‘গ্রেটমেন থিংক এলাইক’- মহাজনদের ভাবনা নাকি একইরকম হয়, হয়ে থাকে। স্কুলজীবনে আমার প্রিয় শিক্ষকদের মধ্যে একজন ছিলেন মো. আবদুল ওয়াহাব। কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ হাইস্কুল ও নেয়ামতপুর হাইস্কুল এবং সবশেষ আমার কর্মস্থল বাজিতপুর উপজেলার রাজ্জাকুন্নেসা পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে (বর্তমানে সরকারি স্কুল অ্যান্ড কলেজ) টানা ১৬ বছর শিক্ষকতা করে এখান থেকেই অন্তত ১২ বছর আগে অবসরগ্রহণ করেন তিনি। শুক্রবার (২০ জুলাই) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। বিবন্ধটি লিখেছেন বিমল সরকার।
দু’বছর হল তিনি গত হয়েছেন (পরম করুণাময় আমাদের স্যারকে শান্তিতে রাখুন)। খুবই নীতিবান ও একজন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে নিজের এলাকা এবং বিভিন্ন কর্মস্থলে স্যারের বেশ সুনাম রয়েছে। পৃথক দুটি ইউনিয়নভুক্ত হলেও স্যারের এবং আমাদের গ্রামের বাড়ি কাছাকাছি, হেঁটে মাত্র ১০ মিনিটের পথ। খুবই গম্ভীর ও রাশভারী লোক। বয়সের বেশ ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও আমার বাবার সঙ্গে স্যারের ছিল দীর্ঘদিনের এক নিবিড় সম্পর্ক। আমাদের বাড়িতে গল্প-গুজব করে এবং হুঁকো-বিড়ি টেনে দু’জনকে রাতের পর রাত কাটিয়ে দিতে দেখেছি।
ছাত্রজীবনে যেমন-তেমন, মূলত শিক্ষকতা পেশায় ঢুকেই আমি স্যারের বেশি সান্নিধ্য লাভ করি। আশি ও নব্বইয়ের দশকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিরাজমান পরিবেশ-পরিস্থিতি নিয়ে স্যারের সঙ্গে আমার অনেক আলাপ-আলোচনা হতো। একদিন আমাদের আলোচনায় আসে কলেজের প্রিন্সিপাল ও স্কুলের হেডমাস্টার নিয়োগ এবং তাদের কর্মকাণ্ডের প্রসঙ্গ।
একপর্যায়ে স্যার বললেন, ‘যেসব শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে ভালো পড়ান, আদর্শ ও নীতিবান- তাদের কখনও প্রিন্সিপাল বা হেডমাস্টার নিযুক্ত করা সঠিক বলে আমি মনে করি না। যারা সঠিকভাবে পড়াতে পারেন না, শ্রেণীকক্ষে পড়াতে গিয়ে আকুপাকু করেন, দেরি করে শ্রেণী কক্ষে প্রবেশ করেন এবং সময় হওয়ার আগেই বের হয়ে যান, নিয়মনীতি ও আদর্শের খুব একটা ধার ধারেন না, সিলেবাসেরই কোনো খবর রাখেন না, একাম-ওকাম-সেকাম-আকাম ও এটা-ওটা-সেটা নিয়ে সব সময় ব্যস্ত থাকেন, ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করেন, তাদের মধ্য থেকেই প্রতিষ্ঠানপ্রধান নিযুক্ত করা উচিত।’
আমার স্যারের ভাষায়- ‘এমন বৈশিষ্ট্যের ব্যক্তিরা শ্রেণিকক্ষে পড়ানো বা আর কিছুতে যেমন-তেমন, অন্য সবকিছু এবং সবাইকে কীভাবে ঠিক রাখা যায়, ম্যানেজ করে চলতে হয়- সে কাজটি বেশ ভালোই বোঝেন। এমন ব্যক্তিই সহজে সবকিছু ঠিক রাখতে এবং সবাইকে দাবিয়ে রাখতে পারেন।’
আমার ওয়াহাব স্যার এখন আর বেঁচে নেই। কেন ও ঠিক কোন পরিস্থিতিতে স্যার প্রধান শিক্ষক ও কলেজের অধ্যক্ষদের ব্যাপারে এহেন মন্তব্য করেছিলেন, বয়স বা অভিজ্ঞতার স্বল্পতার কারণে তখন বোধকরি সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারিনি। কিন্তু স্যারের এ কথাগুলো কেন জানি আমার কানে এখনও মাঝেমধ্যে বাজে।
২.
