গত ১০ মার্চ অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল সংবাদপত্রে লিখেছিলেন, ‘পরীক্ষা না থাকলে কী হয়?’ এর আগে টিভির সাক্ষাত্কারেও তিনি কথাটি বলেছিলেন। ২১ মার্চ দেশের মানুষ সংবাদপত্র মারফত জানতে পারল, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত আর পরীক্ষা থাকছে না। একই সঙ্গে বলা হয়েছে, প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাকাল দুই বছর। অর্থাৎ চার বছরে প্রথম স্তর এবং পাঁচ বছরে দ্বিতীয় স্তর। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষা তুলে দেয়ার আগের সিদ্ধান্তটি সম্পর্কে এখন আর নতুন কিছু বলা হয়নি।
অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পরীক্ষা না নেয়ার পেছনে যুক্তি দিয়ে বলেছেন, পৃথিবীর অনেক দেশে শিশুদের জীবন থেকে পরীক্ষা নামক অভিশাপটি দূর করে দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে ফিনল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থাকে তিনি আদর্শ স্থানীয় হিসেবে তুলে ধরেছেন। যদিও এ সম্পর্কে আমরা ভালোভাবে ওয়াকিবহাল নই। তবে অধ্যাপক ইকবাল সাহেবের তথ্যানুসারে, ‘সে দেশের শিশুরা তাদের জীবনে প্রথম পরীক্ষাটি দেয় ১৬ বছর বয়সে।’ অর্থাৎ আমাদের দেশের প্রবেশিকা পরীক্ষা বা ম্যাট্রিকুলেশন অথবা সমমানের পরীক্ষাটি তাদের দিতে হয় ওই ১৬ বছর বয়সেই।
১৬ বছর বয়সের পরীক্ষাটি কী পদ্ধতি অবলম্বন করে দেয়া হয়, অধ্যাপক ইকবাল তা স্পষ্ট করে বলেননি। আমাদের দেশে ওই পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেয়া হলে গাইড, কোচিংয়ের ব্যবসাসহ প্রশ্নপত্র ফাঁস ও নকল বন্ধ হবে কিনা, সেটাও অনুল্লেখ রয়ে গেছে। পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষা তুলে দেয়ার দাবিও তিনি করেননি। কিন্তু বর্তমান সিদ্ধান্তটি সে দিককেই লক্ষ্যবস্তু হিসেবে যে ধরা হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যদিও রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ-২০১৭ উদযাপনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষা দুটি রাখার পক্ষে দৃঢ় অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু বর্তমান সিদ্ধান্তটির (তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত আর পরীক্ষা থাকছে না) সঙ্গে অধ্যাপক জাফর ইকবালের সুপারিশের সংগতি থাকলেও প্রধানমন্ত্রীর পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষাসংক্রান্ত অভিমত মুহম্মদ জাফর ইকবালের মতের সঙ্গে বিরোধাত্মক বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর মতটি অগ্রগণ্য বলে আমি মনে করি এবং ‘পরীক্ষা না থাকলে কী হয়’ মুহম্মদ জাফর ইকবালের মতটি প্রধানমন্ত্রীকে যে প্রভাবিত করেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
সন্দেহাতীতভাবে অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল খুব চমত্কার বলেছেন, ‘মস্তিষ্কের মাঝে তথ্য ঠেসে দেয়াটা শিক্ষা নয়, বইপত্রে তথ্য আছে, যখন দরকার সেই তথ্য দেখে নেয়া যাবে, মুখস্থ করে সেটা মাথায় ঢোকাতে হবে কেন?’ গাণিতিক ও রসায়নের সিম্বলিক তথ্যগুলো কীভাবে আয়ত্ত করা যায়, সে বিষয়ে তিনি কোনো কিছু উল্লেখ না করলেও সহজে বলতে পারি, অনুশীলন বা হাতেনাতে কাজ করার মধ্য দিয়ে এটা আয়ত্ত করা হয়তো সম্ভব। ইংরেজি বা অন্য ভাষা শেখার ক্ষেত্রেও অনুশীলন প্রাধান্য পেলে এটা সহজ হবে এবং এ পদ্ধতিতেই যেকোনো বিষয়ের তত্ত্বগুলো আয়ত্ত করা সম্ভব বলে আমি আমার শিক্ষাজীবন থেকে মনে করি। তবে তত্ত্ব ও তথ্য লেখার অনুশীলন না থাকলে শিক্ষার্থীরা তা রাতারাতি কীভাবে অর্জন করবে, সেটা একটা ভাবার বিষয় বটে। পরীক্ষা তো সে ধরনের একটা অনুশীলনের বিষয়। তাই পরীক্ষা তুলে দেয়ার চেয়ে এবং তথ্য মুখস্থ করার পরিবর্তে পরীক্ষার ধরন বা পুরনো মূল্যায়ন পদ্ধতি পরিবর্তন নিয়ে ভাবলে হয়তো বেশি ভালো হতো। এখনো সে সুযোগ আমাদের হাতে রয়েছে।
অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের স্ববিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত এবং প্রধানমন্ত্রীর বর্তমান নির্দেশটি বাস্তবায়ন হলে পিইসি বা জেএসসি পরীক্ষা পদ্ধতি বা মূল্যায়ন পদ্ধতির কী হবে, সেটাই এখন জানার অপেক্ষা। যদিও এ সম্পর্কে আগেই বলেছি, পুনরায় এর উল্লেখ প্রয়োজন নেই। একই সঙ্গে এখানে গাইডবুক, প্রশ্নপত্র ফাঁস, নকল করা ও কোচিং বন্ধের পদ্ধতি বা প্রক্রিয়াটি স্পষ্ট না করলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক সবাই প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষানীতি সম্পর্কে অন্ধকারে থেকে যাবেন; যা আমাদের কারো কাম্য নয়।
আমার মনে হয়, এক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই হবে সব কাজের কেন্দ্রবিন্দু। শিক্ষার্থীর আনন্দদান থেকে শুরু করে পাঠদান করবে স্কুল, পরীক্ষা নেবে স্কুল এবং ফলাফল ও সার্টিফিকেট দেবে স্কুল বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। অনেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিস্টারভিত্তিক পদ্ধতির আদলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা চালু করা যেতে পারে। অ্যাসাইনমেন্ট বা পূর্বনির্ধারিত বিষয়ের ওপর হোমওয়ার্কও হতে পারে পরীক্ষার অংশ। তাছাড়া শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার উদ্দেশ্য কী হবে, সেটা শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আগে থেকেই জানতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চিকিৎসক, প্রকৌশলী ও সচিব বা আমলা তৈরির ইনকিউবেটর হলে চলবে না। প্রথমত, প্রতিটি শিক্ষার্থীর যেকোনো বিষয়ে একজন দক্ষ শ্রমিক হওয়ার যোগ্যতা থাকতে হবে এবং সেই সঙ্গে তার বিভাগভিত্তিক চাকরির ব্যবস্থা থাকতে হবে শতভাগ।
অন্যদিকে যোগ্যতা ও আগ্রহের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার জন্য উচ্চতর ডিগ্রি নিতে পারেন এবং চাকরি ক্ষেত্রে বেতনের বড় ধরনের বৈষম্য যেন না থাকে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। আর এসব বিষয়ে গবেষণা ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে বর্তমান শিক্ষানীতি তো বটেই, যেকোনো ধরনের শিক্ষানীতি রাষ্ট্রের জন্য হয়ে পড়বে অকার্যকর। বর্তমানের পুরনো শিক্ষানীতিটি যেমন হালে পানি পাচ্ছে না, সেটাও হবে তেমনি।
আমাদের শিক্ষানীতি অকার্যকর যেন না হয়, সেজন্য সব ধরনের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান (আইন-আদালত, সেনাবাহিনী ও সরকার পদ্ধতি ইত্যাদি) হতে হবে গণমুখী, যেখানে জনগণের অংশগ্রহণ প্রাধান্য পাবে এবং আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা উচ্ছেদ হবে। কেবল তবেই উন্নত বিশ্ব বা ফিনল্যান্ডের মতো আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা হয়ে উঠবে দৃষ্টান্তমূলক। ফিনল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থাই যে ত্রুটিমুক্ত এবং একমাত্র মাপকাঠি, এমন ভাবনাও অর্থহীন। ফিনল্যান্ডের উদারনৈতিক আমলাতন্ত্র আর আমাদের দেশের সংকীর্ণ আমলাতন্ত্র সারবস্তুগতভাবে, শ্রেণীগতভাবে অভিন্ন হলেও রাষ্ট্র চরিত্রের দিক থেকে এরা ভিন্ন—এটি ভুলে গেলে চলবে না। ওরা হচ্ছে পরিপূর্ণ স্বাধীন রাষ্ট্র আর আমরা হচ্ছি নয়া ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র চরিত্রের জালে বাঁধা। ফলে স্বাধীন ও বাস্তবমুখী কর্মক্ষেত্রের অভাব এবং খোদ বর্তমান শিক্ষানীতিটির সমস্যাসহ আমাদের অনুকরণীয় অন্য সমস্যাগুলো বাস্তবে ‘বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো’-তে পরিণত হতে বাধ্য।
