অধঃপতিত সমাজের আরেক শিকার আবরার - দৈনিকশিক্ষা

অধঃপতিত সমাজের আরেক শিকার আবরার

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

চেতনার গভীরে এক বিরাট ক্ষতের জন্ম দিয়েছে আবরারের মৃত্যু। আবরার কী এমন অপরাধ করেছিল, যা একেবারে ক্ষমার অযোগ্য ছিল? আবরারের মতো একজন মেধাবী ছাত্রকে তার নিজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পিটিয়ে মেরে ফেলতে হল? দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বুয়েট, যেখানে শুধু এ দেশের মেধাবী সন্তানরাই ভর্তি হওয়ার বা পড়ালেখা করার সুযোগ পায়।

সুদীর্ঘকাল ধরে এ বিদ্যাপীঠটি একটি অন্যরকম সুনাম বজায় রেখে চলেছে। আমার জানামতে, যারা এ প্রতিষ্ঠানটিতে পড়াশোনা করে তাদেরকে এ দেশের শিক্ষিত সমাজ অনেক সমীহ করে, সম্মান করে, ভালোবাসে এ জন্য যে এরাই জাতির ভবিষ্যৎ। দেশ গড়ার কারিগর। কিন্তু আজ আমরা কি দেখছি? আবরারের মতো একটি নিরীহ, স্বল্পভাষী, মেধাবী ছাত্রকে তারই কিছু সহপাঠী পিটিয়ে মেরে ফেলল? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আবরারকে মারার ভিডিও চিত্র দেখে সহ্য করতে পারিনি। চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। এত অল্প বয়সী ছেলেরা তাদেরই একজন সহপাঠীকে বিনা অপরাধে এমন নির্মম, নিষ্ঠুরভাবে পিটিয়ে একেবারে মেরে ফেলতে পারে! এও কি সম্ভব! এ সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠকে এমন কলঙ্কিত করতে পারে? শনিবার (১২ অক্টোবর) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

আমি একজন মা। আমার সন্তানকে তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠিয়ে নিশ্চিন্তে থাকতে পারব না? সন্তানের অমঙ্গল কিংবা মৃত্যু চিন্তায় প্রতিটি মুহূর্ত আমাকে পার করতে হবে? দেশে যতগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে তার মধ্যে বুয়েটকেই সবাই স্বতন্ত্র, রাজনীতিমুক্ত কিংবা দলাদলির ঊর্ধ্বে চিন্তা করত। যে প্রতিষ্ঠানটির ছাত্রছাত্রীরা শুধু লেখাপড়া নিয়েই ব্যস্ত থাকে। কিন্তু আজ আমাদের সব চিন্তাচেতনাকে ধূলিসাৎ করে এ বিদ্যাপীঠটির গায়ে কলঙ্কের কালিমা লেপন করল কিছু ছাত্র নামধারী, উগ্র, বর্বর পশু।

এসব বর্বর পশুর অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের অমানবিক, মূল্যবোধহীন, বর্বর পশু হিসেবে গড়ে তুলেছে! তথাকথিত জিপিএ-৫, কিংবা গোল্ডেন-৫ পাওয়ার জন্য, নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি করার জন্য শুধু কোচিং সেন্টারে পাঠিয়ে কিংবা বলা যায় ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র উচ্চমূল্যে ক্রয় করে এসব মানবিক মূল্যবোধহীন সন্তান গড়ে তুলেছে! সন্তান শুধু মেধাবী হলেই হবে না, সে একজন মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে উঠছে কি না, সেদিকে অভিভাবকদের প্রখর দৃষ্টি রাখতে হবে। এর পাশাপাশি যে বিদ্যাপীঠটায় পড়াশোনা করছে, সেখানকার শিক্ষকরাও তাদের মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন।

পরিবার, সমাজ বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্তানদের নীতি-নৈতিকতা যথাযথভাবে শেখানো হচ্ছে না। সর্বত্রই চলছে প্রতিযোগিতা। অভিভাবকরা বিরাট এক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছেন। একটা ভালো রেজাল্টের জন্য তারা সন্তানদের যন্ত্রমানব বানাতে দিন-রাত মাথার ঘাম পায়ে ফেলছেন। শুধুই ভালো রেজাল্ট চাই। সন্তানদের মধ্যে নীতি, নৈতিকতা, মানবতা, মূল্যবোধ, শিষ্টাচার, সহমর্মিতা, সহনশীলতা ইত্যাদি জাগ্রত হচ্ছে কি না, আদর্শ সন্তান হিসেবে গড়ে উঠছে কি না, এসব দেখার সময় নেই।

শিশুরা প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করে প্রথমে তাদের পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পরিবেশ এবং সর্বোপরি সমাজ থেকে। কিন্তু আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত যা ঘটছে তা থেকে শিশুরা কী শিক্ষা গ্রহণ করবে? এ অসুস্থ ও অনৈতিক প্রতিযোগিতা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে এ জাতি একসময় অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে।

আমাদের উন্নয়ন হচ্ছে, আমাদের মাথাপিছু আয় বাড়ছে, জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। আরও উত্তরোত্তর বাড়বে; কিন্তু আমরা একসময় মেধাশূন্য জাতিতে পরিণত হব। সে সময় মনে হয় খুব বেশি দূরে নয়। কোমলমতি শিক্ষার্থীরা যাতে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে এবং যে কোনো অন্যায় এবং নীতি বিবর্জিত কাজ থেকে দূরে থাকতে পারে সে জন্য শিক্ষক ও অভিভাবকদের সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে। এ বিষয়ে গণমাধ্যমগুলোতে প্রচার ও প্রচারণার মাধ্যমে সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি করতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রের নৈরাজ্য অবিলম্বে দূর করে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে।

