অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের করোনা পজেটিভ : পূর্বঘোষিত কর্মসূচি বাতিল - দৈনিকশিক্ষা

অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের করোনা পজেটিভ : পূর্বঘোষিত কর্মসূচি বাতিল

নিজস্ব প্রতিবেদক |

ড. আনিসুজ্জামানের করোনা পরীক্ষার ফলাফল পজিটিভ হওয়ায় পূর্বঘোষিত সব কর্মসূচি বাতিল করা হয়েছে। ২৭ এপ্রিল হৃদরোগ সমস্যার পাশাপাশি কিডনি ও ফুসফুসে জটিলতা, পারকিনসন্স, প্রোস্টেট ও রক্তে সংক্রমণের সমস্যা নিয়ে জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে রাজধানীর ইউনিভার্সেল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

শনিবার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয় তাঁকে। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার বিকেল পাঁচটার দিকে মারা যান তিনি।

প্রাথমিকভাবে পরিবারের সদস্যরা জানান, করোনা টেস্টের ফলাফলের ওপরে নির্ভর করবে ড. আনিসুজ্জামানের দাফন। করোনা টেস্টের ফলাফল নেগেটিভ আসলে তাঁর মরদেহ শুক্রবার সকাল এগারটায় বাংলা একাডেমিতে নেয়া হবে। কিন্তু ড. আনিসুজ্জামানের করোনা পরীক্ষার ফলাফল পজিটিভ হওয়ায় পূর্বঘোষিত সব কর্মসূচি বাতিল করা হয়েছে।

এখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম মতো তাঁকে দাফন করা হবে।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনা জেলার বসিরহাটে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম এ টি এম মোয়াজ্জেম। তিনি ছিলেন বিখ্যাত হোমিও চিকিৎসক। মা সৈয়দা খাতুন গৃহিনী হলেও লেখালেখির অভ্যাস ছিল। পিতামহ শেখ আবদুর রহিম ছিলেন লেখক ও সাংবাদিক। আনিসুজ্জামানরা ছিলেন পাঁচ ভাই-বোন। তিন বোনের ছোট আনিসুজ্জামান, তারপর আরেকটি ভাই। বড় বোনও নিয়মিত কবিতা লিখতেন।

আনিসুজ্জামান কলকাতার পার্ক সার্কাস হাইস্কুলে শিক্ষাজীবন শুরু করেন। এখানে তৃতীয় শ্রেণি থেকে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর বাংলাদেশে চলে আসেন এবং খুলনা জেলা স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এক বছর পর পরিবারের সাথে ঢাকায় চলে আসেন এবং প্রিয়নাথ হাইস্কুলে (বর্তমান নবাবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়) ভর্তি হন। ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে এ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে একই বিষয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। সে সময় বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও শিক্ষক ছিলেন মুনীর চৌধুরী।

১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে তিনি বাংলা একাডেমির গবেষণা বৃত্তি লাভ করেন। একই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজ আমলের বাংলা সাহিত্যে বাঙালি মুসলমানের চিন্তাধারায় ১৭৫৭-১৯১৮ বিষয়ে পিএইচডি শুরু করেন। ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের গবেষণা বৃত্তি লাভ করেন। ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উনিশ শতকের বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাস: ইয়ং বেঙ্গল ও সমকাল বিষয়ে পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি।

আনিসুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার মাধ্যমে তার কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের জুনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের রিডার হিসেবে যোগদান করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে তিনি ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ মার্চ পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান করেন এবং পরবর্তী সময়ে ভারত গমন করে শরণার্থী শিক্ষকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি’র সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। যুদ্ধকালীন গঠিত অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭৪ - ৭৫ খ্রিষ্টাব্দে কমনওয়েলথ অ্যাকাডেমি স্টাফ ফেলো হিসেবে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে গবেষণা করেন। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রকল্পে অংশ নেন।

১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসেন। ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন। পরে সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে আবার যুক্ত হন। তিনি মওলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট অব এশিয়ান স্টাডিজ (কলকাতা), প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় এবং নর্থ ক্যারোলাইনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং ফেলো ছিলেন। এছাড়াও তিনি নজরুল ইনস্টিটিউট ও বাংলা একাডেমির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

শিল্পকলাবিষয়ক ত্রৈমাসিক পত্রিকা যামিনী এবং বাংলা মাসিকপত্র কালি ও কলম-এর সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ অনুষ্ঠানে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।

