বহু আলোচিত অরিত্রীকে নিয়ে এখন বক্তৃতা-বিবৃতি-স্বীকৃতি ও লেখার ধুম চলছে। জনপ্রিয় লেখক-অধ্যাপক ক্ষমা চাইলেন প্রয়াত অরিত্রীর কাছে। ক্ষমা চাইলেন ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি গোলাম আশরাফ তালুকদার। আর এ ঘটনার খলনায়িকা তথা মূল গায়েন শ্রেণিকক্ষের শিক্ষক হাসনা হেনা তাঁর নির্দয় আচরণের কথা স্বীকার করে নিজের অনুতাপের কথা জানিয়েছেন কারাগার থেকে।
এখন যে যা-ই করুন, যে যা লিখুন—তাতে বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি-বিচ্যুতির প্রকাশ ঘটবে, আবার শিক্ষামন্ত্রীর ওপর চাপ তৈরি হবে; কিন্তু অভিমানী কিশোরী অরিত্রী তো আর ফিরে আসবে না। তার মা-বাবার শূন্য বুক ভরবে না। কন্যা হারানোর আর্তি হয়তো সময়ের বালুতে তাত্ক্ষণিক চাপা পড়বে। কিন্তু তা থেকে মা-বাবার হৃদয়গভীরে রক্তক্ষরণ ঘটাবে। এত কিছুর পরও পৃথিবী তার নিয়মমাফিক চলবে, চলবে বাংলাদেশের সমাজ। কিন্তু অরিত্রী ফিরবে না, এটাই নির্মম সত্য। ওর মা-বাবা অরিত্রীকে হারানোর কোনো সান্ত্বনা খুঁজে পাবেন না শুধু নিষ্ঠুর প্রকৃতির শিক্ষিকার একটি ভুলের জন্য। এঁরা শিক্ষকতার জন্য সম্পূর্ণ অযোগ্য। ক্রুদ্ধ আচরণে ভুল শোধরানো যায় না।
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ অভিজাত শিক্ষায়তনের অন্যতম। বলা হয়ে থাকে এখানকার শিক্ষার মান ও অন্যান্য দিকের কথা। বেশ কিছুদিন আগে অবশ্য এখানকার এক শিক্ষককে নিয়ে প্রকাশিত ন্যক্কারজনক ঘটনা দীর্ঘদিন সংবাদপত্রে খবরের খোরাক হয়েছিল। এ ছাড়া গভর্নিং বডি নিয়ে দেখা গেছে রাজনীতির নানা প্রভাব। সব কিছু মিলিয়ে চোখ ফেরাতে হয় মূল কেন্দ্র শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দিকে।
বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থার নানা দিক নিয়ে সমালোচনা কম হয়নি, আন্দোলনও কম হয়নি। কখনো বিক্ষোভে উত্তাল হয়েছে মহানগরীর রাজপথ। মূলত ছাত্র-ছাত্রীরা এসব আন্দোলনের ঘটক। এই তো কিছুদিন আগে কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলন—তাতেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা, বাসচাপায় ছাত্র-ছাত্রী হত্যা করার বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন, রাজপথে চরম অচলাবস্থা ঢাকায়, তাও ছাত্র-ছাত্রীদেরই উদ্যোগে।
সংবিত্হীন সমাজশক্তি—জনসাধারণ এসব ঘটন-অঘটন চেয়ে চেয়ে দেখে—কখনো তাতে যোগ দেয়। যখন যোগ দেয় তখন প্রবল গণবিস্ফোরণের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এবং তা চিরাচরিত সরকারি দমননীতিকে অগ্রাহ্য করে। তেমন ক্ষেত্রেই আসে সাফল্য। অর্জিত হয় লক্ষ্য।
দুই.
