অরিত্রী অধিকারীর পিতা-মাতাকে কী ভাষায় সান্ত্বনা ও সমবেদনা জানাব তা আমার জানা নেই। অরিত্রী ছিল ভিকারুননিসা নূন স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্রী। সোমবার ৩ ডিসেম্বর সে নিজ বাসায় গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। অরিত্রী যে বয়সের মেয়ে, সে বয়সে মেয়ে হোক কিংবা ছেলে হোক, তারা থাকে খুব অভিমানী ও আবেগপ্রবণ। সুতরাং এ বয়সের ছেলেমেয়েদের কী অভিভাবক, কী শিক্ষক কিংবা মুরব্বিজন সবাইকে এদের ব্যাপারে হতে হয় সংবেদনশীল। যেসব কারণে এরা মনে দুঃখ পেতে পারে, বেদনাহত হতে পারে অথবা হতে পারে অভিমানকাতর, সেসব ব্যাপারে সবাইকে হতে হবে অত্যন্ত সাবধানী। আমাদের একটি ধারণা আছে, পরিণত বয়সের নয় বলে শিশুদের আবেগ-অনুভূতি থাকে না। কিন্তু এ ধারণা খুবই ভ্রান্ত। আধুনিক মনস্তত্ত্ববিদরা মনে করেন, শিশুদের আবেগানুভূতির প্রবণতা মাতৃগর্ভেই শুরু হয়। যে মা সন্তান ধারণ করেন তিনি যদি সেই সময় বিষণ্ণতা কিংবা অন্য কোনো ধরনের মানসিক কষ্টে ভোগেন, তাহলে এর বিরূপ প্রভাব গর্ভে থাকা সন্তানটির ওপরও পড়ে। জন্ম গ্রহণের পর দেখা যায় এসব শিশু অন্য স্বাভাবিক শিশুর চেয়ে ভিন্নধর্মী। অনেক সময় এদের খুব নিশ্চুপ থাকতে দেখা যায়। অথচ যেসব শিশু মাতৃগর্ভে স্বাভাবিকভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়, তারা থাকে প্রফুল্লচিত্তে এবং তারা হাত-পা ছোড়াছুড়ি করে তাদের অস্তিত্বের জানান দেয়। পছন্দ-অপছন্দ সম্পর্কেও তারা কোনো না কোনোভাবে সরব হয়ে ওঠে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিশুদের আচরণেও পরিবর্তন দেখা দেয়। পরিবর্তনের বিভিন্ন ধাপে মাতা-পিতা, শিক্ষক-শিক্ষিকা ও বয়োজ্যেষ্ঠদের তাদের বিকাশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আচরণ করতে হয়। অন্যথায় এসব শিশু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এমন সব আচরণ করতে পারে যা সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। এজন্য পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে যারা পিতা-মাতা হতে যাচ্ছেন, তাদের Parenting নামক একটি বিষয়েও শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়। আমাদের দেশেও প্রবাদ আছে সন্তানের পিতা কিংবা মাতা হওয়া সহজ ব্যাপার নয়। শুধু জন্ম দিলেই পিতা-মাতা হওয়া যায় না। পিতা-মাতা হওয়া একটি বিশাল দায়িত্ব।
স্কুলের শিক্ষক কিংবা শিক্ষিকা হওয়ার জন্য অতিরিক্ত প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়। সে জন্যই স্কুল শিক্ষকদের হতে হয় প্রাইমারি ট্রেনিং অথবা বিএড পাস। শিক্ষাদান পদ্ধতি সম্পর্কে সর্বোচ্চ একাডেমিক ডিগ্রিটি হল পিএইচডি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবং পাশ্চাত্যের অন্যান্য উন্নত রাষ্ট্রে দেখা যায়, প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকরাও পিএইচডি ডিগ্রির অধিকারী। আমাদের দেশে প্রচলিত ধারণাটি হল কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই হবেন পিএইচডি। আমরা কেউ কল্পনা করতে পারি না কীভাবে প্রাইমারি স্কুল অথবা হাই স্কুলের শিক্ষকরা পিএইচডি হতে পারেন। তবে উন্নত দেশে এ পর্যায়ের শিক্ষকরাও পিএইচডি হতে পারেন এবং তা সাধারণত হয় শিক্ষাদান পদ্ধতির ওপর। শিক্ষক প্রশিক্ষণের যে ব্যবস্থা আমাদের দেশে প্রচলিত আছে, সেক্ষেত্রেও দেখা যায়, শিক্ষক ট্রেইনিদের Child Development বিষয়ে শিক্ষাদান করা হয়। এর উদ্দেশ্য হল বয়সভেদে শিশু-কিশোরদের আচরণ ও মানসিক বিকাশ সম্পর্কে তাদের সচেতন করে তোলা। দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, শিক্ষার প্রতিটি ক্ষেত্রের মতো শিক্ষক প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রেও ধস নেমেছে। একজন প্রশিক্ষণার্থীর যতটুকু তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক জ্ঞান থাকার কথা তার খুব সামান্য পরিমাণই থাকে এসব প্রশিক্ষণার্থীর। কাজেই কর্মক্ষেত্রে তারা এমন সব কাণ্ডকারখানা ঘটিয়ে বসেন যা একজন শিক্ষক বা শিক্ষিকার কাছ থেকে মোটেও কাম্য নয়।
দেশে অনেক স্কুল-কলেজ হয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যাও বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু শ্রদ্ধা করা যায় এমন শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা দিনে দিনে হ্রাস পাচ্ছে। একজন শিক্ষকের মূলমন্ত্র হল, মোরা শিক্ষক/ধরণীর মোরা দীক্ষক। দীক্ষা গুরু হওয়ার স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা ও ইচ্ছা না থাকলে শুধু মাসের শেষে একটি অংকের টাকা গুনতে পারার সুযোগের জন্য কারোরই শিক্ষক হওয়া উচিত নয়। এ কালের শিক্ষকরা শুধু বেতনের পয়সায় সন্তুষ্ট থাকতে পারে না। তাই দেখা যায় বার্ষিক ফি, উন্নয়ন ফি এবং কোচিং ফির নামে দেদার অর্থ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করতে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও আদালত থেকে এ ব্যাপারে বিপরীত নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও টাকা আদায়ের ফন্দিফিকির কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না। অরিত্রী রাজধানীর যে নামকরা স্কুলটির ছাত্রী ছিল সেই স্কুলের ছাত্রীরা গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, তাদের নাসায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলে কয়েক লাখ টাকা করে আদায় করা হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নাসায় যাওয়ার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। ছাত্রীরা এই অর্থ ফেরত চাইলে কর্তৃপক্ষ দেব দিচ্ছি করে ৩ বছর কাটিয়ে দিয়েছে। এখনও অনেকে এ টাকা ফেরত পায়নি। যদি কোনো শিক্ষক এর সঙ্গে জড়িত থাকেন, তাহলে তাদের শিক্ষক সমাজের কলঙ্ক হিসেবেই গণ্য করা যায়। এর জন্য বিচার চাওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু বিচার করলেই কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? যেসব শিক্ষক শিক্ষকতার মূল্যবোধ ও নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে লোভী কুলাঙ্গারে পরিণত হয়েছে বা পরিণত হতে যাচ্ছে, তাদের সৎ পথে কীভাবে ফেরানো যাবে? এটি একটি গভীর তাৎপর্যময় প্রশ্ন।
আমার মতো বয়সের লোকেরা যখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ত, তখন প্রাইমারি স্কুলগুলো পরিচালিত হতো জেলা স্কুল বোর্ডের অধীনে। জেলা স্কুল বোর্ড থেকেই শিক্ষকদের বেতন আসত। তবে তা ছিল খুবই অনিয়মিত। এসব শিক্ষকের মধ্যে যারা ম্যাট্রিক এবং গুরু ট্রেনিং পাস ছিলেন তারা সর্বসাকুল্যে বেতন পেতেন মাসিক ৮ টাকা মাত্র। দারিদ্র্যের মধ্যে থেকেও এসব শিক্ষক মনে করতেন তারা একটি মহান ব্রতে নিয়োজিত আছেন। তাদের কোনো ছাত্র যদি উচ্চশিক্ষায় সাফল্য অর্জন করত তাহলে এসব শিক্ষক আপন সন্তানের সাফল্যের চেয়েও অনেক বেশি গর্বিত ও তৃপ্ত হতেন। আমাদের ভেবে দেখা উচিত শিক্ষকদের মধ্য থেকে এমন চরিত্রগুলো হারিয়ে গেল কেন? কবি আশরাফ সিদ্দিকী তার সমকালের শিক্ষকদের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে ‘তালেব মাস্টার’ কবিতাটি লিখে কবি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ও শিক্ষকতার ব্রত সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘ধন চাহো তো তাহা হইলে এই পথে আসিও না। মান চাহো তো তাহা হইলে এই পথে আসিও। তিন্তিড়ি বৃক্ষের পত্র ভক্ষণ করত জীবন ধারণ করিতে চাহো, তাহা হইলে এই পথে আসিও।’ আজ গোটা সমাজ যখন দুর্বৃত্তায়িত হয়ে গেছে, তখন বিদ্যাসাগর মহাশয়ের এ উক্তি খুবই বেমানান ঠেকে। এখন কে না চায় সুখে থাকতে, আরাম-আয়েশে থাকতে। শিক্ষকরাও জীবনের আরাম-আয়েশের ন্যূনতম উপকরণাদি চাইবেন এ প্রত্যাশার বিরোধিতা করা নির্বুদ্ধিতার শামিল। সমাজ পরিবর্তিত হচ্ছে, মানুষের জীবনে বস্তুগত উন্নতিও হচ্ছে। এ অবস্থায় শিক্ষকরা সাধু-সন্ন্যাসীর জীবনে অভ্যস্ত থাকবেন এটা আশা করা সমীচীন নয়। তদুপরি ভোগবাদিতার প্রভাবে আমরা সবাই ভোগবাদের বন্যায় ভেসে যাওয়ার উপক্রম হয়েছি। জীবনের স্বাদগুলো প্রতিনিয়তই সাধ্যের সীমা অতিক্রম করে চলেছে। তাই বলে কি আমরা টলস্টয়ের সেই কথাটি ভুলে যাব, How much land a man requires? পাঠকের অবগতির জন্য বলছি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক একাডেমিতে নৈতিকতা শিক্ষার অংশ হিসেবে টলস্টয়ের এই লেখাটিও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো পুঁজিবাদী দেশেও নৈতিকতার এ শিক্ষা অপ্রাসঙ্গিক বা অবান্তর হয়ে গেছে বলে মনে করা হয়নি।
অরিত্রীর কী অপরাধ ছিল? শিক্ষকদের অভিযোগ, অরিত্রী নকল করার উদ্দেশ্যে মুঠোফোন নিয়ে পরীক্ষার হলে ঢুকেছিল। এক শিক্ষক এটা টের পেয়ে মুঠোফোনটি কেড়ে নেন। তিনি অভিভাবককে দেখা করতে বলে তাকে ফোনে জানান, অরিত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ফোন পেয়ে অরিত্রীর বাবা দিলীপ অধিকারী স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে সোমবার স্কুলে যান। অভিযোগের কথা শুনে অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষের কাছে হাত জোড় করে ক্ষমা চান তারা। কিন্তু তারা কোনো কথা না শুনে তাদের বের হয়ে যেতে বলেন। দিলীপ অধিকারী স্কুল থেকে বাসায় ফেরার আগেই অরিত্রী বাসায় চলে যায়। তিনি বাসায় ফিরে অরিত্রীকে গলায় ফাঁস দেয়া অবস্থায় উদ্ধার করেন। এরপর ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। শিক্ষকের হাতে নকল করার জন্য চিহ্নিত হয়ে অরিত্রী যে লজ্জা পেয়েছে তার চেয়ে শতগুণ বেশি মর্মাহত হয়েছে তার পিতা-মাতাকে অপমানিত হতে দেখে। কোনো সন্তানই পিতা-মাতার অপমান মেনে নিতে পারে না। অরিত্রী এ অপমানের অন্য কোনো প্রতিশোধের কথা ভাবতে পারেনি। সে প্রতিশোধ নিয়েছে নিজের ওপর। আত্মহত্যার মাধ্যমে সে তার প্রতিবাদ জানিয়ে গেছে।
অরিত্রীর আত্মহত্যায় ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজের ছাত্রী এবং অভিভাবকরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে। শিক্ষামন্ত্রীও সেখানে ছুটে গেছেন। তাদের শান্ত করার চেষ্টা করেছেন। তদন্ত ও বিচারের আশ্বাস দেয়া হয়েছে। কিন্তু যত তদন্ত বা আশ্বাস দেয়া হোক না কেন, অরিত্রী তো আর ফিরে আসবে না। এ জগৎ-সংসারের প্রতি চরম ধিক্কার জানিয়ে এবং এক বুক অভিমান নিয়ে অরিত্রী তার জীবনাবসান ঘটিয়েছে। আমরা কীভাবে সন্তানহারা পিতা-মাতাকে সান্ত্বনা দিতে পারি। অরিত্রীর পরকালটি হোক এমন নিবিড় শান্তির ঘুমের যে ঘুমে স্বপ্ন দেখাও শান্তির ব্যাঘাত ঘটাবে না।
লেখক: অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ
সূত্র: যুগান্তর