গুণী এ অধ্যাপক একাধারে ছিলেন শিক্ষক, সম্পাদক, গবেষক ও অনুবাদক। অসংখ্য গবেষণাধর্মী বই লিখে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন তিনি, করেছেন সম্পাদনাও। বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদেও রেখেছেন নিপুণতার পরিচয়। মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য (১৯৬৪), মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র (১৯৬৯), মুনীর চৌধুরী (১৯৭৫), স্বরূপের সন্ধানে (১৯৭৬), Social Aspects of Endogenous Intellectual Creativity (1979), Factory Correspondence and other Bengali Documents in the India Official Library and Records (1981), আঠারো শতকের বাংলা চিঠি (১৯৮৩), মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৯৮৩), পুরোনো বাংলা গদ্য (১৯৮৪), মোতাহার হোসেন চৌধুরী (১৯৮৮), Creativity, Reality and Identity (1993), Cultural Pluralism (1993), Identity, Religion and Recent History (1995), আমার একাত্তর (১৯৯৭), মুক্তিযুদ্ধ এবং তারপর (১৯৯৮) ও আমার চোখে (১৯৯৯) সহ লিখেছেন গবেষণাধর্মী অসংখ্য বই।

বাঙালি নারীদের নিয়ে লিখেছেন সাহিত্যে ও সমাজে (২০০০), পূর্বগামী (২০০১), কাল নিরবধি (২০০৩)। অস্কার ওয়াইল্ডের An Ideal Husband এর বাংলা নাট্যরূপ ‘আদর্শ স্বামী’ (১৯৮২), আলেক্সেই আরবুঝুভের An Old World Comedy -র বাংলা নাট্যরূপ ‘পুরনো পালা’ (১৯৮৮) তাঁর লেখা অনুবাদ। এছাড়া রবীন্দ্রনাথ (১৯৬৮), বিদ্যাসাগর-রচনা সংগ্রহ (যৌথ, ১৯৬৮), Culture and Thought (যৌথ, ১৯৮৩), মুনীর চৌধুরী রচনাবলী ১-৪ খণ্ড (১৯৮২-১৯৮৬), বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড (যৌথ, ১৯৮৭), অজিত গুহ স্মারকগ্রন্থ (১৯৯০), স্মৃতিপটে সিরাজুদ্দীন হোসেন (১৯৯২), শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মারকগ্রন্থ (১৯৯৩), নজরুল রচনাবলী ১-৪ খণ্ড (যৌথ, ১৯৯৩), SAARC : A People's Perspective (১৯৯৩), শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের আত্মকথা (১৯৯৫) রয়েছে অসংখ্য একক যৌথ সম্পাদিত প্রকাশনা।

জীবদ্দশায় অসংখ্য পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছে মানুষটি। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে নীলকান্ত সরকার স্বর্ণপদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে দাউদ পুরস্কার,  ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে প্রবন্ধ-গবেষণায় অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি থেকে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষায় অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার একুশে পদক, ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে আনন্দবাজার পত্রিকা কর্তৃক প্রদত্ত আনন্দ পুরস্কার, ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডি. লিট. ডিগ্রি, এশিয়াটিক সোসাইটিতে (কলকাতা) ইন্দিরাগান্ধী স্মারক বক্তৃতা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শরত্‍চন্দ্র স্মারক বক্তৃতা, নেতাজী ইনস্টিটিউট অফ এশিয়ান অ্যাফেয়ার্সে নেতাজী স্মারক বক্তৃতা, অণুষ্টুপের উদ্যোগে সমর সেন স্মারক বক্তৃতা প্রদান।, ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য ভারত সরকার প্রদত্ত তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার পদ্মভূষণ পদক, ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার স্বাধীনতা পুরস্কার, ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে বিপুলা পৃথিবী বইয়ের জন্য আনন্দবাজার পত্রিকা কর্তৃক প্রদত্ত আনন্দ পুরস্কার, ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জগত্তারিণী পদক, ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে সার্ক কালচারাল সেন্টার থেকে সার্ক সাহিত্য পুরস্কার, ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষাক্ষেত্রে অনন্য অবদানের জন্য খান বাহাদুর আহছানউল্লা স্বর্ণপদক লাভ করেন তিনি।

স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0046617984771729