এতটা ব্যাপক ভিত্তিতে না হলেও অরিত্রীর ট্র্যাজিক ঘটনা নিয়ে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ক্ষুব্ধ ছাত্র-ছাত্রীরা রাজপথে নামে প্রতিবাদ মিছিলে এবং তা যথেষ্ট সাড়া জাগায়। দৈনিক পত্রিকাগুলোতে আন্দোলনের ওপর বড় বড় শিরোনাম—‘বিক্ষোভে উত্তাল স্কুল/তোপের মুখে নাহিদ’। ছাত্র-ছাত্রীরা প্রতিবাদ জানাতে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দেয়। বিপাকে শিক্ষায়তন কর্তৃপক্ষ, বিচলিত সরকার। অভিভাবকরাও পথে নামেন।
বিষয়টি গড়ায় হাইকোর্ট অবধি। তাঁরাও এ মৃত্যুতে চুপ করে থাকেন না। তাঁরাও এ মৃত্যুকে ‘হৃদয়বিদায়ক’ বলে বর্ণনা করেন। তাঁদের মতে, ‘শিক্ষার্থীর সামনে তার মা-বাবাকে অপমানের ঘটনা বাজে রকমের দৃষ্টান্ত।’ স্বভাবতই এ ঘটনা নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। ওই কমিটিকে এক মাসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করার নির্দেশ দেন আদালত।
আমরা জানি না, এসব তাত্ক্ষণিক বিক্ষোভের মুখে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন কত দিনে তৈরি হবে। তার চেয়েও বড় কথা, এ প্রক্রিয়া কত দিন ধরে চলবে এবং এর অবশেষ পরিণামই বা কী হবে। তবু প্রক্রিয়া যে তাত্ক্ষণিক শুরু হয়েছে, সেটাই বড় শুভ সংবাদ।
আমাদের সংবাদপত্র ভুবনের একালীন একটি বড় ইতিবাচক দিক হলো, এজাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নিয়ে যথার্থ দায়িত্ব পালনে তারা অগ্রচারীর ভূমিকা পালন করে থাকে। মোটা শিরোনামে, বিশদ বিবরণ প্রকাশে তারা পিছপা হয় না, কোনো কায়েমি স্বার্থের দিকে ফিরে থাকায় না। তাই অরিত্রীর মৃত্যু সংবাদপত্রে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে নানা শিরোনামে।
কেউ মনে করিয়ে দিয়েছে এজাতীয় ঘটনার পূর্ব দৃষ্টান্ত। আমাদের প্রশ্ন—এসব সত্ত্বেও তাদের শিক্ষাদানব্যবস্থায় তথা শিক্ষকদের আচরণে পরিবর্তন আসেনি কেন? কর্তৃপক্ষ পরিবর্তন ঘটানোর চেষ্টা চালায়নি কেন? অভিযোগ তো অনেক দিনের। কোচিংয়ে যোগ দেওয়া, প্রাইভেট পড়া—না হলে ভবিষ্যৎ নষ্ট ইত্যাদি বড় বিষয় নিয়ে কম লেখালেখি হয়নি। তাই একের পর এক অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটতে থাকে।
ঘটেছে অরিত্রীর ক্ষেত্রে। তার নামে নকল করার অপবাদ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে বলা হয়েছে, ‘অরিত্রী আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার শিকার।’ এক ধরনের কৌশলী দুর্নীতি আমাদের শিক্ষায়তনগুলোতে প্রবেশ করেছে—এর চরিত্র হলো ছাত্র-ছাত্রীদের অর্থনৈতিকভাবে শোষণ, প্রকৃতপক্ষে তা হলো ছাত্র-ছাত্রীদের পরিবারকে শোষণ। অথচ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ দেখেও দেখে না।
এবার অরিত্রীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলন, সংবাদপত্রগুলোর বিস্ফোরক ভূমিকা পালন, হয়তো বা আরো একাধিক কারণে শিক্ষায়তনের অনড় অচলায়তনে শক্ত ঝাঁকুনি লেগেছে। পত্রিকার সংবাদসূত্রে প্রকাশ, ‘অধ্যক্ষ, শাখাপ্রধানসহ তিন শিক্ষক বরখাস্ত। শ্রেণি শিক্ষক হাসনা হেনা গ্রেপ্তার।’ আমরা চাই, এসব প্রাথমিক ব্যবস্থা গ্রহণের পর আইনিপ্রক্রিয়া যেন সুষ্ঠু ও ধারাবাহিকভাবে চলে। অপরাধীদের যেন যথাযথ শাস্তি হয়। সেই সঙ্গে বিরাজমান দূষিত ব্যবস্থার সংশোধন এবং পরিবর্তন ঘটে।
আসলে শিক্ষায়তনের অনেক ক্ষেত্রেই সংবাদপত্র বিশ্লেষকদের মতে, শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় রয়েছে গোড়ায় গলদ। গলদ শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে অন্তর্নিহিত দুর্নীতি, (যেমন কোচিং, প্রাইভেট পড়ানো ইত্যাদি নিয়ে) তেমনি শিক্ষকদের মধ্যে ভিন্ন মাত্রায় প্রতিযোগিতা। তাই এমন কথাও বলা হয়েছে—‘দায় আমাদেরও আছে।’ দায়ই না, আসলে গলদ।
আরেকটি দৈনিকের পাতায় মোটা হরফে শিরোনাম—‘অরিত্রীর মৃত্যু, অনেক প্রশ্ন’। এর বড় প্রশ্ন যেমন ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে, তেমনি সাধারণ শিক্ষিত সমাজে—আত্মহননের প্ররোচনায় আত্মহত্যা আসলে চরিত্র বিচারে হত্যাকাণ্ড। এর বিচার সেভাবেই হওয়া উচিত। তা ছাড়া আমরা জানি, বিশেষভাবে এ শিক্ষায়তনটির আভিজাত্য বোধ এত প্রবল যে এর শিক্ষকরা ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবকদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করেন না। তাঁরা ভুলে যান যে শিক্ষার্থীদের টাকায় শিক্ষায়তন চলছে। চলছে তাঁদের বেতন-ভাতা ও অন্য সুযোগ-সুবিধা।
বাংলাদেশের সার্বিক ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় গলদ—এর বাণিজ্যিক চরিত্র এবং তা সরকারি-বেসরকারি সর্বক্ষেত্রে। একদা যে শিক্ষকরা ছিলেন শিক্ষাদানের আদর্শে সেবাব্রতী, তাঁদের বেশির ভাগ এখন বাণিজ্যভুক। ফলে বাণিজ্যের টানে তৈরি হয় শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে ত্রুটি, পরীক্ষায় দুর্নীতি, বিশেষ শিক্ষাদান ব্যবস্থায় দুর্নীতি। শুধু ভিকারুননিসা বলে নয়, এটা সর্ববিস্তারি ব্যাধি।
এতে সংশ্লিষ্ট শুধু যে শিক্ষায়তনের পরিচালনা পরিষদ, শিক্ষকসমাজ তা-ই নয়, এর নেপথ্যে প্রায়ই থাকে রাজনীতির কর্তৃত্ববাদী খেলা। রবীন্দ্রসংগীতের পঙিক্ত এদিক-ওদিক করে এসব নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায় : ‘তুমি কেমন করে খেলা কর গুণী?’ বেশ কিছুকাল আগে দৈনিকের সংবাদ সুবাদে এই অভিজাত শিক্ষায়তনটির পরিচালনা পরিষদ নিয়ে কত ধরনের পানি গড়াল রাজনীতির টানাপড়েনে?