আমরা সর্বক্ষেত্রে স্বাধীন রাজনীতি ও অর্থনীতির বদলে দেউলিয়া পুঁজিবাজার এবং দেশী-বিদেশী মনোপলি করপোরেট অর্থনীতির অধীন। এগুলো হচ্ছে নৈরাজ্যবাদী ও নয়া ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য। এ-জাতীয় বৈশিষ্ট্য থেকে মুক্তিলাভ ব্যতীত আমাদের সুষ্ঠু শিক্ষা ও সুস্থ মেধার প্রকৃত বিকাশও অসম্ভব। প্রকৃতপক্ষে আমাদের পুরনো ও প্রত্যক্ষ ঔপনিবেশিক যুগের শিক্ষানীতি পরিবর্তন করতে হলে প্রয়োজন রাষ্ট্র ও সমাজের আমূল পরিবর্তন, যাকে বলা হয় বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন। রাজনীতি ও অর্থনীতিতে বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন ছাড়া শিক্ষানীতির সংস্কার যে একটা কাগুজে সংস্কার বৈ অন্য কিছু নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আমার তাই মনে হয়, আমাদের দেশের বর্তমান শিক্ষানীতি থেকে আমাদের যেমন মুক্তি ঘটা দরকার, তেমনি করপোরেট অর্থনীতি ও নীতিহীন ভ্রাতৃপ্রতিম ও বন্ধুপ্রতিম পররাষ্ট্রনীতির নয়া ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রীয় চরিত্রের মুক্তিলাভ ছাড়া আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কারের গুরুত্ব অনেকাংশে অর্থহীন। বর্তমান বৈষম্যবিভক্ত সমাজ ব্যবস্থায় নৈরাজ্যমুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা অসম্ভব। এটাই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মূল দুর্বলতা। আর এ দুর্বলতা থেকে আমরা অনেক কিছু ঘটা করে শুরু করতে চাইলেও বাস্তবে তা ঘটে না। যা ঘটে, তা হচ্ছে এক নৈরাজ্য হটাতে গিয়ে আরেক নৈরাজ্যকর নীতি ডেকে আনা। আমরা যেন হুটহাট করে নতুন শিক্ষানীতির নামে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা, পরীক্ষাহীন পড়াশোনার নৈরাজ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর চাপিয়ে না দিই, সে বিষয়ে সতর্কতা বাড়াতে হবে। মুখস্থবিদ্যাসর্বস্ব পরীক্ষা ব্যবস্থা পরিহার করে একক বা গ্রুপভিত্তিক এবং অনুশীলনমুখী পরীক্ষা ব্যবস্থা চালু রেখে নতুন শিক্ষানীতি চালু করা। অন্যথায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষার নতুন নীতি আঁতুড়ঘরেই মুখ থুবড়ে পড়বে।
আমাদের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের কথা ভেবে আমাদের শিক্ষানীতি বিশেষ করে বর্তমানের পরীক্ষামুক্ত প্রাথমিক শিক্ষানীতিটি আমাদের নিজেদের গবেষণার দ্বারা সৃষ্টি করতে হবে এবং পরীক্ষা বহাল রেখে গবেষণা এগিয়ে নিতে হবে। এজন্য রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন থেকে শুরু করে উন্নত বিশ্বের শিক্ষানীতিসহ সমাজতান্ত্রিক শিক্ষানীতির অভিজ্ঞতা আমাদের কাজে লাগাতে হবে। সেসব তথ্য-উপাত্ত, তত্ত্ব সংগ্রহ করে সর্বস্তরে মাতৃভাষায় তা বিতরণ করতে হবে। গবেষণাকে গুটিকতক বুদ্ধিজীবীর মধ্যে সীমাবদ্ধ না করে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সর্বজনের কাছে পৌঁছাতে হবে। আর এসব আয়োজন করতে এবং একটা যৌথ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে ছয় মাসের বেশি সময় লাগার কথা নয়। সে সময় আমাদের হাতে যথেষ্ট রয়েছে, যেহেতু আলোচিত শিক্ষানীতিটি বাস্তবায়ন হওয়ার কথা আগামী শিক্ষাবর্ষে।
লেখক: শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক
সৌজন্যে: বণিক বার্তা