ভিকারুননিসা নূন স্কুলের ছাত্রী অরিত্রী অধিকারীর আত্মহননের ঘটনা আমাদের তুমুলভাবে আলোড়িত করেছে। পরীক্ষার হলে মোবাইল ফোন নিয়ে যাওয়ার কারণে মেয়েটিকে স্কুল থেকে টিসি দেয়ার হুমকি দেয়া হয় এবং স্কুলটির শিক্ষকরা ওর মা-বাবাকে ডেকে মেয়ের সামনেই অপমান করেছিলেন বলে অভিযোগ।
মা-বাবার অপমান সইতে না পেরে অরিত্রী বাসায় ফিরে নিজের ঘরে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে। এটি খুবই দুঃখজনক ও হৃদয়বিদারক একটি ঘটনা।
ঘটনাটি বিশ্লেষণ করা যাক। জাতি হিসেবে আমরা খুবই আবেগপ্রবণ। প্রথমত, স্কুলের শিক্ষকরা মেয়েটির মা-বাবাকে ডেকে এনে তিরস্কার করেছেন। সেটা কীভাবে করেছেন, কেন করেছেন, সে ব্যাপারে আমরা কতটা জানি? দ্বিতীয়ত, একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়মকানুন কোনো ছাত্রছাত্রী যদি ভঙ্গ করে, আইন অমান্য করে- তার জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা থাকে। এর মানে এই নয় যে, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা এমন পর্যায়ে যাবে, কোনো শিক্ষার্থী আত্মহনন করবে।
মেয়েটি নবম শ্রেণিতে পড়ত। তার বয়স ছিল ১৪-১৫ বছর। সুতরাং মেয়েটি সবকিছুই বুঝত। সন্তানরা মা-বাবাকে খুব ভালোবাসে, সম্মান করে। মা-বাবা অপমানিত হলে সন্তানরা অপমানিত হয়। সেখানে এটিই ঘটেছে। স্কুল কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীকে ডেকে বকা দিতে পারত। যেটা শুনেছি, মেয়েটি মোবাইল নিয়ে পরীক্ষার হলে ঢুকেছিল। মোবাইল ফোন নিয়ে পরীক্ষার হলে প্রবেশ নিষেধ আছে। নকল করে ধরা পড়ার কারণে পরীক্ষা বাতিল করতে পারত। এ পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু মা-বাবাকে ডেকে রীতিমতো অপমান করা মোটেও ঠিক হয়নি। শিক্ষকদেরও দায়িত্ব আছে। মেয়েটি যেন এমন অপরাধ আর না করে, সেটি বোঝানো তাদের কর্তব্য ছিল।
আমার একটি অভিজ্ঞতার কথা বলতে চাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার হলে অনেক শিক্ষার্থী মোবাইল ফোনসহ ধরা পড়েছে, এমন ঘটনা অনেক ঘটেছে। মোবাইল ফোন রেখে দিয়েছি। এমনও হয়েছে দ্বিতীয় বর্ষে মোবাইল ফোনসহ ধরেছি, ফাইনাল ইয়ার পরীক্ষা দিয়ে অনেক অনুনয়-বিনয় করে মোবাইলটি ফেরত নিয়ে গেছে। শাস্তির তো অনেক ধরন আছে। কিন্তু ভিকারুননিসার ছাত্রী অরিত্রীর বেলায় সেটা এমন পর্যায়ে গিয়েছে যে তাতে শিক্ষার্থীর আঁতে ঘা লেগেছে। আমরা যারা শিক্ষকতা করি, এসব ব্যাপারে আরও অনেক সতর্ক হতে হবে।
জীবনের গুরুত্ব অনেক। জীবন অনেক সুন্দর, অনেক মর্যাদার। জীবন যাওয়া যত সহজ, পাওয়া তত সহজ নয়। তাই আত্মহত্যাকে কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না। এটি সমস্যা থেকে বাঁচার কোনো পথ হতে পারে না। ১৪-১৫ বছরের কিশোরী অরিত্রীর মনে স্বভাবসুলভ চপলতা, বয়সজনিত আবেগের আতিশয্যের তীব্রতায় হয়তো চাপা পড়েছিল মৃত্যু নিয়ে গভীর কিছু ভাবার উপলব্ধি। যুক্তি নয়, ওর কাছে বড় হয়ে উঠেছিল আবেগ-অভিমান। এর পরিণতিতে যা ঘটেছে, তা ভয়ংকর।
