অভিভাবক মাত্রই অসচ্ছল নয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাত্রই সচ্ছল নয় - দৈনিকশিক্ষা

অভিভাবক মাত্রই অসচ্ছল নয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাত্রই সচ্ছল নয়

মো. রহমত উল্লাহ্ |

কোভিড-১৯ এর প্রভাবে মধ্যমার্চ থেকে বন্ধ হয়ে আছে কোটি কোটি শিক্ষার্থীর প্রেণিপাঠ। শিক্ষার্থীরা যেহেতু প্রতিষ্ঠানে যেতে পারছে না, ক্লাস করতে পারছে না সেহেতু অভিভাবকেরা টিউশন ফি দিতে অনিহা দেখাবেন এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া সকল অভিভাবকের স্বাভাবিক আয়-রুজির পথও সচল নেই আগের মতো। এরই মধ্যে শিক্ষা বোর্ড এখন টিউশন ফি আদায়ে অভিভাবকদের চাপ প্রয়োগ না করার জন্য একটি আদেশও দিয়েছে। এর ফলে অনেক অভিভাবক মনে করছেন, এই সময়ের বেতন-ফি আর কখনো দিতে হবে না তাদের। এমতাবস্থায় শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি আদায় না হওয়ার কারণে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত আয় বন্ধ থাকায় অনেক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারী প্রতিষ্ঠান অংশের বেতন-ভাতা নিয়মিত পাচ্ছেন না। প্রতিষ্ঠান বলছে, আমরা টিউশন ফি না পেলে বেতনভাতা দিবো কীভাবে? 

দৈনিক শিক্ষাসহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের সংবাদ থেকে জানা যায়, করোনায় দিশেহারা লাখ লাখ বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী। তারা এখন  সরকারি প্রণোদনা দাবি করছেন বা করতে বাধ্য হচ্ছেন। আশা করি সেই দাবির প্রতি কম/বেশি সহানুভূতি দেখাবে সরকার। এক্ষেত্রে আলোচনার দাবি রাখে বেশ কিছু বিষয়। 

আজ দেশর সব বেসরকারি শিক্ষক বেতনভাতা বঞ্চিত হবেন কেনো? সব প্রতিষ্ঠানের সচ্ছলতা/ অসচ্ছলতা তো সমান হবার কোন যুক্তিযুক্ত কারণ নেই। অনেক এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে আংশিক ননএমপিও/ চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক থাকলেও বিপুল শিক্ষার্থী ও ফি এর হার বেশি থাকায় তারা বেশ সচ্ছল। এমন অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে যাদের টিউশন ফি ছাড়াই স্থায়ী সম্পত্তি থেকে বিপুল আয় হয়। আবার এমনও স্কুল/ কলেজ/ মাদ্রাসা আছে যেগুলো কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান/ সংস্থা কর্তৃক বিশেষভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানও শিক্ষকদের বেতন দিবে না বা দিতে পারবে না বলে প্রণোদনার জন্য রাস্তায় ঠেলে দিবে তাতো মেনে নেওয়া যায় না কোনভাবেই। মনে হয় তারাও সুযোগ নিচ্ছেন। যে শিক্ষকগণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান হাতিয়ার, যাদের নামমাত্র বেতনভাতা দিয়ে প্রতিষ্ঠান চালিয়ে আয় করা হয় বছরের পর বছর তাদের আপদকালে অন্তত ৬ মাসের বেতনভাতা দেওয়ার মতো ব্যাকআপ ফান্ড তৈরি করে পৃথকভাবে ব্যাংকে খাটিয়ে রাখা তো পরিচালনাকারিদের দায়িত্ব। এটি প্রতিষ্ঠানের অর্থ ব্যস্থাপনার বড় দিক। সব প্রতিষ্ঠানে সম্ভব না হলেও সচ্ছল/বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি মাসের সব আয় উজার না করে কিছু কিছু করে সঞ্চয় করেই তা করা সম্ভব; যা করেছে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান। এতে প্রতিষ্ঠানের কোন ক্ষতি নেই। আপদ কালে না পড়লে এই ফান্ডের টাকা প্রতিষ্ঠানেই থেকে যায়। শিক্ষকদের স্বার্থে এইরূপ আপদকালীন ফান্ড গঠনের সরকারি আদেশ থাকা উচিত। তদুপরি সরকারের কাছে পরিস্কার থাকা উচিত প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের ও শিক্ষকের আয়, ব্যয়, দায়, জমা ও সম্পদের আপডেট ডাটা।

