কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসের কারণে ইতিমধ্যে চীনের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ রয়েছে। চীনে ও চীনের বাইরে এ পর্যন্ত প্রায় ৩ হাজার জন করোনাভাইরাসে মৃত্যুবরণ করেছেন। সামনের দিনগুলোতে বিশ্বে এ রোগের কী প্রভাব পড়বে তা নির্ভর করছে কত দ্রুত এ ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব তার ওপর।
এ ভাইরাসের কারণে চলতি বছর বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশেষজ্ঞরা। করোনাভাইরাসের পুরো প্রভাব মূল্যায়ন করা কঠিন। তবে এটি পর্যটন, পরিবহন, আন্তর্জাতিক লেনদেন ও শিক্ষাসহ বিভিন্ন খাতে ইতিমধ্যেই ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। বৃহস্পতিবার (৫ মার্চ) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, ২০০২-০৩ খ্রিষ্টাব্দে ছড়িয়ে পড়া সার্স ভাইরাসের চেয়েও করোনাভাইরাসের প্রভাব বেশি হবে বলে মনে করা হয়। কারণ ওই সময় বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের অবদান ছিল ৮ শতাংশ, আর এখন তা ১৯ শতাংশ। চীনে ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে সার্স ভাইরাসের কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ৪ হাজার মার্কিন ডলার। এবার করোনার ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
কোভিড-১৯-এর প্রভাব পড়েছে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারে। ফলে ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে চীনের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের নিচে নেমে যেতে পারে বলে ধারণা করছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। তবে এটি স্পষ্ট, এ ভাইরাস শুধু চীনে নয়, বিশ্ব অর্থনীতিতেই বেশ বড় ধরনের ঝাঁকুনি দেবে।
করোনার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও, কারণ পোশাক খাতসহ অন্যান্য রফতানিজাত পণ্যের কাঁচামালের প্রায় ৭০ শতাংশ চীন থেকে আসে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট পণ্য আমদানির ২৫ শতাংশ এসেছে চীন থেকে। এ ভাইরাসের কারণে চীনের অনেক শিল্প-কারখানা বন্ধ থাকায় কাঁচামাল শিপমেন্ট হচ্ছে না। আমাদের কারখানাগুলো সাধারণত অল্প কিছুদিনের জন্য কাঁচামাল মজুদ রাখে।
ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করতে বেশি সময় নিলে মার্চ ও এপ্রিলে পণ্য ও কাঁচামাল শিপমেন্ট বিলম্বিত কিংবা বাতিল হতে পারে। এমনটি হলে এপ্রিলেই কাঁচামালের তীব্র সংকট দেখা দেবে। চীন বাংলাদেশের এক নম্বর বাণিজ্য অংশীদার। উল্লেখ্য, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১২.৪ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালে এর পরিমাণ ১৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হওয়ার কথা। কিন্তু এখন এ সম্ভাবনা হুমকির মুখে। যদি করোনাভাইরাসের কারণে চীন থেকে ৫-৬ মাস পণ্য না আসে তবে রফতানি খাতে ব্যাপক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
চীন থেকে কাঁচামাল না আসায় বাজারে চীনা পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুধু ড্রিল মেশিন নয়, অন্যান্য ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী, নিত্যব্যবহার্য ভোগ্যপণ্য, খাদ্যদ্রব্য যেমন- রসুন, আদা ও দারুচিনির দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্যালসিয়াম কার্বোনেটের প্রতি টনের দাম ছিল ১৩-১৪ হাজার টাকা।
এখন এর দাম ১৫ হাজার টাকা। রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীদের জন্য চীনের করোনাভাইরাস কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। চীনা প্রক্রিয়াজাত মাশরুম, বেবিকন, সুইটকন, ফয়েল পেপারসহ বিভিন্ন খাবারের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেমন ২০০ গ্রাম মাশরুমের দাম ছিল ৬৫ টাকা, এখন তা ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়াও চীন থেকে আসা আদা, রসুন, দারুচিনির দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় রেস্তোরাঁ মালিকদের মুনাফার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
পর্যটন ক্ষেত্রটি আমাদের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি ও সম্ভাবনাময় খাত। গত ১২ ফেব্রুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাকের একটি শিরোনাম ছিল- ‘কমেছে পর্যটক, আয় কমছে বিমান সংস্থার’। মোট জিডিপির প্রায় দু’শতাংশ আসে পর্যটন খাত থেকে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশি পর্যটকরা যেমন বিদেশে যায়, অনুরূপ বা বর্ধিত হারে বিদেশি পর্যটক বাংলাদেশে আসে। করোনার কারণে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা কমে যেতে পারে।
