মহামারীর মধ্যে নজিরবিহীন সংকটে পড়েছে ঢাকার শিক্ষাব্যবস্থা; শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পোষাতে স্কুলগুলো অনলাইন ক্লাস চালু করলেও তাতে মন ভরছে না অভিভাবকদের, অপরদিকে বেতন বকেয়ায় শিক্ষকদের বেতন-ভাতা দিতে হিমশিম খাচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো। বুধবার (২৪ জুন) বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন তাবারুল হক।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়ার পর মার্চের শেষার্ধে বন্ধ হয়ে যায় ঢাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। কবে আবার স্কুল খুলবে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো দিনক্ষণও কারও ধারণায় আসছে না।
এই পরিস্থিতিতে স্কুল বন্ধের পরপরই অনলাইন ক্লাস চালু করেছে নামিদামি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। তাতে শিক্ষার্থীর খুব একটা উপকৃত হচ্ছে বলে মনে করছেন না তাদের অভিভাবকরা। স্কুল বন্ধের এই সময়ে বেতন দেওয়া নিয়ে তাই অনেকের থাকছে আক্ষেপ। আবার অচলাবস্থার মধ্যে অনেকের উপার্জন কমে স্কুলের বেতন পরিশোধ কঠিন হয়ে পড়েছে।
অপরদিকে শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দেওয়ার তাড়া রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর। এই সময়ে শিক্ষার্থীদের বেতন বকেয়া পড়ায় শিক্ষকদের বেতন-ভাতা নির্ধারিত সময়ে এমনকি পুরোপুরি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছে একাধিক স্কুল কর্তৃপক্ষ।
রাজধানীর সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, রাজধানী আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মনিপুর হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর অভিভাবক ও বিদ্যালয়ের প্রধানদের সঙ্গে কথা বলে এই চিত্র পাওয়া গেছে।
অনলাইনে ক্লাস-পরীক্ষা নিয়ে সন্তুষ্ট না হওয়ার কথা জানালেও সংশ্লিষ্ট স্কুল থেকে সন্তানের প্রতি ‘বৈষম্য’ করা হবে, এমন শঙ্কা থেকে সেই সব অভিভাবকরা নাম প্রকাশ করতে চাননি।
তারা বলছেন, অনলাইনে ক্লাস নেয়ার মুখ্য উদ্দেশ্য শিক্ষার্থীদের থেকে বেতন আদায় করা। যে কারণে ‘নাম মাত্র’ ক্লাস-পরীক্ষা নিয়ে ফোন করে এবং এসএমএস পাঠিয়ে বেতন পরিশোধ করতে তাড়া দেওয়া হয়।
তবে সংশ্লিষ্ট স্কুলগুলোর কর্তৃপক্ষের দাবি, করোনাভাইরাসের কারণে যে সংকট দেখা দিয়েছে সেদিক বিবেচনা করে তারা অভিভাবকদের চাপে ফেলে বেতন আদায় করছেন না। স্কুলের শিক্ষকদের বেতন দেয়ার জন্য অনেকটা ‘মানবিকতার সুরে’ শিক্ষার্থীর বেতন পরিশোধ করতে বলা হচ্ছে। কোনো কোনো শিক্ষার্থীর আবেদনের প্রেক্ষিতে বেতন মওকুফ করার নজির থাকার কথাও জানিয়েছেন একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান।
করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে সরকারি স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য ক্লাস দেখানো হচ্ছে সংসদ টিভিতে। করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে সরকারি স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য ক্লাস দেখানো হচ্ছে সংসদ টিভিতে।ভিকারুননিসার শিক্ষকদের ৭০০ ক্লাস ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ফওজিয়া বলেন, “আমরা এপ্রিল থেকেই অনলাইনে ক্লাস নেয়া শুরু করেছি। ইউটিউব, ফেইসবুকসহ অন্যান্য মাধ্যমে লেকচারগুলো শিক্ষার্থীদের মাঝে পৌঁছে দেয়ার জন্য আমাদের শিক্ষকরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছেন।”