বিভিন্ন যৌক্তিক কারণে যে সকল স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা বর্তমান বাস্তবতায় শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে টিউশন ফি আদায় করতে না পারায় এবং ফান্ডে টাকা না থাকায় শিক্ষকদের বেতনভাতা দিতে পারছে না তাদের বিষয়টি অবশ্যই ভাবতে হবে। কেননা, শিক্ষকগণের প্রাইভেট টিউশনিও এখন বন্ধ হয়ে আছে। যদিও সকল শিক্ষক টিউশনি নির্ভর নয় এবং সমান সচ্ছল/ অসচ্ছল নয়। তথাপি বেতনভাতা পাওয়া শিক্ষকগণের অধিকার। তারা ইচ্ছে করে ঘরে বসে আছে তা তো নয়। এভাবে কতদিন থাকতে হবে তাও এখন অনিশ্চিত।

এমতাবস্থায় শিক্ষকদের বেতনভাতা প্রাপ্তির স্বার্থে শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে টিউশন ফি আদায় করা না করার বিষয়ে পরিস্কার সিদ্ধান্ত থাকা প্রয়োজন। এই আপদকালে অভিভাবকদেরও সামান্য সহমর্মিতা থাকা উচিত নিজ নিজ সন্তানের শিক্ষকগণের প্রতি। একের বোঝা, সবার লাঠি। অনেক অভিভাবক অসচ্ছল থাকলেও সকল প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সকল অভিভাবক অসচ্ছল তা বলা যাবে না। আবার সকল অভিভাবকের ওপর করোনার বিরূপ প্রভাব সমান নয়। যেমন, অতি ধনীরা সামান্য টিউশন ফি না দেওয়ার মতো অনটনে পড়েননি। যেসব অভিভাবক সরকারি অথবা বড় বড় বেসরকারি/প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে বা সংস্থায় কর্মরত তাদের আয় আগের মতই আছে। যারা মেডিসিন ও অন্যান্য আবশ্যকীয় নিত্য পণ্যের ব্যবসা করেন তাদের লাভ কমেনি। যাদের সন্তান ইংলিশ/ প্রাইভেট স্কুল-কলেজে পড়ান তারা তুলনামূলক সচ্ছল। যারা গ্রামীণ কৃষি নির্ভর জীবনযাপন করেন তাদের অভাব ক্ষুদ্র কর্মজীবীদের মত তীব্র হয়নি এখনো। একজন কৃষি শ্রমিকের একদিনের মজুরি কম/বেশি ৬ শ টাকা বলেই ধান কাটতে এতো আয়োজন। অথচ তার সন্তানের গ্রামের স্কুলের সারা মাসের টিউশন ফি কম/বেশি ৩ শ টাকা মাত্র। এসব বাস্তবতায় সচ্ছল ও অসচ্ছল  সবার সন্তানের সম্পূর্ণ টিউশন ফি স্থগিত/ মওকুফ করে দিয়ে শিক্ষকগণের বেতনভাতা পাওয়ার রাস্তা বন্ধ করে দিতে হবে এটি মোটেও যুক্তিযুক্ত নয়। কোন্ অভিভাকের পেশা কী, মাসিক আয় কত, আর্থিক অবস্থা কেমন তা সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কম/বেশি জানা থাকে এবং সেভাবেই তারা ফ্রি/ হাফ-ফ্রি দিয়ে থাকে; যে সংখ্যাটি খুব বেশি নয়। দরিদ্র অভিভাবকদের সহায়তায় শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি বা বিশেষ বৃত্তি দেওয়াতেই সুফল অধিক। তারা অল্পতেই অধিক তুষ্ট ও উৎসাহিত হয় এবং তা মনে রাখে ও প্রতিদান দিতে সচেষ্ট হয়। সরকারের পাশাপাশি ধনাঢ্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসতে পারে এক্ষেত্রে।              
      