এখন যেটা হয়েছে, প্রত্যেক পরিবারে ছেলেমেয়ে অনেক কম, এক বা দু’জন। ওরা অনেক আদরে বড় হয়। আগের দিনে চার-পাঁচজন, এমনকি সাত-আটজন ছেলেমেয়ে থাকত। মা-বাবা বকত কী বকত না, তা গায়ে মাখত না। এক-দু’জন হওয়ায় আজকালকার ছেলেমেয়েরা এত সেনসেটিভ হয়ে গেছে যে, একটু জোরে কথা বললেও ওরা মনে করে তাকে বকাবকি করা হচ্ছে। আগের সময়ের শিশুরা মা-বাবা ছাড়াও চাচাতো-মামাতো মিলে অনেক ভাইবোন, খালা-ফুপু, দাদা-দাদি, নানা-নানিসহ অনেক নিকটজন পেত, যারা তাদের কোনো না কোনোভাবে পাশে থাকত। তাই তারা ভেঙে পড়ত কম।
কিন্তু এখনকার শিশুরা ফ্ল্যাটবন্দি। সমস্যার কথা খুলে বলার মানুষ কই তাদের আশপাশে? মা-বাবাও ব্যস্ত চাকরি-ব্যবসা-সামাজিকতা নিয়ে। এ বাস্তবতাটা বুঝতে হবে। এ সময়ে নরম কাদামাটিকে শক্ত করে গড়তে হলে বুঝিয়ে, মায়া দিয়ে, ভালোবেসে বড় করতে হবে। আর এখানে শিক্ষকদের অনেক দায়িত্ব আছে। কোমলমতি শিশু-কিশোরদের নরম মনটা মা-বাবাকে লালন করতে হয়। বিদ্যালয়ে যাওয়া শুরু করলে ওদের গড়ে তোলার দায়িত্ব নেয় শিক্ষক। এ কারণেই শিক্ষকদের বলা হয় ‘মানুষ গড়ার কারিগর’।
কথায় কথায় ছেলেমেয়েরা আত্মহননে যাবে, এটা হতে পারে না। এ বিষয়টি মা-বাবাকে বোঝাতে হবে। এ ক্ষেত্রে স্কুল শিক্ষকদেরও দায়িত্ব আছে। জীবন একটাই, এটা উপভোগ করার বিষয়। আমি নিজেকে শেষ করে দিলাম, এটা হয় না।
ছেলেমেয়েদের ভেতরে এই আকাক্সক্ষা জাগাতে হবে যে, জীবন অনেক সুন্দর। তুমি বেঁচে থাকলে সামনের দিনগুলোতে অনেক কিছু দেখতে পাবে। আমি ছোটবেলায় কম ঘুমাতাম। আমার মনে হতো, ঘুমানোর সময়টাতে পৃথিবীতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটলে আমি দেখতে পারব না। এ বিষয়গুলো যদি কোমলমতি ছেলেমেয়েদের বোঝানো যায়, তাহলে এমনটি হবে না। একশ্রেণীর মানুষের মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা আছে। তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা থাকে। সেগুলোর ক্ষেত্রেও ট্রিটমেন্ট আছে।
শুধু ভিকারুননিসা নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন হতাশাগ্রস্ত ছাত্রছাত্রীও সাম্প্রতিক সময়ে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে। ছেলেমেয়েদের বলব, এত সহজে হতাশাগ্রস্ত হওয়া যাবে না। কোনো কিছুতেই জীবন শেষ হয়ে যায় না, জীবন অনেক সম্ভাবনাময়।
