয়ে মিষ্টি মুখ করিয়েছেন আদরের মেয়েকে (২০ জুলাই ২০১৮, বার্তা বাজার.কম)। নদী ভাঙনে নিঃস্ব কাকলী ভর্তির জন্য প্রস্তুতিও নিতে পারেনি।
(তিন) কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নের মাজিহাট এলাকার গরিব বর্গাচাষি আজিজ হোসেন ও গৃহিণী নাসিমা খাতুনের ছেলে নাজমুল হক হালসা ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে। লেখাপড়ার খরচ চালাতে গিয়ে প্রাইভেট পড়ানোর পাশাপাশি মাঠে বাবার সঙ্গে দিনমজুরের কাজ করেছে সে। বাড়িতে অষ্টম শ্রেণী পড়ুয়া প্রতিবন্ধী এক বোন আছে। নিদারুণ অভাবের কারণে উচ্চশিক্ষা হবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে সে ও তার পরিবার (২০ জুলাই ২০১৮, বাংলানিউজ২৪.কম)।
(চার) রাজশাহীর বাঘা উপজেলার মর্শিদপুর গ্রামের ভ্যানচালক পিতা শাহাদত ও গৃহিণী মা নরজিমা বেগমের বড় মেয়ে শাকিলা মহিলা বাণিজ্যিক অ্যান্ড ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট থেকে বাণিজ্য বিভাগে (ট্রেড ব্যাংকিং) জিপিএ-৫ পেয়েছে। ভ্যানচালক পিতার উপার্জন আর মায়ের বাড়তি কাজ করা অর্থে কোন রকমে ৫ সদস্যের চলা সংসারে, একই ঘরের মধ্যে তিন বোন পড়ালেখা করেও শাকিলার এ অর্জন। বাঘা উপজেলার শাহদৌলা কলেজ থেকে এইচএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে আশরাফপুর গ্রামের শিখা, দেবত্তবিনোদপুর গ্রামের সোহাগ এবং মনিগ্রাম দক্ষিণপাড়ার তুহিন। আরজেদ আলী ও মনোয়ারা বেগমের হতদরিদ্র সাত সদস্যের পরিবারের ঠিকমতো খেতে না পাওয়া শিখা দরিদ্রের মধ্যে বাস করেও দীপ শিখা হয়ে জ্বলে উঠেছেন আপন আলোয়। দেবত্তবিনোদপুর গ্রামের ভিটা-বাড়িহীন দিন মজুর পিতা আকরাম আলী আর গৃহিণী মা চায়না বেগম গরু-ছাগল পালন করে অর্থ জোগান দিয়ে, বাবার সঙ্গে কাজ করে কিংবা টিউশনি করে পড়ালেখার খরচ জোগাড় করে সোহাগ কোন রকমে পড়ালেখাটা চালিয়ে অর্জন করেছে এ ফলাফল। আর কাজ করতে না পারা মানসিক রোগী পিতা আলম সরকার ও গৃহিণী মা লতিফা বেগমের বড় সন্তান তুহিন। তুহিনের মা ৫ সদস্যের সংসার পরিচালনা করেন ঘাঁস, মুরগি, গরু-ছাগল পালন করে। পড়ালেখার খরচ জোগাতে টিউশনি করত তুহিন (২১ জুলাই ২০১৮, এফএনএস২৪.কম)।
তাদের এমন দুঃখ-কষ্ট, হাহাকার, বেদনাময় আর্তচিৎকারে আমাদের মন কাঁদে না বলেই পত্রিকায় এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার ৮ দিন আগেই গত ১২ জুলাই ২০১৮, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি পরীক্ষার সাম্ভাব্য আলাদা তারিখ নির্ধারণ করে দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভিসিদের সংগঠন ‘বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদ’। অথচ ১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতি ও অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে ভিসিদের বৈঠকে ভর্তিকালীন দুর্ভোগ কমাতে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার ব্যাপারে নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত হওয়ায় গাইড লাইন তৈরি করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সাত সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে আহ্বায়ক করে নয় সদস্যের আরেকটি কমিটি গঠন করা হয়। দুই কমিটি সমন্বয় করে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার নীতিমালা সংক্রান্ত ধারণাপত্র ১৫ এপ্রিলের মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়ার কথা ছিল। বড় দুঃখের বিষয় হলো, ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই ৫ মাস অতিবাহিত হলেও এ ব্যাপারে দৃশ্যত এমন ত্বরিত বৈঠক কিংবা কোন প্রকার সিদ্ধান্ত নিতে দেখা যায়নি। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, ইউজিসি একাধিকবার বলা সত্ত্বেও বিষয়টি আলোর মুখ দেখল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের তথাকথিত বুদ্ধিজীবী শিক্ষক হিসেবে সমাজ, রাষ্ট্র এবং জনগণের প্রতি এ আমাদের দায়বদ্ধতা?