অন্য একটি বাস্তবতা হচ্ছে, তথাকথিত ভালো প্রতিষ্ঠানগুলো নির্ধারিত ফি ঠিকই আদায় করে নেবে। কেননা, অভিভাবকগণ তাদের সন্তানদের ভর্তি সেখানে টিকিয়ে রাখার জন্যই চুপচাপ তা দিয়ে দিবেন। হয়তো সেই কৌশল এখনো চলমান। তদুপরি তারা সরকারি সুবিধা নেওয়ার চেষ্টায় আছেন বা থাকবেন। যদিও এই উভয় সুবিধা সংশ্লিষ্ট শিক্ষকগণ পাবেন কিনা তা অনিশ্চিত। তবে বেকায়দায় পড়বে/ পড়েছে সেইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যাদের এমনিতেই শিক্ষার্থী খুঁজে আনতে হয় এবং ফ্রি-হাফফ্রি দিয়ে বিভিন্ন কৌশল করে ধরে রাখতে হয়। তদুপরি শিক্ষা বোর্ডের আদেশের কারণে এখন টিউশন ফি চাইতেই পারছে না কারো কাছে। তারা ধরেই নিয়েছে যে পরবর্তীতে এই বকেয়া ফি আর আদায় করা সম্ভব হবে না এবং বেতনভাতা পাওয়া যাবে না। তাই এখন সরকারি সহায়তার জন্য মরিয়া হতে বাধ্য হয়েছেন। অবস্থা ও অবস্থান ভেদে সারাদেশের বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদরাসা পরিচালনায় দীর্ঘদিনের সৃষ্ট ও চলমান একটি প্রক্রিয়ার ভেতরে যেয়ে সরকার যদি সকল শিক্ষার্থীর এক বা একাধিক মাসের সম্পূর্ণ বা আংশিক টিউশন ফি আদায় করতে নিষেধ করে, তো সেই অনুপাতে বিভিন্নরকম প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগণের (এমপিওভুক্ত, নন-এমপিও ও চুক্তিভিত্তিক) বিচিত্র মাত্রার বেতনভাতা ও এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনার নানারকম ব্যয় ততদিন সরকারকেই নিয়মিত বহন করে তাদের সন্তুষ্ট করতে হবে, এটাই স্বাভাবিক। আর সেটি শিক্ষকদের সহায়তা নয় (পাওনা), দরিদ্র অভিভাবকদের পরোক্ষ সহায়তা; যা সরাসরি তাদের না দিয়ে শিক্ষকদের দেওয়া; যার নাম হওয়া উচিত বিশেষ ভাতা বা সম্মানী। সেজন্য শিক্ষকগণের মুখ খুলতে হবে কেনো? করোনার এই বিশেষ ছুটিকালে বেসরকারি, প্রাইভেট, দেশি, বিদেশি প্রায় সকল প্রতিষ্ঠানের কর্মীরাইতো নিয়মিত বেতনভাত পাচ্ছেন। তাহলে বেসরকারি শিক্ষকগণ বেতনভাতা না পেয়ে সহায়তা/ প্রণোদনা পাবেন কেনো?

লেখক: মো. রহমত উল্লাহ্, অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, তাজমহল রোড, মোহাম্মদপুর, ঢাকা। 

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0090751647949219