গত শনিবার আলোচিত বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যার দিনের সিসিটিভি’র নতুন একটি ভিডিও ফুটেজ উদ্ধার করা হয়। সিসিটিভি’র নতুন সেই ভিডিও ফুটেজ রোববার দেশবাসীর কাছে ফেসবুকের মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। ভাইরাল হওয়া নতুন ভিডিওতে রিফাতের ওপর হামলার ঘটনা ও হামলাকারীদের চেহারা স্পষ্ট। নতুন ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ হওয়ার পর এ মামলায় এজাহারভুক্ত আসামিরা ছাড়াও আরও অনেকে জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে। বিশেষ করে সন্দেহভাজন যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তারা ছাড়াও আরও কয়েকজনকে হত্যাকাণ্ডে অংশ নিতে দেখা গেছে।
নতুন এ ফুটেজে দেখা যায়, রিফাত হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছে ২০ জনেরও বেশি। বরগুনা সরকারি কলেজের প্রধান ফটকের সামনে রিফাতের কলার ধরে রিফাত ফরাজী ও রায়হান। ঠিক এ সময়ে রিফাতের ছোট ভাই রিশান ফরাজী দুই হাত আগলে জাপটে ধরে সামনের দিকে নিয়ে যেতে থাকে।
আর পেছনে তানভীর, মোহাইমিন, টিকটক হৃদয়, রাব্বি ও নাঈমসহ অন্তত ১০ থেকে ১২ জন একযোগে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। মাত্র ১০ গজ দূরেই দাঁড়ানো নয়ন বন্ডের সামনে আনা হলে প্রথমে রিফাতের গায়ে ঘুষি দেয় নাঈম। ঠিক ওই মুহূর্তে নয়ন ও অন্যরা এলোপাতাড়ি মারধর করতে থাকে। এ সময় তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল আরও ৭ থেকে ৮ জন। নয়নের সামনে ছেড়ে দিয়েই রিফাত ফরাজী ও তানভীর দৌড়ে কলেজের পূর্ব পাশের সীমানা দেয়ালের পরের গলিতে চলে যায়। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে উভয়ে ফিরে আসে।
এদিকে রিফাত শরীফকে অন্যরা মারধর করতে থাকে ও রিশান রিফাতের কোমর ধরে টেনে দেয়ালের পাশে নিয়ে যায়। মুহূর্তেই রিফাত ফরাজী রামদা দিয়ে কোপাতে শুরু করে ও নয়নের হাতে অপর একটি রামদা তুলে দেয়। দুজনে এলোপাতাড়ি কোপানোর সময় মিন্নি কখনো নয়ন আবার কখনো রিফাত ফরাজীকে নিবৃত্ত করতে চেষ্টা করে। মিন্নি নয়নকে বাধা দেয়ার সুযোগে রিফাত ফরাজী কোপাতে থাকে আর রিফাতকে বাধা দেয়ার সময় নয়ন কোপাতে থাকে। কোপানোর সময় রিশান, রাব্বি আকন ও তানভীর ঘিরে রাখে রিফাত শরীফকে, যাতে দৌড়ে পালাতে না পারে। এ সময় অন্যরা আশেপাশে দাঁড়িয়ে কোপানোর দৃশ্য দেখতে থাকে। মাত্র দুই মিনিটে কিলিং মিশন শেষ করে যে যার মতো চলে যায়।
রিফাত শরীফ হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত ১২ আসামির মধ্যে ৬ জন এখনো গ্রেফতার হননি। হত্যাকাণ্ডের নতুন ভিডিও ফুটেজে আরও একজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে, যাকে মামলার আসামি করা হয়নি।
পুলিশের তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, এজাহারভুক্ত প্রধান আসামি সাব্বির আহম্মেদ ওরফে নয়ন বন্ড পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। এর বাইরে এজাহারভুক্ত আসামি রিফাত ফরাজী, চন্দন, হাসান, অলিউল্লাহ ও টিকটক হৃদয় গ্রেফতার হয়েছে। এজাহারভুক্ত বাকি ছয়জন এখনো গ্রেফতার হয়নি। তারা হলো রিশান ফরাজী, মুসা, রাব্বি আকন, মোহাইমিনুল ইসলাম ও রায়হান।
এজাহারভুক্ত আসামি ছাড়াও সন্দেহভাজন হিসেবে সিসিটিভি ফুটেজে শনাক্ত করে আরও পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা হলো কামরুল হাসান, সাগর, তানভীর, রাফিউল ইসলাম রাব্বি ও নাজমুল ইসলাম। গ্রেফতারদের মধ্যে ছয়জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। এই ছয়জন হলো- সাগর, চন্দন, মো. হাসান, অলিউল্লাহ ও তানভীর হাসান।