এভাবে ‘গোল্লাছুট’ ধরনের তারিখ নির্ধারণ না করে (১) অঞ্চল বা বিভাগ অনুযায়ী এবং ওই বিভাগের মধ্যে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দূরত্ব বিবেচনা করে তারিখ নির্ধারণ করলে শিক্ষার্থীরা এক ভ্রমণে এক এলাকার সব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পরপর পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারত। (২) ভর্তি ফরমের মূল্য যেন একই হয়, অনেক বেশি না হয়, সহনীয় হয় কিংবা (৩) কিভাবে ভর্তি পরীক্ষা শিক্ষার্থীবান্ধব করা যায়, (৪) পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারছে না কিংবা প্রবেশ পত্র পাচ্ছে না এমন শিক্ষার্থী যেন কোনভাবেই আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন না হয় এসব ব্যাপারে আলোচনা হতে পারতো। এটা করতে পারলে কিছুটা হলেও আমাদের আন্তরিকতা ও মানবিকতাবোধ প্রকাশ পেত। যারা পত্রিকায় বা টকশোতে কোচিং সেন্টারকে ধুয়ে দেন, তারাই এ ধরনের নিয়ম তৈরি করা ও টিকিয়ে রাখার মাধ্যমে পরোক্ষভাবে কোচিং বাণিজ্যকে উৎসাহিত করেন! অদ্ভুত!
ফলাফল প্রকাশের পর থেকেই ৮ লাখ ৫৮ হাজার ৮০১ শিক্ষার্থী এবং তাদের ১৭ লাখ ১৭ হাজার ৬০২ অভিভাবক মিলে মোট ২৫ লাখ ৭৬ হাজার ৪০৩ জন মানুষ নিদারুণ এক যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। একদিকে হাজার হাজার টাকা ও সারা বাংলাদেশ ছুটে বেড়ানোর চিন্তা অন্যদিকে অর্থ-বিত্তহীন পরিবার হলেও সন্তানের সামনে সম্মান রক্ষা করার মানসিক কষ্ট ও হাহাকার অভিভাবকদের অসহনীয় এক বেদনার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। কারণ এক বৈঠকে প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আলাদা ভর্তি পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণ করতে পারলেও রাষ্ট্রপতি ও চ্যান্সেলরের আমন্ত্রণে বঙ্গভবনে আলোচনার পরও হাজার হাজার দরিদ্র ও অসহায় মানুষের অবর্ণনীয় কষ্ট এবং লাখ লাখ শিক্ষার্থীদের হয়রানি বিবেচনা করে মাসের পর মাস (ফেব্রুয়ারি-জুলাই) ধরে দৃশ্যত কিছুই করতে পারিনি আমরা।
এটা প্রশংসনীয় যে কাকলীর দায়িত্ব নিয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ও র্যাবের ডিজি। বাকি হাজার হাজার অদম্য শ্রাবন্তী, কাকলী কিংবা নাজমুলদের কি হবে? কে বা কারা দাঁড়াবে তাদের পাশে? শত কষ্টের মধ্যেও পড়ালেখার প্রতি যে অদম্য ইচ্ছাশক্তি দমাতে পারেনি তাদের, সেই ইচ্ছাশক্তির কাছে অসহায় হয়ে, ভাগ্যের কাছে