শিক্ষাবিদ, লেখক, গবেষক, মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের ৮২তম জন্মবার্ষিকী আজ। ১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাটে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা এটিএম মোয়াজ্জেম ছিলেন বিখ্যাত হোমিও চিকিৎসক। পিতামহ শেখ আবদুর রহিম উনিশ শতকের প্রতিষ্ঠিত বাঙালি মুসলিম গদ্যলেখক।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় প্রচন্ড মেধাবী ছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। ১৯৫৬ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সম্মান পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান লাভ করেন। একই পরীক্ষায় কলা অনুষদে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে অর্জন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নীলকান্ত সরকার স্বর্ণপদক।’ স্নাতকোত্তর পরীক্ষায়ও তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। ১৯৮৫ সালে বাংলা একাডেমি থেকে পিএইচডি গবেষক হিসেবে বৃত্তি পান।
১৯৫৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৫ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭৪-৭৫ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ বিভাগে ফেলো হিসেবে গবেষণা করেন। ২০০৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি একই বিভাগে প্রফেসর ইমিরেটাস পদে অধিষ্ঠিত রয়েছেন।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ভাষা আন্দোলন, রবীন্দ্র উচ্ছেদবিরোধী আন্দোলন, রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী আন্দোলন এবং ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলনে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৭১ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। এছাড়া শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গঠিত গণআদালতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ যুদ্ধাপরাধী হিসেবে গণআদালতে গোলাম আযমের প্রতীকী বিচার কার্যক্রমে তিনি আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগনামা পাঠ করেছিলেন। এই ভূমিকার কারণে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল। দেশদ্রোহিতার মামলা হয়েছিল।
আনিসুজ্জামানের হাতে বাংলা গদ্যের প্রমিত ও উৎকর্ষমন্ডিত আদর্শ রূপ একটি মানদন্ডে দাঁড়িয়েছে। তিনি মুক্তচিন্তার সর্বজনগ্রাহী সারথি। তার চেতনা আগাগোড়া মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় মিশ্রিত। ‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’ তার পিএইচডি গবেষণার অভিসন্দর্ভ, যা বাঙালি মুসলমান সমাজের সাহিত্য-মানস মূল্যায়নে প্রথম প্রয়াস বলা যায়। ড. আনিসুজ্জামান অনুসন্ধান করেছেন প্রাক-উনিশ শতকী বাংলা গদ্যের নিদর্শন। ‘
পুরোনো বাংলা গদ্য’ অসামান্য গবেষণা গ্রন্থ। মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে লিখেছেন ‘আমার একাত্তর’ বইটি। আনিসুজ্জামানের উল্লেখযোগ্য রচনাবলির মধ্যে রয়েছে- স্মৃতিপটে সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ স্মারকগ্রন্থ, নারীর কথা, মধুদা, ফতোয়া, ওগুস্তে ওঁসার বাংলা-ফারসি শব্দসংগ্রহ, আইন-শব্দকোষ অন্যতম। তার শিশুতোষ বইয়ের সংখ্যা দুটি। সম্পাদনা করেছেন সাঁইত্রিশটি গ্রন্থ।
বাংলা সাহিত্যে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদক, অলক্ত পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কারসহ নানা পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। তিনি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ষান্মাসিক ডি-লিট। শিক্ষা ও সাহিত্য অবদানের জন্য তিনি ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মভূষণ লাভ করেন।