তবে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তৃতীয় শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর মা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “শিক্ষকরা যেভাবে তাদের লেকচার দিচ্ছেন তাতে মনে হয় না আমার বাচ্চার বড় কোনো উপকার হবে। একটা বিষয় নিয়ে রেকর্ড করে ইউটিউবে আপলোড করে দেয়া হলেই সব কিছু হয়ে যায় না। যে বিষয়ের ওপর লেকচার দেয়া হয় তা শিক্ষার্থীকে বুঝতে হবে। কিন্তু এটা তেমনভাবে কার্যকর হচ্ছে বলে আমার মনে হয় না।”
তবে অধ্যক্ষ ফওজিয়ার দাবি, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ইতোমধ্যে সাতশ’র মতো ক্লাস নেয়া হয়েছে।
অনেক শিক্ষার্থীর গত পাঁচ মাসের বেতন-ফি বকেয়া পড়েছে দাবি করে তিনি বলেন, “এই সংকটের মধ্যে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা প্রতিষ্ঠানের ফান্ড থেকে আপাতত দেয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদেরও বেতন দেয়ার কথা বলছি। কাউকে চাপ না দিয়ে বলা হচ্ছে যেন সুযোগ মতো বেতন পরিশোধ করা হয়। অনেকে দিচ্ছে।”
এর মধ্যে যাদের পরিশোধ করতে সমস্যা হবে তাদের বিষয়ে বিবেচনা করা হবে এবং ইতোমধ্যে আবেদনের প্রেক্ষিতে এক হাজার শিক্ষার্থীর বেতন মওকুফ করা হয়েছে বলে জানান ভিকারুননিসার অধ্যক্ষ।
ফেসবুক লাইভে আইডিয়ালের ক্লাস, বেতনের জন্য চাপ
আইডিয়াল স্কুল বনশ্রী শাখার এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক জানান, মে মাসের মাঝামাঝিতে স্কুল কর্তৃপক্ষ অনলাইনে ক্লাস শুরু করেছে। তারা স্কুলের নামে ফেসবুকে একটি আইডি খুলে দিনে ৩০ মিনিটের একটি ক্লাস নিয়ে থাকে। কিন্তু স্বল্প সময়ে ক্লাসে শিক্ষার্থীরা কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ পায় না।
“এমনকি তারা যে ক্যামেরা দিয়ে ক্লাস নেয় সেটিও স্পষ্ট না। শিক্ষকরা তাড়াহুড়ো করে কোনো একটা বিষয় পড়িয়ে চলে যায়। এতে করে কোনো ছাত্র বুঝতে পারল কি না তা তারা দেখে না। ছাত্ররা এতে বেনিফিটেড হচ্ছে না।”
গত এক মাস আইডিয়াল স্কুলের কেন্দ্রীয় শাখা থেকে অনলাইনে ক্লাস নেওয়া হয়েছে জানিয়ে ওই অভিভাবক বলেন, “জুন থেকে প্রতিটি শাখায় আলাদাভাবে ক্লাস নেওয়া শুরু করেছে। প্রকৃতপক্ষে এতেও কোনো সন্তোষজনক ক্লাস তারা নিচ্ছে না।”
তবে অনলাইনে ক্লাস নেয়া শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা মূল কারণ নয় মন্তব্য করে ওই অভিভাবক বলেন, “এই আয়োজন করার মাধ্যমে তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে, বেতন আদায় করা। সেটাই তারা করছে।”
বেতন পরিশোধের জন্য অভিভাবকদের ফোন করতে প্রতিটি শ্রেণির একজন শিক্ষককে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “একদিন একটা ফোন আসে, ওই প্রান্ত থেকে শিক্ষক পরিচয় দিয়ে ছেলের বেতন পরিশোধ করতে বলেন। এরপর মাস শেষে তারা এভাবে ফোন করে।”
এরপর থেকে প্রতি মাসে ছেলের স্কুলের বেতন বিকাশে পরিশোধ করছেন বলে জানান তিনি।
তবে আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম বলেন, “আমাদের শিক্ষকরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন যেন সবচেয়ে ভালো ক্লাসটা তারা দিতে পারেন। আমরা রুটিন করে দিয়েছি, সেই অনুসারে তারা প্রস্তুতি নিয়ে অনলাইনে ক্লাস করে যাচ্ছেন। এই সংকটকালে আমাদের জায়গা থেকে শিক্ষার্থীদের যতটুকু উপকারে আসে সেই কাজটা করে যাচ্ছি।”
তবে শিক্ষকরা তাড়াহুড়ো করে ক্লাস নিচ্ছেন বা ক্যামেরার সমস্যা এসব অভিযোগ মানতে নারাজ এই অধ্যক্ষ।
তিনি বলেন, “একটা বিষয় বুঝিয়ে উপস্থাপন যতক্ষণ না করতে পারেন ততক্ষণ তো সময় শিক্ষকরা দিচ্ছেন। তাড়াহুড়োর বিষয় তো না। তাছাড়া ক্যামেরা স্পষ্ট না- কথাটা ঠিক না। কারণ অনেক সময় আলোর স্বল্পতা অথবা হাতের লেখা ক্যামেরা দিয়ে দেখানোর ক্ষেত্রে হয়ত কোনো ধরনের সমস্যা তো হতেই পারে।”