কলেজজীবনে আমার আরেকজন প্রিয় শিক্ষক ছিলেন এইচএম মনিরুজ্জামান। ময়মনসিংহের ঐতিহ্যবাহী আনন্দমোহন কলেজে তিনি টানা ২৬ বছর ইতিহাস বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন। পরবর্তী সময়ে উপাধ্যক্ষ এবং বিভিন্ন কলেজে অধ্যক্ষ; অতঃপর অবসরজীবন। একসময় জাতীয় পাঠক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড এনসিটিবির সচিব এবং শিক্ষা অধিদফতরের পরিচালকও ছিলেন তিনি।
শিক্ষাক্ষেত্রে বিশাল অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পেয়েছেন। স্যার সম্পর্কে আরেকটি কথা- স্যারের প্রয়াত বাবা ও মা উভয়েই পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে দীর্ঘদিন নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জের দুটি পৃথক হাইস্কুলে যথাক্রমে হেডমাস্টার ও হেডমিস্ট্রেস হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৬৯ সালে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানে প্রাণদানকারী শহীদ আসাদের (এইচএম আসাদুজ্জামান) অনুজ আমাদের এই মনিরুজ্জামান স্যার। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে স্যারের দেয়া একটি পোস্টকে কেন্দ্র করেই মূলত আমার আজকের এ লেখা।
সরকারি কলেজের একজন প্রভাষক। শ্রেণিকক্ষে একদম পড়াতে পারেন না। বিভাগীয় প্রধানসহ অন্যান্য শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অধ্যক্ষের (প্রশাসন) জন্য যে কী ক্ষতি ও দুঃসহ বিড়ম্বনার কারণ হয়ে ওঠেন তিনি এবং সময় সময় ওই প্রভাষকের বিশেষ অনুরোধে তার প্রতি দয়াপরবশ হয়ে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন- আকারে-ইঙ্গিতে তারই খানিকটা বর্ণনা দিয়েছেন আমার স্যার তার দেয়া পোস্টটিতে।
স্বাভাবিক পদোন্নতি পেয়ে প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক, পরে সহযোগী ও পূর্ণ অধ্যাপক হওয়া ছাড়াও তিনি যে কলেজে একদম পড়াতে পারেন না বলে বিড়ম্বনাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, সেই স্বনামখ্যাত কলেজটিতেও ওই ব্যক্তিটি কিছুকাল ‘অধ্যক্ষ’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন- স্যারের পোস্টটিতে উল্লেখ রয়েছে। কর্মদক্ষতার অভাব, নানা অনিয়ম, ত্রুটি-বিচ্যুতি ও অনেক সীমাবদ্ধতার কারণে তিনি বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছেন ঠিকই, তবে প্রতিবারই কাটিয়ে উঠেছেন।
স্যারের দেয়া পোস্টটিতে একজনের মন্তব্যের জবাবে মনিরুজ্জামান স্যার লিখেছেন, ‘অযোগ্য শিক্ষককে অধ্যক্ষ বানিয়ে দাও। অধ্যক্ষগিরিতে ফেল মারলে তাকে উপাচার্য বানিয়ে দাও।’ ফোনে স্যারের সঙ্গে মাঝে মাঝে আলাপ হলেও তার মতো একজন শিক্ষাবিদ কেন এবং কোন পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষক, অধ্যক্ষ ও উপাচার্য নিয়ে খেদমিশ্রিত এমনসব কথা বলেছেন, তা আর আমি জানতে চাইনি।
৩.