এর বাইরেও ভিডিও ফুটেজে নতুন করে আরও অনেককে অংশ নিতে দেখা গেছে। তবে এদের অনেকেই ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। বিশেষ করে বরগুনা সরকারি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক ২য় বর্ষে অধ্যয়নরত নাঈম নামের একজন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঘটনায় জড়িত ছিল। এই নাঈমকেই প্রথমে রিফাত শরীফের শরীরে আঘাত করতে দেখা যায়। কিন্তু সে মামলার আসামিও হয়নি, সন্দেহভাজন হিসেবে আটকও হয়নি।
এ বিষয়ে বরগুনার পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন বলেন, গ্রেফতার আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের তথ্য ও মামলার এজাহারে অনেক মিল রয়েছে। আমরা এজাহারভুক্তই শুধু নয়, এ ঘটনায় জড়িত সবশেষ ব্যক্তিটিকে আইনের আওতায় আনবো। এজাহারভুক্ত অনেকেই গ্রেফতার না হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের নজরদারির বাইরে কেউ নেই, আমরা মূলত সব আসামিকে গ্রেফতারের স্বার্থেই একটু সময় নিচ্ছি।
রামদা খুঁজে বের করে দিলো রিফাত ফরাজী
রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যায় ব্যবহৃত একটি রামদা উদ্ধার করেছে পুলিশ। গতকাল সোমবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বরগুনার সরকারি কলেজ ক্যান্টিনের পূর্ব পাশের ডোবা থেকে রামদাটি উদ্ধার করা হয়। এই রামদাটি দিয়েই রিফাত শরীফকে প্রকাশ্যে কোপানো হয়।
এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও বরগুনা সদর থানার ওসি (তদন্ত) মো. হুমায়ুন কবির জানিয়েছেন, সকালে রিফাত ফরাজীকে সঙ্গে নিয়ে তার দেখানো ডোবা থেকে রামদাটি উদ্ধার করা হয়েছে।
এদিকে গতকাল সোমবার ভোর সাড়ে ৪টার দিকে রিফাত শরীফ হত্যায় জড়িত অভিযোগে আরিয়ান শ্রাবণ নামে একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার বাসা বরগুনার বাজার সড়কে। সে বরগুনা শহরের গোলাম সরোয়ার সড়কের মো. ইউনুস সোহাগের ছেলে।
শ্রাবণকে নিয়ে এ মামলায় এখন পর্যন্ত ১১ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। প্রধান আসামি নয়ন বন্ড বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। এ ছাড়া এজাহারভুক্ত ৩ জনসহ ৬ জন হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। বাকি ৪ জনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।
আসামিদের জবানবন্দি ও রিমান্ড
গত ১লা জুলাই আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় অভিযুক্ত ১১ নম্বর আসামি মো. অলিউল্লাহ অলি ও ভিডিও ফুটেজ দেখে শনাক্ত করা তানভীর একই আদালতে স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। এরপর গত ৪ঠা জুলাই রিফাত হত্যা মামলার ৪ নম্বর আসামি চন্দন ও ৯ নম্বর আসামি মো. হাসানও একই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। ৫ই জুলাই একই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডের ফুটেজ দেখে শনাক্ত হওয়া ও তদন্তে বেরিয়ে আসা অভিযুক্ত মো. সাগর ও নাজমুল হাসান। এ ছাড়াও এ মামলার দ্বিতীয় আসামি রিফাত ফরাজী সাতদিনের এবং ১২ নম্বর আসামি টিকটক হৃদয়সহ সন্দেহভাজন অভিযুক্ত সাইমুন ও রাফিউল ইসলাম রাব্বি পাঁচদিনের রিমান্ডে রয়েছে।
মিন্নিকে নিয়ে অপপ্রচার, পরিবার অবরুদ্ধ, ভয়ে ভাইবোন স্কুলে যাচ্ছে না