আত্মসমর্পণ করে নীরবে-নিভৃতে কাঁদছে তারা। নিম্ন মধ্যবিত্ত, ভূমিহীন কৃষক, মানুষের বাসা-বাড়িতে কাজ করা মা, দিনমজুর, রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহকারী, জেলে, কুমার, কামার, সমুদ্র উপকূলবর্তী, পাহাড়ি জনগোষ্ঠী ও আদিবাসী, শ্রমজীবী মানুষের সন্তানদের কী হবে? কোথায় পাবেন তারা এত ফরম কেনার টাকা? রাষ্ট্রপতির অভিপ্রায় মানে অলিখিত আইন, যা অখ-নীয় বলে প্রতীয়মান হওয়াটাই কাম্য ছিল। গোটা ব্রিটেন পরিচালিত হয় অলিখিত সংবিধান দ্বারা (যদিও শাসন ব্যবস্থা সংক্রান্ত কিছু বিধান লিখিত যেমন ম্যাগনা র্কাটা, বিল অফ রাইটস ইত্যাদি)। শিক্ষার্থী ও অভিভাবক মিলে লাখ লাখ মানুষের সঙ্গে আমরা ছিনিমিনি খেললাম। কোমলমতি শিক্ষার্থীগুলোকে আবার নাজেহাল হওয়ার বন্দোবস্ত করে দিলাম। ইতিহাস ক্ষমা করবে কি আমাদের? সবার পক্ষে ইতিহাস রচনা করা কিংবা ইতিহাসের সাক্ষী হওয়া সম্ভব হয় না বলেই বহুবার আলোচনা সত্ত্বেও দেখি দেখি করে আলোর মুখ দেখছে না সমন্বিত বা গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষা।
২০১৮ সালে ১০টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ১৩ লাখ ১১ হাজার ৪৫৭ পরীক্ষার্থী অংশ নেয়। কৃতকার্য হয়েছে ৮ লাখ ৫৮ হাজার ৮০১ জন। কৃতকার্য হতে পারেনি ৪ লাখ ৫২ হাজার ৬৫৬ জন। ফলাফল পুনর্মূল্যায়নের সুযোগ আছে। খুব বেশি মন খারাপ করার কিছু নেই শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের। কৃতকার্য শিক্ষার্থীদের চলার পথ হয়ত মসৃণ হলো, কিন্তু যারা কৃতকার্য হতে পারেনি তারা হিমালয়সম পথ পাড়ি দেয়ার মতো শক্তি অর্জন করল। সব বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে অকৃতকার্যরাই সবচেয়ে বেশি সফল হয়েছেন পৃথিবীর ইতিহাসে। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার আলোয় উদ্ভাসিত হবে সোনার বাংলা। কেটে যাবে সব অমানিশা। দুঃখ-কষ্ট, অকৃতকার্যতা আছে বলেই জীবন এত সুন্দর। তোমরা হলে অমাবশ্যার আঁধার রাতে পথিককে পথ দেখানো জোনাকি। ঘরের ফুটো চাল দিয়ে সূর্য, চাঁদ আর তারার আলো দেখা এমন সৌভাগ্য কার হয় বল! আর তাই, শত দুঃখ কষ্টের মাঝে সুখের নীল জল দিগন্ত ছোঁয়ার জন্য দু’চোখ মেলে অদম্য স্বপ্ন দেখতে হবে তোমাদের।
[লেখক : পিএইচডি গবেষক, জেঝিয়াং ইউনিভার্সিটি, চীন এবং শিক্ষক (শিক্ষাছুটি) সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, বশেমুরবিপ্রবি, গোপালগঞ্জ ]
সৌজন্যে: দৈনিক সংবাদ