অনেক ত্যাগ, অনেক রক্তের বিনিময়ে এ দেশটা স্বাধীন হয়েছে। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় আমরা আজ বিশ্বদরবারে পরিচিতি লাভ করছি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী যোগ্য নেত্রী হিসেবে বিশ্বে পরিচিতিই শুধু পায়নি, সম্মানজনক পুরস্কারও পাচ্ছেন। আমরা খুব গর্বভরে বলি বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। গণতন্ত্র মানে কী? গণতন্ত্র মানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। প্রতিটি মানুষেরই ব্যক্তি স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে গণতন্ত্রে।

একজনের মতের সঙ্গে আর একজনের মতের মিল নাও হতে পারে। মতের মিল না হওয়ার মানে এই নয় যে, আমি তাকে পিটিয়ে হত্যা করব। আমরা এ কোন অসভ্য বর্বর সমাজে বাস করছি? ক্ষমতা, অর্থ আর প্রতিপত্তি মানুষকে অন্ধ করে দেয়। আবরারকে যারা পিটিয়ে হত্যা করেছে, অর্থ অস্ত্র আর মাদক দ্বারা এরা পরিচালিত কি না, খুঁজে বের করা দরকার। এরা ভেবেছে এদের পেছনে রয়েছে অনেক বড় শক্তি। এরা যা খুশি তাই করতে পারবে। কেউ এদের টিকিটিও ছিঁড়তে পারবে না।

সম্রাট, জি কে শামিম, খালেদ মাহমুদ হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক, মাফিয়া জগতের সম্রাট হয়ে, ক্ষমতার প্রশ্রয়ে থেকেও শেষরক্ষা হয়নি। ‘পাপ বাপকেও ছাড়ে না’- এ চরম সত্যি কথাটি কেউ মনে রাখে না। মানুষ অপরাধ করতে করতে এমন এক পর্যায়ে আসে যখন প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম থেকে তারা বাঁচতে পারে না। সীমা লঙ্ঘনকারীকে আল্লাহতায়ালাও পছন্দ করেন না।

এদের পাপের মাত্রা এতটাই বেড়ে গেছে যে, ক্ষমতা-অর্থ-সম্পদ তাদেরকে রক্ষা করতে পারছে না। এদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতারাও সমাজে ধিকৃত। তারপরও আমরা শিক্ষা নিচ্ছি না। একটা মানুষের জীবনে কত চাই? চাওয়ার কি কোনো শেষ নেই? আমরা তো পৃথিবীতে অমর হয়ে আসিনি।

আমাদের জীবনের সময়টা খুব স্বল্প। এই স্বল্প সময়ে মানসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকুতে আমরা সন্তুষ্ট নই। আমাদের চাহিদা সীমাহীন করলে হবে না। কারণ সীমাহীন চাহিদা মেটাতে গিয়েই আমাদের বাঁকা পথে হাঁটতে হয়। যার ভয়াবহ পরিণতির কথা কখনও চিন্তাও করি না। কিন্তু প্রকৃতির বিচার অত্যন্ত কঠিন। অন্যায় করলে শাস্তি তাকে পেতেই হবে। শুধু সময়ের অপেক্ষা। আজ এসব কোমলমতি, মেধাবী সন্তানদের যারা বিপথে পরিচালিত করছে, তাদের বিচার একদিন হবেই। আবরারের মা, বাবা, তার স্বজনদের কষ্ট, আহাজারি এসব নরপশুকে কুরে কুরে খাবে।

রাজনীতি করা অপরাধ নয়। কিন্তু যে রাজনীতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কলুষিত করে, দেশ, সমাজ, সংসারকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায় সে অপরাজনীতি থেকে আমরা মুক্তি চাই। আমরা বাঁচতে চাই। প্রাণপ্রিয় সন্তানদের মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলার জন্য জীবনের শেষ সম্বলটুকু দিয়েও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠিয়ে নিশ্চিন্তে থাকতে চাই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্ষমতা অর্থ আর অস্ত্রের ঝনঝনানি দেখতে চাই না। মাদকের ছোবল থেকে সন্তান, সমাজ সর্বোপরি দেশকে নিরাপদ দেখতে চাই। বিশ্বজিৎ, রাউফুন বসুনিয়া, দীপন, আবরারের মতো সন্তানদের আমরা হারাতে চাই না। আমরা আমাদের প্রাণপ্রিয় সন্তানদের সত্যিকার মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই।

আমাদের মানবিক মূল্যবোধের ব্যাপক অবক্ষয় হয়েছে এবং হচ্ছে প্রতিনিয়ত। দয়া, মায়া, আদর, ভালোবাসার মতো সুকুমার অনুভূতিগুলো আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে বলেই প্রকাশ্য দিবালোকে তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে খুনখারাবি হচ্ছে। অবোধ মাসুম শিশুদের ধর্ষণ, অপহরণ করা হচ্ছে। মা সন্তানকে হত্যা করছে, সন্তান মাকে হত্যা করছে। দেশে আইন আছে, বিচার ব্যবস্থা আছে; কিন্তু এসবের তোয়াক্কা না করে মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার মানসিকতা অগণতান্ত্রিক ও মানবিক মূল্যবোধের বিরোধী। আবরারের হত্যাকারীদের দ্রুত বিচারের আওতায় এনে এদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা হোক যাতে আর কোনো আবরার অপমৃত্যুর শিকার না হয়। কোনো মাকে যেন সন্তানহারা হতে না হয়।

মনজু আরা বেগম : লেখক ও গবেষক; সাবেক মহাব্যবস্থাপক, বিসিক

জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ - dainik shiksha পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা - dainik shiksha হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে - dainik shiksha সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন - dainik shiksha জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো - dainik shiksha ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা - dainik shiksha তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0080828666687012