অনলাইনে ৮০-৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করছে জানিয়ে শাহান আরা বেগম বলেন, “সাধারণ সময়ে স্কুলেই তো শতভাগ উপস্থিতি থাকে না। তারপরও আমরা শিক্ষার্থীদের ঘরে থাকার সময়ে অনলাইনে ক্লাসে অংশ নিতে বলছি। আশানুরূপ শিক্ষার্থীরা অংশও নিচ্ছেন।”
শিক্ষার্থীদের বেতন পরিশোধের জন্য প্রতিষ্ঠান থেকে নোটিশ করা হয়ে থাকে জানিয়ে তিনি বলেন, “কোনো অভিভাবককে চাপ দিয়ে বেতন আদায় করা হচ্ছে না। এটা চাপের কোনো বিষয় না। তাদের সন্তানরা পড়াশোনা করছেন তারা নিজে থেকেই বেতন পরিশোধ করেন। এখন যেহেতু ঘর থেকে মানুষ বের হওয়াটা ঝুঁকিপূর্ণ, তাই বের না হয়ে সহজে কীভাবে বেতন পরিশোধ করা যায় সেই বিষয়টি অভিভাবকদের বলে দেয়া হচ্ছে।”
আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ বলেন, “সাধারণ সময়েও বহু অভিভাবক তাদের সন্তানের বেতন নির্ধারিত সময়ে পরিশোধ করতে পারেন না, সেটা তো মেনে নিতে হয়। এখনও সেইভাবেই আমরা নিচ্ছি। যে কারণে মে মাসের বেতন এখনও আমরা শিক্ষকদের দিতে পারিনি। হয়ত কয়েক দিনের মধ্যে শিক্ষকদের বেতন পরিশোধ করা সম্ভব হবে।”
হোয়াটসঅ্যাপে সাউথ পয়েন্ট স্কুলের ক্লাস-পরীক্ষা
সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে শিক্ষার্থীর অভিভাবকের হোয়াটসঅ্যাপ আইডিতে ক্লাস রেকর্ড করে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তারা একইভাবে প্রশ্ন পাঠিয়ে পরীক্ষাও নেয়।
এই প্রতিষ্ঠানের এক শিক্ষার্থীর বাবা বলেন, “হোয়াটসঅ্যাপে একটা রেকর্ড পাঠায়, তারা বলছে এটা অনলাইন ক্লাস। এই ক্লাসে শিক্ষার্থী বুঝল কি না তারা আর খবর নেয় না। কারণ শিক্ষার্থী কোনো ফিডব্যাক দিতে পারে না। এখন পরীক্ষা চলছে, সেই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তারা পরীক্ষার দিন রাত ৮টায় হোয়াটসঅ্যাপে দেয়, ৪০ মিনিট পর উত্তরপত্রের ছবি তুলে আবার হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাতে হয়।”
মাস শেষে স্কুল থেকে অভিভাবকদের তাদের ছেলে-মেয়ের বেতন পরিশোধ করতে এসএমএস বা ফোন করা হয়।
সাউথ পয়েন্ট স্কুলের ওই অভিভাবক বলেন, “আমি ব্যাংকে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে ছেলের বেতন পরিশোধ করেছি। যখনই বেতন পরিশোধ করতে গিয়েছি তখন অন্যান্য অভিভাবকদের বেতন পরিশোধ করতে দেখেছি।”
তবে এই স্কুলের আরেক শিক্ষার্থীর অভিভাবক করোনাভাইরাসের সংকটের সময় হোয়াটসঅ্যাপে ক্লাস-পরীক্ষা নেয়াকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন।
তিনি বলেন, “এভাবে ক্লাস-পরীক্ষা নেয়ার ক্ষেত্রে আসলে শিক্ষকদেরও বেশি কিছু করার নেই। তারা সংক্ষিপ্ত প্রশ্নের সমাধান ও পরীক্ষা নিয়ে থাকে। এটা একদিক দিয়ে ইতিবাচক হল- আমার সন্তান পড়াশোনার মধ্যে থাকছে।”
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ হামিদা আলী বলেন, “আমরা অনলাইনে শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিচ্ছি, পড়া দিচ্ছি। আবার পরীক্ষাও নিচ্ছি। আমাদের শিক্ষকরা রুটিন মাফিক এসব ক্লাস-পরীক্ষা নিচ্ছেন। যতটুকু সাধ্য আছে সেই অনুযায়ী আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।”
বেতন আদায়ে শিক্ষার্থীর অভিভাবককে চাপ দেয়া হচ্ছে না দাবি করে তিনি বলেন, “শিক্ষকদের বেতন এখন পর্যন্ত বহু কষ্টে পরিশোধ করতে হয়েছে। চলতি মাসের বেতন দেয়া সম্ভব হবে না। যে কারণে অভিভাবকদের এই বিষয়ে একটু সুনজর দেয়ার কথা বলছি। তারপরও কোনো কোনো অভিভাবক যারা আর্থিক সংকটে পড়েছেন তাদের বিষয়ে বিবেচনা করা হচ্ছে।”