কালের পরিক্রমায় বিধিবিধান হয় আরও উন্নত, আরও বেশি প্রতিযোগিতামূলক ও জনবান্ধব। যা যোগ্য নাগরিক তৈরিতে কার্যকর ভূমিকা রাখে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা ২০১৮ এর অধিকাংশ নীতিমালা শিক্ষাবান্ধব হলেও কলেজ পর্যায়ের অধ্যক্ষ উপাধ্যক্ষ নিয়োগের বিধিমালায় ঘটেছে তার উল্টোটি।
আলিম মাদরাসার অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ পদে সহকারী (শিক্ষক) মৌলভী থেকে আসা সুপার, সহ-সুপারদের অধ্যক্ষ উপাধ্যক্ষ হওয়ার নতুন সুযোগ সৃষ্টি করা হলেও প্রভাষকের ক্ষেত্রে সহকারী অধ্যাপকের শর্ত জুড়ে দেয়ায় এই স্তরে শিক্ষাদানকারী প্রভাষকরা দরখাস্ত করার অযোগ্য হয়েছেন। আসুন এমপিও নীতিমালা-২০১৮ এর অধ্যক্ষ উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগ সংশ্লিষ্ট কয়েকটি দিক পর্যালোচনা করে দেখি।
১. আলিম মাদরাসার অধ্যক্ষের যোগ্যতা চাওয়া হয়েছে – উপাধ্যক্ষ/সহকারী অধ্যাপক পদে ৩ বছরের অভিজ্ঞতাসহ প্রভাষক হিসেবে (আরবি বিষয়সমূহে) মোট ১২ বছর শিক্ষকতা অভিজ্ঞতা। অথবা- দাখিল মাদরাসার সুপার হিসেবে ৫ বছরের অভিজ্ঞতাসহ (আরবি বিষয়সমূহে) ১৫ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা।
*উপরোক্ত ধারায় প্রভাষকদের ক্ষেত্রে ‘সহকারী অধ্যাপক’ শর্ত জুড়ে দেয়ার কারণে উক্ত স্তরে শিক্ষাদানে যাদের জীবন অতিবাহিত হচ্ছে সেই প্রভাষকদের আবেদনে অযোগ্য করা হলো।
[কারণ বিদ্যমান আইনে সহকারী অধ্যাপক পদ আদিমযুগের অনুপাত প্রথায় সীমাবদ্ধ থাকার কারণে এটি জন্মগত পদ হয়ে গেছে। যতই যোগ্য, মেধাবী হোক কোনোভাবেই অন্য প্রভাষকরা এই জনমে সহকারী অধ্যাপক হওয়ার সুযোগ পাবেন না। অথচ ২০১০ এর নীতিমালায় এই শর্তটি ছিল না। ওই নীতিমালায় ছিল প্রভাষক/সহকারী অধ্যাপক। ফলে সকলের আবেদনের সমান সুযোগ ছিল।]
*অথবা- অংশে বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নীতিমালার ইতিহাসে নজিরবিহীন বিধি যোগ করা হয়েছে। যাতে দাখিল মাদরাসার সুপারদের সুযোগ দেয়া হয়েছে অধ্যক্ষ/উপাধ্যক্ষ হওয়ার। বিগত জীবনে যিনি একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির পাঠদানে কখনো জড়িত ছিলেন না এবং স্কুল লেভেলের দাখিল মাদরাসায় সহকারী মৌলভী থেকে সুপার হয়েছেন। তিনি অধ্যক্ষ উপাধ্যক্ষ হওয়ার সুযোগ পেলেন অথচ প্রভাষকরা বঞ্চিত হলেন।
২. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষা কার্যক্রম গতিশীল করতে শিক্ষার মানোন্নয়নে ২০১৮ এর নীতিমালায় চমৎকার সংযোজন হল আলিম মাদরাসার উপাধ্যক্ষ পদ সৃষ্টি করা। কিন্তু এ পদের কাম্য যোগ্যতা ও পূর্বের ১নং অধ্যক্ষ বিধিটির মতো। প্রভাষকদের শর্তের বেড়াজালে বন্দি রেখে স্কুল লেভেলের দাখিল মাদরাসার সহ-সুপার ও সুপারদের সুযোগ দেয়া হয়েছে।
৩. অনুরূপভাবে উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক কলেজ এবং ফাজিল, কামিল মাদরাসার অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ পদে প্রভাষকদের ক্ষেত্রে সহকারী অধ্যাপক শর্ত জুড়ে দেয়ার কারণে প্রভাষকরা আবেদনের যোগ্যতা হারিয়েছেন। তবে কলেজগুলোতে মাদরাসার মতো নজীরবিহীন বিধি যোগ করা হয়নি। স্কুল অ্যান্ড কলেজগুলোতেও অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ পদে সহকারী শিক্ষক থেকে আসা প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষকদের সুযোগ রাখা হয়নি কিন্তু মাদরাসায় করা হলো তার ব্যতিক্রম।
৪. কলেজের নীতিমালায় আরও ব্যতিক্রম রয়েছে। স্নাতক (পাস) মহাবিদ্যালয়ের উপাধ্যক্ষ পদে কাম্য যোগ্যতা চাওয়া হয়েছে- প্রভাষক/সহকারী অধ্যাপক। সবাইকে সুযোগ দেয়া হয়েছে। তাই এটির মতো কলেজ ও মাদরাসার অধ্যক্ষ উপাধ্যক্ষ পদে পূর্বের মতো অভিজ্ঞতা সম্পন্ন প্রভাষকদের আবেদন করার সুযোগ দেয়া হোক।
অথবা সহকারী অধ্যাপকের পদে অনুপাত প্রথা বাদ দিয়ে যোগ্যতার ভিত্তিতে সকলের যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে তারপর সহকারী অধ্যাপক এর শর্ত জুড়ে দেয়া হোক।
৫. এই অর্থবছরে আলিম মাদরাসাগুলোতে উপাধ্যক্ষ নিয়োগ শুরু হয়েছে। যাতে দাখিল মাদরাসার সহ-সুপার ও সুপাররা আবেদন করতে পারছেন। কিন্তু প্রভাষকরা এই স্তরের অভিজ্ঞ শিক্ষক হওয়ার পরও বঞ্চিত হচ্ছেন।
এতে দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরির প্রতিযোগিতা থাকছে না। অধিক যোগ্য, অধিক অভিজ্ঞ ও অধিক শিক্ষিত হওয়ার পরও প্রভাষকদের অযোগ্য করে রাখা জাতির জন্য শিক্ষাক্ষেত্রে অশনি সংকেত।
মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ পদে যদি প্যারামেডিক ডাক্তারকে অধ্যক্ষ বানানো হয় তার এমবিবিএস কোর্সের ছাত্র কতটুকু যোগ্যতা নিয়ে গড়ে উঠবে চিন্তার বিষয়!