রিফাত শরীফকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার ঘটনার পর তার স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে ইঙ্গিত করে বরগুনা-১ এর সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর ছেলে ও জেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক সুনাম দেবনাথ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন। ওই পোস্টে তিনি বলেছিলেন, ‘বিভিন্ন খবর ও মিডিয়াতে যাকে এখন হিরো বানানো হচ্ছে মূল ভিলেন সে নিজেও হতে পারে, রিফাত শরীফের বন্ধুদের থেকে এখন পর্যন্ত যা জানা গেছে তাতে এটাই বোঝা যায়।’
সুনাম দেবনাথের এমন পোস্ট দেয়ার পর বখাটেরা মিন্নির বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে অপপ্রচার যুদ্ধে নেমেছেন। যদিও সমালোচনার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে সুনাম দেবনাথ আপত্তিকর অংশ মুছে ফেলেছেন। এমনকি সংসদ সদস্যপুত্র সুনাম দেবনাথ নতুন করে স্ট্যাটাস দিয়ে মিন্নির পক্ষে সাফাইও গেয়েছেন। তাই বলে বখাটেরা দমে যায়নি। তাদের অপপ্রচার যুদ্ধে স্বামীহারা মিন্নি এখন অনেকটাই বাকরুদ্ধ। নিজের ঘরেই অবরুদ্ধ তিনি এবং তার পরিবারের সদস্যরা।
এ বিষয়ে বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক সুনাম দেবনাথ বলেন, ‘রিফাত খুনের ঘটনায় আমি খুবই মর্মাহত। সেই আবেগ থেকে অনেক স্ট্যাটাস দিয়েছি। ৩০শে জুন যে স্ট্যাটাসটি দিয়েছিলাম, তার একটি অংশ কীভাবে যেন ডিলিট হয়ে গেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘অপপ্রচার নিয়ে মিন্নির একটি নিউজও আমি শেয়ার করেছি।’
এদিকে মিন্নির পরিবারের নিরাপত্তায় বরগুনা শহরের পুলিশ লাইন এলাকায় তার বাসায় পুলিশ মোতায়েন করা রয়েছে। গত শুক্রবার থেকে তার বাসায় পুলিশের ৩টি ডিউটি পোস্ট বসানো হয়েছে। পুলিশের এ পদক্ষেপ নেয়ার পর মিন্নি নিরাপদে আছেন। তবে তাকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার চলছে।
অপরদিকে, ঘটনার ১২ দিন অতিবাহিত হলেও শুধু মিন্নি নন, তার পরিবারের সদস্যরা অবরুদ্ধ অবস্থায় রয়েছেন। অপপ্রচারের ভয়ে পরিবারের কোনো সদস্যই ঘরের বাইরে যেতে পারছে না। অপপ্রচার এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে বাইরে বের হলে তারা হামলারও শিকার হতে পারে। এমন আশঙ্কার কারণে মিন্নির ভাইবোন স্কুলেও যাচ্ছে না।
মাত্র দুই মাস আগে রিফাতের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল মিন্নির। তার সামনেই স্বামীকে কোপানো হয়েছিল। স্বামীকে হারিয়েছেন। স্বামীকে হত্যার ঘটনার সঙ্গে অপপ্রচারের বিষয়টি যুক্ত হওয়ায় মিন্নি মানসিকভাবে অনেকটা ভেঙে পড়েছেন। মিন্নির চোখে- মুখে বিষাদের ছায়া। মাঝে মাঝেই বিড়বিড় করে কথা বলেন। মিন্নি জানান, আমার স্বামীকে চোখের সামনে ওরা মেরে ফেললো। আমাকেও ওরা বাঁচতে দেবে না। যেভাবে আমার বিরুদ্ধে ওরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার চালাচ্ছে, তাতে করে আমাকেও ওরা মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবে। একদিকে স্বামী হারানোর কষ্ট, অন্যদিকে আমাকে নিয়ে অপপ্রচার, এর থেকে আমার মৃত্যুই ভালো।
মিন্নির বাবা মোয়াজ্জেম হোসেন কিশোর বলেন, আমাদের বাড়িতে পুলিশের ৩টি ডিউটি পোস্ট বসানো হয়েছে। মোতায়েন করা হয়েছে বাড়তি পুলিশ। বাসার পেছনে পুলিশের অস্থায়ী ক্যাম্প বসানো হয়েছে। সেখানে ১০ জন পুলিশ সব সময় দায়িত্ব পালন করছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমার পরিবার নিয়ে এতটাই অপপ্রচার চালানো হচ্ছে যে, জনরোষের ভয়ে আমরা বাইরে যেতে ভয় পাচ্ছি। ঘটনার পর থেকে আমার ছেলেমেয়েরা ভয়ে স্কুলে যাচ্ছে না। অপপ্রচারের কারণে মিন্নির শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়স্বজনরাও বলতে গেলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা বন্ধ করে দিয়েছেন।