চীনের অর্থনীতি মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছে, কারণ আমদানি-রফতানি কমে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় দেশগুলোয় কারোনাভাইরাসের প্রভাব পড়েছে। কারণ ওই দেশগুলো চীন থেকে কাঁচামাল আমদানি করে। এ অর্থবছরে বিশ্ব অর্থনীতির জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার কম হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
করোনাভাইরাসের প্রভাবে চীনে গাড়ি বিক্রিতে ধস নেমে বিক্রি ৯২ শতাংশ কমে গেছে (সিপিসিএ)। করোনাভাইরাসের প্রভাবে সিঙ্গাপুর ও হংকং অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে রয়েছে। সংকট মোকাবেলায় সিঙ্গাপুর ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার এবং হংকং ৩৬০ কোটি ডলারের প্রকল্প গ্রহণ করেছে।
করোনাভাইরাসের কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সসহ বিভিন্ন বেসরকারি বিমান কোম্পানি ক্ষতির মুখে পড়েছে। ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে বৈশ্বিক এয়ারলাইন্সগুলোও। যাত্রী প্রায় দু’কোটি বা ১৬.৪ শতাংশ কমেছে (আইকাও)। ফলে বিশ্বব্যাপী বিমান সংস্থাগুলোর মোট অপারেটিং রাজস্ব কমেছে ৫০০ কোটি ডলার।
চীনের অর্থায়নে বাস্তবায়নের পথে আছে বাংলাদেশের অনেক মেগা প্রকল্প। যেমন- পদ্মা সেতু, পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ, ঢাকা-আশুলিয়া ফ্লাইওভার, পটুয়াখালী পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ ২৭টি প্রকল্প। এগুলো করোনার কারণে নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন না হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে।
ব্যাংকিং খাতেও করোনার প্রভাব বিরাজমান। কারণ বৈদেশিক লেনদেন ও ব্যবসা-বাণিজ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকে ঋণপত্র খুলতে হয়। ঋণপত্র ব্যাংকের আয়ের অন্যতম একটি উৎস। চীনের সঙ্গে বিমান যোগাযোগ এবং অনেক কারখানা বন্ধ থাকায় ব্যবসায়ীরা এলসি/ঋণপত্র খুলতে আগ্রহী নয়। ফলে ব্যাংক মুনাফা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। করোনার প্রভাব পড়ছে দেশের সোনার বাজারেও। বর্তমানে ১ ভরি সোনার দাম ৬১,৫২৮ টাকা, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে।
করোনাভাইরাসের প্রভাব শিক্ষাক্ষেত্রেও লক্ষণীয়। চীনের সব বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি শেষে চলতি সপ্তাহে খোলার কথা ছিল; কিন্তু বাস্তবে বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, কলেজ বন্ধ রয়েছে। এমনকি আবার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত না হওয়ার আগে বিদেশি শিক্ষার্থীদের চীনে প্রবেশ নিষেধ করা হয়েছে। ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে চীনের সরকারি বৃত্তিতে ভর্তি বিলম্বিত হতে পারে।
সম্প্রতি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অনলাইনে ক্লাস নেয়া শুরু করেছেন এবং কিছু বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন প্রজেক্ট পেপার উপস্থাপনের বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। ২০২০ সালে যাদের পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন হওয়ার কথা, তাদের যথাসময়ে ডিগ্রি ও সনদপত্র না পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বর্তমানে চীনে পিএইচডি ও এমএস কোর্সে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা তাদের কোর্স সম্পন্ন করতে স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা চিন্তা করে চীনে ফিরে যেতে নিরুৎসাহী হচ্ছেন।
করোনাভাইরাস যদি দ্রুত নিয়ন্ত্রণ না হয়, তাহলে বাংলাদেশ সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অন্তত সাময়িকভাবে চীনের বিকল্প উৎস খুঁজে বের করতে হবে। বাংলাদেশের মতো চীননির্ভর অন্যান্য দেশ কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বা করছে, সরকারকে সেদিকে নজর রাখতে হবে।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে ব্যবসায়ী ও জনসাধারণকে সঠিক তথ্য দিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে কোনো আতঙ্ক তৈরি না হয় এবং যাতে কোনো অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পণ্যের দাম বৃদ্ধি করতে না পারে। বিশ্ব নেতারা ও চীন সরকার নিজেদের মধ্যকার সব দ্বন্দ্ব ভুলে সম্মিলিতভাবে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে এগিয়ে আসবেন- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক: মো. শফিকুল ইসলাম, সহকারী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্যপদ্ধতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।