এর মধ্যে আরো রয়েছে শিক্ষক রাজনীতির নানা মাত্রা। এক অরিত্রী নয়, একাধিক অরিত্রী এসব নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ তৈরি করে গেলেও ভিকারুননিসার শিকড়ে নতুন সারের ব্যবস্থা হয়নি। শিক্ষায়তনটি এর প্রচলিত ধারায়ই চলেছে এবং একের পর এক ঘটনায় রাজধানীর শিক্ষিত সমাজকে চঞ্চল করে তুলেছে। হ্রদের জলে সাময়িক আলোড়ন। ক্রমে থিতিয়ে আসা, এরপর যথারীতি উষ্ণতা। অবস্থা পূর্ববৎ। এই চক্রাবর্তনেই ভিকারুননিসার ভবিষ্যৎ তৈরি হচ্ছে বাণিজ্যিক সমৃদ্ধির পথ ধরে।
সত্যি বলতে কি, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ব্যবস্থাপনা যে কী জটিল—এর ইতিহাসে তা লেখা আছে। একেকটি ঘটনার পর তার অংশবিশেষ উদ্ঘাটিত হয়। তারপর যথারীতি সব কিছু ধামাচাপা পড়ে যায়। এবারও যে একই ধারায় সমস্যার নিরসন, তার আলামত এরই মধ্যে দেখা দিতে শুরু করেছে।
গ্রেপ্তার, ক্ষমা প্রার্থনা ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে উত্তপ্ত আন্দোলন স্থগিত ঘোষণা করা হলো। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই একদল শিক্ষার্থী আটক শিক্ষক ‘হেনা আপার মুক্তি চাই’ স্লোগান দিতে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে একটি ইঙ্গিতবাহী স্লোগান—‘অপরাধীর বিচার চাই’। কে সে অপরাধী।
এরই মধ্যে আরেকটি ঘটনার শিরোনাম : ‘ভিকারুননিসায় অচলাবস্থা/ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পলাতক’। বরখাস্ত হলেই পালাতে হবে কেন, যার ফলে শিক্ষায়তনের সব কাজকর্ম বন্ধ হওয়ার জোগাড়। এর পেছনে কী রহস্য লুকিয়ে আছে? ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস গোপন অবস্থান থেকে বেরিয়ে এলে হয়তো ঘটনারহস্যে কিছুটা আলোকপাত সম্ভব হতে পারে।
অরিত্রীর বিরুদ্ধে শিক্ষায়তন কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, ‘অরিত্রী মোবাইল ফোন টেবিলে রেখে নকল করছিল।’ প্রশ্ন উঠতে পারে, টেবিলের ওপর মোবাইল রেখে কি কেউ নকল করে? অন্যদিকে শিক্ষিকা হাসনা হেনা কেন তাঁর নির্দয় ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চাইছেন? তাহলে তাঁকে গ্রেপ্তারই বা করা হলো কেন, যদি সত্যি অরিত্রী নকল করে থাকে?
এসব প্রশ্নের স্বচ্ছ জবাব সঠিক অনুসন্ধানী তদন্তের মাধ্যমে বেরিয়ে আসা দরকার। এরপর সেই ফলাফলের ভিত্তিতে দরকার ভিকারুননিসা শিক্ষায়তনের সার্বিক সংস্কার এর অন্তর্নিহিত দূষণ ও ব্যাধির আক্রমণ থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে। প্রকৃত আভিজাতের প্রকাশ বিত্তে নয়, যথার্থ জ্ঞানের মননশীলতায়। এ সত্যটি ভিকারুননিসার শিক্ষক ও কর্তৃপক্ষের মাথায় রাখা দরকার।
অরিত্রীকে তো পাওয়া যাবে না, তাই তার সহপাঠীদের উদ্দেশে বলতে হয়, অরিত্রী, তুমি কি জানতে না অভিমানী মৃত্যু সমস্যার কোনো সমাধান নয়। সুস্থ লড়াইয়ের মাধ্যমে জীবনের প্রাপ্তি।
লেখক : কবি, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী
সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