সর্বশেষ যোগ্যদের বঞ্চিত রাখার কুফল সম্পর্কিত একটি বাস্তব গল্প দিয়ে আজকের লেখা শেষ করব।
যখন কাম্য অভিজ্ঞতা ছাড়াই কোনো কোনো মাদরাসায় অধ্যক্ষ নিয়োগ দেয়া হতো, বিধিমালা প্রতিপালনে কড়াকড়ি না থাকায় এমপিওভুক্তও হয়ে যেতেন। সে সময়ে কোনো একজন শিক্ষক মাদরাসার ইবতেদায়ি (প্রাথমিক) স্তরের শিক্ষক থেকে অধ্যক্ষ হলেন। তার অধীনস্থ উনার দৃষ্টিতে একজন ফাঁকিবাজ শিক্ষককে ধরার জন্য তিনি একদিন ওই শিক্ষকের ক্লাসে গিয়ে ছাত্রদের বললেন সবাই বই বন্ধ করো এবং আজকের পড়াটা লিখ। অধ্যক্ষ খাতাগুলো সংগ্রহ করে সেই শিক্ষকের হাতে দিলেন মূল্যায়ন করার জন্য। সেই শিক্ষক খাতাগুলো হাতে নিয়ে প্রতিটি খাতায় টিক মার্ক দিয়ে অধ্যক্ষকে দিলেন। অধ্যক্ষ মহোদয় সব খাতায় টিক মার্ক দেখে খুশিতে বাগবাগ হয়ে বললেন, ‘আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ আপনি নাকি পড়ান না। পড়াতে পারেন না। এখন দেখছি সবাই তো পড়া পারল।’ শিক্ষককে বেশ! বেশ! বলে ধন্যবাদ দিয়ে ক্লাস থেকে বাহিরে যাওয়া মাত্র ওই শিক্ষক অধ্যক্ষকে ডেকে আনলেন এবং তার সামনেই টিক মার্ক করা খাতাগুলোকে আবার ক্রস মার্ক দিলেন। অধ্যক্ষের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। বিস্ময়ে বললেন, ‘এ কি করছেন!’ শিক্ষক বললেন, ‘আমি সব খাতায় টিক দিয়েছি আপনি কি কিছু বুঝেছেন? আবার এগুলোকে ক্রস দিয়েছি এবার কি কিছু বুঝেছেন? না বুঝলে আমাদের উপর পোদ্দারি করতে আসেন কেন?’ এই ঘটনাটি আমাদের কি শিক্ষা দেয়?
আমরা বলছি না সবাই এমন হয়। আবার এও বলছি না কাউকে প্রতিযোগিতা থেকে বাদ দেয়া হোক, বরং বলছি আমার সন্তানদের যোগ্য করে গড়ে তুলতে যোগ্য শিক্ষকদের প্রতিযোগিতা করার সুযোগ দেয়া হোক। তাহলে যোগ্য ছাত্র গড়ে উঠবে। যেমন শিক্ষক তেমন ছাত্র হবে। ‘বাপকা বেটা সিপাহী কা ঘোড়া - কুচ নেহি থোরা থোরা’।
মানুষ গড়ার কারিগরেরা মানুষের গড়া জালে আটকে গেলে, মানসম্মত শিক্ষা আটকে যাবে। সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে বাস্তবতার মুখ দেখবে না।
তাই আমাদের শিক্ষা নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের কাছে মিনতি করব- নতুন নীতিমালায় শিক্ষার মান উন্নয়নে যুগান্তকারী অনেক বিধি সংযোজন হলেও শুধুমাত্র আলোচিত বিষয়টি সকল প্রভাষকদের ব্যথিত করেছে তাই এই জটিলতা দূরীকরণে অতীতের মতো আজও আপনাদের আন্তরিক ভূমিকা চাই। প্রভাষকেদের জন্য বৈষম্যমূলক সকল বিধির সংশোধন চাই।
লেখক : মো. মোস্তফা কামাল, প্রভাষক (আরবী), খাড়াতাইয়া ইসলামিয়া ফাযিল মাদরাসা, বুড়িচং, কুমিল্লা।
[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন।]