বিভিন্ন পর্যায়ে আমরা যারা অভিভাবক, শিক্ষক রয়েছি, আমাদের উচিত তাদের কাউন্সেলিং করা। আমি মনে করি, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একজন করে সাইকিয়াট্রিস্ট বা কাউন্সেলর থাকা উচিত। সপ্তাহে পালা করে একদিনে এক এক ক্লাসে গিয়ে তিনি বোঝাবেন, আলোচনা করবেন। আমাদের সমস্যাটা হল প্রয়োজনীয় লোকবল নেই। আমাদের বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়েও সাইকিয়াট্রিস্ট নেই। আমরা নিয়োগ দেব, পাচ্ছি না।
বরিশাল মেডিকেল কলেজেও সাইকিয়াট্রিস্ট নেই। এটি যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তা অনুধাবন করে না। সবার পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড এক নয় যে, সবাই ঘর থেকে শিখে আসবে। স্কুল কেবল পুঁথিগত পাঠদানের জায়গা নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য কমিউনিটির মধ্যে শিক্ষাদান। জীবন, দর্শন, সমাজ- সব বিষয়ে শেখানোর দায়িত্ব প্রতিটি স্কুলের। আমাদের এ বিষয়ে ভাবতে হবে।
এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো হয়ে গেছে বাণিজ্যিক। ছাত্রছাত্রীরা প্রায়ই অভিযোগ করছে, শিক্ষকরা ক্লাসে ঠিকমতো পড়ান না। প্রাইভেট-কোচিংয়ে পড়তে বাধ্য করেন। গভর্নিং বডির সদস্যদের দায়িত্ব এসব দেখভাল করা। গভর্নিং বডি-শিক্ষকরা মিলেমিশে যদি বাণিজ্য শুরু করে তাহলেই সমস্যা। আমিও ঢাকার একটি খ্যাতনামা স্কুলের গভর্নিং বডিতে ছিলাম। স্রোতের বিপরীতে যাওয়ার কারণে আমার বিরুদ্ধে নালিশও করা হয়েছিল। সুতরাং শক্ত হাতে এগুলো বন্ধ করতে হবে, তা না হলে এর সমাধান হবে না।
একটি সাধারণ প্রবণতা হল, নিজেদের দোষ ঢাকতে আমরা অন্যের ওপর দোষ চাপাই। অরিত্রীর আত্মহত্যার জন্য কি কেবল শিক্ষকরাই দায়ী? এতে সমাজের দায় আছে, অভিভাবকরাও এর দায় এড়াতে পারেন না। শিক্ষকদের আরও ধৈর্যশীল, সহনশীল হতে হবে।
শিক্ষার্থী আর অভিভাবকদের সঙ্গে প্রভুত্বসুলভ নয়, বন্ধুসুলভ আচরণ করতে হবে। অভিভাবক ও শিক্ষকদের বলব, জীবন মানে শুধু পরীক্ষায় প্রথম হওয়া নয়। কোনো বিষয়ে খারাপ করলেই আমরা ছেলেমেয়েদের বকাবকি করি, অন্যের সঙ্গে তুলনা করি। জিপিএ-৫-এর ইঁদুর দৌড়ে আমরা দাঁড় করিয়ে দিই কোমলমতি ছেলেমেয়েদের। এর ফল কখনও ভালো হতে পারে না। কেবল ফার্স্ট-সেকেন্ডরাই সফল হয় বিষয়টি এমন নয়।
সবাইকে জজ-ম্যাজিস্ট্রেট-ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে কেন? যার যেদিকে আগ্রহ, সে সে বিষয়েই সবচেয়ে ভালো করতে পারে, সুনাম বয়ে আনতে পারে। স্কুল, প্রাইভেট টিউটর আর কোচিংয়ের পেছনে দৌড়াতে গিয়ে জীবনের সবচেয়ে বড় সত্যটাই তারা জানতে পারছে না। জীবন মানে শুধু ইঁদুর দৌড় নয়, পুঁথিগত বিদ্যা অর্জন নয়। এর বাইরেও অনেক বড় জগৎ আছে। জীবন অনেক সুন্দর।
লেখক : উপাচার্য, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়; সাবেক চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ
সৌজন্যে: যুগান্তর