আমার এক বন্ধু মো. রফিকুল ইসলাম। ছাত্র ইউনিয়ন তথা বাম রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সেই কৈশোরকাল থেকে। মফস্বল শহরে বাস করলেও তিন বছর ধরে তিনি বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সম্মানিত সদস্য হিসেবে রয়েছেন।
বই-পুস্তকের একজন সফল ব্যবসায়ীও তিনি। শিক্ষা, শিক্ষকতা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রশাসন, এসব বিষয়ে মোটামুটি খোঁজখবর রাখেন স্থানীয়ভাবে অত্যন্ত সুপরিচিত এই ব্যক্তি। ২০০৩ সালে তার জীবনে নতুন এক অভিজ্ঞতা সংযোজিত হয়। সেবার বেশ বৈরী পরিবেশের মধ্যে অংশ নিয়ে তিনি স্থানীয় একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটিতে অভিভাবক প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। রফিক সাহেব ও আমার মধ্যে প্রায় প্রতিদিনই দেখা-সাক্ষাৎ হয়, এমনকি কখনও কখনও দিনে একাধিকবার।
অনেক আলাপ হয় আমাদের মধ্যে। একদিন ভোরবেলায় হাঁটার সময় অন্যান্য প্রসঙ্গের মধ্যে তিনি বলতে থাকেন, ‘অতীতের কথা আমি বলছি না, তবে আজকাল স্কুল-কলেজের প্রধান শিক্ষক ও অধ্যক্ষরা আর্থিকভাবে অনেক সচ্ছল, অনেক ভালো আছেন।’ আমি এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা জানতে চাওয়ার আগেই তিনি সময় সময় পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত নানা সব খবরের কথা একের পর এক বলে যেতে থাকেন।
নানা খাত, নানা অজুহাত, নানা ফি, নানা কায়দা-পদ্ধতি। অনিয়মকে নিয়ম আবার নিয়মকে অনিয়ম বানিয়ে ফায়দা হাসিলে পারদর্শিতা। সবচেয়ে বড় কথা, নিজের স্বার্থে কারও না কারও সঙ্গে অথবা কোনো না কোনো পক্ষের সঙ্গে সমঝোতা করে চলার কৌশলটি তারা জেনে গেছেন বা বুঝে ফেলেছেন।
দেশজুড়ে স্কুল ও কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংঘটিত নানা অনিয়ম-অব্যবস্থা, সমস্যা-বিশৃঙ্খলা ও দুর্নীতির বিষয়াদি আজকাল হরহামেশা পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনে শিরোনাম হচ্ছে। বিচ্ছিন্নভাবে নয়, জায়গায় জায়গায় গুরুতর আর্থিক অনিয়মসহ প্রায়ই প্রধান শিক্ষক ও অধ্যক্ষরা নেতিবাচক শিরোনাম হচ্ছেন। পদ-পদবি বাগিয়ে নেয়ার দৌড়ে অযোগ্যরাও খুব একটা পিছিয়ে নেই।
অধ্যক্ষ বা প্রধান শিক্ষক হওয়ার নেশা বা নগ্ন প্রতিযোগিতার বিষয়টি এখন খুবই আলোচিত। আত্মস্বার্থে অনেকেই একেবারে অন্ধ হয়ে পড়েছেন। বন্ধুবর রফিক সাহেবের সব কথার সঙ্গে অবশ্য আমি একমত হতে পারিনি। আমার ওয়াহাব স্যার, মনিরুজ্জামান স্যার ও বন্ধু রফিক সাহেব ওইরকম মহান কেউ নন। তবু তাদের কথাগুলো আমার মনে প্রায়ই আনাগোনা করে।
লেখক : কলেজ শিক্ষক