আনিসুজ্জামান অসুস্থ ছিলেন। চিকিৎসাধীন ছিলেন। তিনি যে সত্যি সত্যি চলে যাবেন, তা আমরা ভাবতে পারিনি। আমরা একটা দুঃসময়ের মধ্যে আছি। এ দুঃসময়টা খুবই যন্ত্রণাদায়ক। এ যন্ত্রণার মধ্যে তাঁর মৃত্যুর সংবাদ অত্যন্ত মর্মান্তিক ঘটনা। শুক্রবার (১৫ মে) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, আনিসুজ্জামান আমাদের সমসাময়িক ছিলেন। আমাদের বন্ধু ছিলেন। আমরা একসঙ্গেই লেখাপড়া করেছি বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে। শিক্ষকতা করেছি। নানা কাজকর্মে যুক্ত ছিলাম একসঙ্গে।
আমি তাঁকে সব সময়ই ব্যতিক্রম মনে করতাম। তাঁর অনেক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ছিল। অসাধারণ ছিলেন। আমাদের সময়ের সাহিত্য-সংস্কৃতি-শিক্ষার ক্ষেত্রে যাঁরা তৎপর ছিলেন, তাঁদের মধ্যে তিনি অত্যন্ত বিশিষ্ট, শুধু বিশিষ্ট নয়, উজ্জ্বল ছিলেন।
তিনি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অনেক পুরস্কার-স্বীকৃতি পেয়েছেন। যে স্বীকৃতি তাঁর প্রাপ্য ছিল। তাঁর গবেষণা, শিক্ষকতা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা সবারই জানা। গবেষণা ও শিক্ষকতার ক্ষেত্রে তাঁর নিজস্ব অর্জন তো ছিলই। কিন্তু লক্ষ করার বিষয়, তিনি শুধু এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না। অনেকেই গবেষণা করেন, শিক্ষকতা করেন, তাঁরা নিজেদের মধ্যে একটা সীমা তৈরি করে নেন। তার মধ্যেই বিচরণ করেন। কিন্তু আনিসুজ্জামান সমাজের প্রতি দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন ছিলেন। রাজনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সচেতনই ছিলেন তা না, অনেক ক্ষেত্রে নেতৃত্বও দিয়েছেন।
আনিসুজ্জামান অনেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সব প্রতিষ্ঠানকেই তিনি ঋণী করে গেলেন। তাঁর মধ্যে একটা উদার নৈতিকতা ছিল। উদার কিছু গুণ ছিল, যা সচরাচর দেখা যায় না। যেমন পরমতসহিষ্ণুতা, প্রসন্নতা, সামাজিক অগ্রগতিতে বিশ্বাস—এগুলো তাঁর মধ্যে ছিল। অঙ্গীকারের ব্যাপারে বেশ দৃঢ় ছিলেন।
তাঁর যে গবেষণা, সেগুলো অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। তাঁর আত্মজীবনীটিও উল্লেখযোগ্য। এ জন্য সেখানে যে শুধু তাঁর ব্যক্তিগত জীবন রয়েছে, তা না। আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অনেক উপাদানও রয়েছে।
তাঁর লেখায় বৈদগ্ধ্য আছে, হৃদয়ানুভূতি আছে, আবার সংযমও আছে। এই যে তিনটি গুণ বৈদগ্ধ্য, হৃদয়ানুভূতি ও সংযম এগুলো সাধারণত একসঙ্গে পাওয়া যায় না। খুবই বিরল। আনিসুজ্জামানের লেখায় এই বিরল বিষয়গুলোর সমন্বয় ঘটেছিল।
তাঁর মতো আরেকজনকে পাওয়া যাবে কি না জানি না। যে ক্ষতি হলো, তা পূরণ হওয়ার নয়।
লেখক : সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বিশিষ্ট চিন্তাবিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক।