অনলাইন পাঠের সাফল্য - দৈনিকশিক্ষা

অনলাইন পাঠের সাফল্য

সন্তোষ দাস |

অদৃশ্য শক্তি করোনার বিরুদ্ধে সারা পৃথিবী লড়ছে। কিন্তু কিছুতেই একে বসে আনা যাচ্ছে না। এ পর্যন্ত প্রায় অর্ধকোটি মানুষ আক্রান্ত এবং তিন লক্ষাধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। মানুষের মৃত্যু ছাড়াও ভয়ংকর এই করোনা বিশ্ব অর্থনীতিসহ সব সেক্টরকেই তছনছ করে দিয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থাও আজ বড় ধরনের হুমকির মুখে। সকল পর্যায়ের শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকরা এখন গৃহবন্দি। কিন্ডারগার্টেন থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখন বন্ধ। বড় বড় পাবলিক পরীক্ষাসহ সকল প্রকার পরীক্ষা স্থগিত রয়েছে। এতে সেমিস্টার জট বা সেশন জটের তীব্র সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এমতাবস্থায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রযুক্তি ব্যবহার করে, বিশেষ করে অনলাইন ক্লাস নেয়া শুরু হয়েছে। আমাদের দেশেও গত মাসের গোড়ার দিক থেকে সীমিত আকারে হলেও অনলাইন পাঠ দান শুরু হয়েছে। কিন্তু এর সাফল্য নিয়ে দেখা দিয়েছে বড় ধরনের সংশয়।

যারা অনলাইন পাঠদানের সাথে নিজেদের যুক্ত করেছেন, তারা ইতোমধ্যে তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা দিয়ে দেখেছেন কত কম হারে শিক্ষার্থীদের এই প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত করা যাচ্ছে। আমি নিজে অনেক চেষ্টা করেও মাত্র পনের শতাংশের বেশি শিক্ষার্থীকে যুক্ত করতে পারিনি। আমি আমার অনেক সহকর্মী ও বন্ধুদের সাথে কথা বলে জেনেছি তাদের অভিজ্ঞতাও একই ধরনের। বিশেষ করে আমরা যারা গ্রামাঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাজ করি, তাদের অভিজ্ঞতা হতাশাজনক।

অনলাইন পাঠদানের এই হতাশাজনক সাফল্যের পিছনে মোটা দাগে তিনটি কারণ দায়ী বলে আমার মনে হয়। সেগুলো হলো-যন্ত্র (ডিভাইস), অর্থ ও জ্ঞান (প্রযুক্তিগত জ্ঞান)।

প্রথমত, অনলাইন ক্লাসের সাথে যুক্ত হতে গেলে নিদেন পক্ষে একটি স্মার্ট মোবাইল সেট থাকতে হবে, ল্যাপটপ হলে ভালো হয়। কিন্তু গ্রাম অঞ্চলে এমন দু’একটি পরিবার এখনো আছে যাদের একটি বাটন প্রেসড সেট থাকলেও স্মার্ট নেই। যদি একজন মাত্র শিক্ষার্থীরও আধুনিক এই ডিভাইসটি না থাকে তবে সে প্রযুক্তি নির্ভর পাঠ গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হবে।

দ্বিতীয়ত, স্মার্ট ফোন থাকলেও তাতে নেট কানেকশানের প্রয়োজন হয়। গ্রাম এলাকায় পাঁচ শতাংশ শিক্ষার্থীর বাড়িতেও ওয়াইফাই সুবিধা নেই, এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়। তাহলে তাদেরকে বিভিন্ন অফারের নেট কিনে সংযুক্ত হতে হয়। করোনার এই মহাদুর্যোগকালে গ্রামাঞ্চলের মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত বা দিনমজুর কিষাণ পরিবারকে যেখানে দু’বেলা দু’মুঠো খাবার জোগাড় করতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে, সেখানে টাকা খরচ করে নেট কিনে অনলাইন ক্লাসে যুক্ত হবে এমন কথা তারা তো ভাবতেই পারে না। এক জিবি নেটে চল্লিশ মিনিট করে মোটামুটি তিনটি ক্লাস করা যায়। শুধু একজন শিক্ষকের ক্লাস করলেই তো আর হবে না। দিনে তিনটি করে ক্লাস করলেও প্রতিদিন এক জিবি নেট কেনার প্রয়োজন হবে। অনেক দরিদ্র পরিবারের জন্য এই খরচটি একেবারেই অসম্ভব।

তৃতীয়ত, উপরের দুটি বিষয় ঠিক থাকলেও গ্রামের কিছু কিছু শিক্ষার্থী আধুনিক প্রযুক্তির সাথে অভ্যস্ত নাও হতে পারে। অনলাইনে ক্লাস করার জন্য স্কাইপি, হোয়াটসঅ্যাপ, ম্যাসেঞ্জার, জুম ইত্যাদির মাধ্যমে সংযুক্ত হতে হয়। এর মধ্যে বর্তমানে জুম সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। জুমে এক সাথে একশ জন সংযুক্ত হতে পারে। কিন্তু এটি ডাউনলোড করে সংযুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া অনেকে জানে না। এই সমস্যাটি অনেক শিক্ষকের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সিনিয়র অনেক শিক্ষক আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে অভ্যস্ত নন। এমনকি অনেকে স্মার্ট ফোন সেট পর্যন্ত ব্যবহার করেন না। এখন যারা জানেন তারা যে এনাদের সাহায্য করবেন সেটাও লকডাউনের জন্য পারস্পারিক দেখা সাক্ষাৎ না হওয়ায় সম্ভব হচ্ছে না।

আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই কথাগুলি বলছি। কিছু কিছু শিক্ষার্থীর সাথে যোগাযোগ করাই সম্ভব হয়নি। তারা ভর্তির সময় যে মোবাইল নম্বরটি অফিসে দিয়েছিল সেটি এখন বন্ধ। যাদের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়েছে তাদের অনেকেরই উপরোক্ত তিনটি কারণের যে কোনো একটি, দুটি বা তিনটিই বিদ্যমান। কেউ কেউ সব কিছু শুনে রহস্যজনক কারণে ফোনটি বন্ধ করে রেখেছে অথবা কল রিসিভ করছে না। আবার কেউ কেউ প্রবল আগ্রহ নিয়ে প্রথম প্রথম একটি দুটি ক্লাস করলেও পরে আর কনটিনিউ করছে না। এই প্রায় দেড় মাসে এরকম বিচিত্র অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। তারপরও চেষ্টা অব্যাহত আছে।

এই অবস্থার মধ্য দিয়ে মাত্র দশ থেকে পনের শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইনে ক্লাস করে কিছুটা এগিয়ে থাকলেও ব্যাপক অংশের আওয়াতার বাইরে থেকে যাচ্ছে। এতে করে সমস্যা আরো প্রকট হচ্ছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে যখন প্রতিষ্ঠান খুলবে তখন দেখা যাবে একই ক্লাসে কেউ অনেকটা শিখেছে, কেউ কিছুটা আবার কেউ মোটেও না।

সুতরাং অনলাইন পাঠদান বা গ্রহণে আমরা আশানুরূপ সাফল্য পাচ্ছি না। এক্ষেত্রে সংসদ টিভিতে ‘আমার ঘরে আমার স্কুল’ তুলনামূলকভাবে বেশি কার্যকর। কারণ এখন মোটামুটি শতভাগ গ্রামে বিদ্যুৎ আছে এবং প্রায় প্রতিটা পরিবারে একটি টিভি সেট আছে। এখানে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের সুযোগ বেশি। কিন্ত এখানেও কিছু সমস্যা বা সমন্বয়হীনত লক্ষণীয়। আমি প্রথম কয়েকদিন পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি এখানে ঠিকমতো রুটিন মেইনটেইন হয় না। অর্থাৎ পূর্বে দেয়া সময় অনুযায়ী যে সময়ে যে ক্লাস হওয়ার কথা তা হয় না। নির্ধারিত সময়ে টিভি অন করলে দেখা যায়, যে ক্লাসটি তখন হওয়ার কথা তা না হয়ে অন্য আর একটি হচ্ছে। একই ক্লাস পুনঃপ্রচার হচ্ছে। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের ক্লাস হচ্ছে না বললেই চলে। এসব কারণে শিক্ষার্থীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এখানে কিছু পরামর্শ হলো, রেকর্ডিং ক্লাসের পরিবর্তে লাইভ ক্লাস হলে এবং যিনি ক্লাস পরিচালনা করছেন তার মোবাইল নম্বরটি টিভির স্ক্রলে দেয়া থাকলে শিক্ষার্থীদের সরাসরি প্রশ্ন করার সুযোগ থাকত। তাতে করে ঐ পাঠটি আরও প্রাণবন্ত হতো। এছাড়া রুটিন ও সময়ের সমন্বয়সহ কিছু কিছু সংস্কার করতে পারলে সংসদ টিভির মাধ্যমে নেয়া ক্লাসগুলি বেশি ফলপ্রসূ হতে পারে।

আমরা বর্তমানে অনলাইনে যেভাবে ক্লাস নিচ্ছি তাতে যে অর্থ ও শ্রম ব্যয় হচ্ছে সেই তুলনায় সাফল্য পাওয়া যাচ্ছে খুবই কম। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা নীতি নির্ধারকরা যে বিষয়টি বোঝেন না, এমনটি নয়। বরং আমাদের থেকে অনেক অনেক গুণ বেশি ভালো বোঝেন। কিন্তু তাদের কথা বার্তা আর বডি ল্যাংগুয়েজ দেখে মনে হয়, কিছু একটা করতে পেরেছেন, এই আত্মতুষ্টিতে তারা ভুগছেন।

আমি বিশেষজ্ঞ নই, সাধারণ শিক্ষক মাত্র। তাই শিক্ষাবিদ এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যাঁরা বিশেষজ্ঞ তাঁদের কাছে আহ্বন, আপনারা আরও ভাবুন, লকডাউনের এই সময়টাতে কীভাবে শিক্ষার্থীদের আরও ফলপ্রসূভাবে শিক্ষাসংক্রান্ত কার্যক্রমে অন্তর্ভূক্ত করা যায়। আমি শুধু বলতে চেয়েছি, আমরা বর্তমানে যেভাবে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে অনলাইন ক্লাসের মহড়া দিচ্ছি তা অনেকটা লোক দেখানো হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের খুব একটা উপকার হচ্ছে না।

লেখক : সন্তোষ দাস, প্রভাষক, সরকারি ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা কলেজ, ফকিরহাট, বাগেরহাট, খুলনা।

[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন।]

এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ - dainik shiksha এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ - dainik shiksha পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী - dainik shiksha ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ - dainik shiksha প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0044889450073242