গত ১৮ই মে দৈনিক শিক্ষাডটকমে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, আটটি সাধারণ শিক্ষাবোর্ড, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ড মিলিয়ে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে সারাদেশে পাস করেছে মোট ১৪ লাখ ৩০ হাজার ৭২২ জন শিক্ষার্থী। যাদের একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির জন্য ৯ হাজার ৮৩ টি কলেজ-মাদ্রাসায় খালি আসন রয়েছে ২৮ লাখ ৬২ হাজার ৯টি। অর্থাৎ পাস করা সকল শিক্ষার্থী একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হলেও এবার ১৪ লাখ ৩০ হাজার ২৮৭ টি আসন ফাঁকা থাকবে। অন্য একটি প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার শিক্ষার্থী একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির জন্য আবেদনই করেনি।
এমতাবস্থায় এটি পরিস্কার যে, সারাদেশে এবছর একাদশ শ্রেণিতে ১৫ লাখের অধিক আসন খালি থাকবে। এই বাস্তব কারণেই কাঙ্খিত ছাত্রছাত্রী থাকবেনা অনেক কলেজ-মাদ্রাসায়। এমনকি ছাত্র-ছাত্রীশূন্যও থেকে যেতে পারে অনেক কলেজ-মাদ্রাসার একাদশ শ্রেণি। সেইসব কলেজ-মাদ্রাসার স্বীকৃতি বাতিল, এমপিও বন্ধ, এমনকি প্রতিষ্ঠান বন্ধের হুমকিতে আছেন এবং থাকবেন শিক্ষকগণ। হয়ত বন্ধ হবেও কোন কোনটি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই অবস্থার জন্য দায়ি কে? কেন এর খেসারত দিবেন কেবল শিক্ষকগণ? কেন শিক্ষার্থী আনতে বাড়ি বাড়ি যাবেন তাঁরা? গিয়েইবা কোথা থেকে, কীভাবে এই ১৫ লাখ শিক্ষার্থী আনবেন তাঁরা? ১৫ লাখতো অনেক অনেক দূরের কথা; হিসাবের অতিরিক্ত একজন কলেজে পড়োয়া শিক্ষার্থীও কি এবছর আর বানাতে পারবেন আমাদের পুরো শিক্ষা বিভাগ? তাহলে কীভাবে পুরন হবে এই ঘাটতি? না, হবেনা। কোনভাবেই হবেনা। তাহলে কেন বেতন/চাকরি হারাবেন কেবল শিক্ষকগণ? কেন তাঁরা আখ্যায়িত হবেন খারাপ কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষক হিসেবে? কেন বানানো হলো, অনুমতি দেওয়া হলো, স্বীকৃতি দেওয়া হলো, এমপিওভুক্ত করা হলো, সরকারি করা হলো এত সংখ্যক খারাপ(?) খারাপ(?) সাধারন কলেজ, কারিগরি/টেকনিক্যাল কলেজ ও আলিয়া মাদ্রাসা?
এই প্রতিষ্ঠানগুলোর অনুমোদন দেওয়ার সময় সাধারন শিক্ষাবোর্ড, কারিগরি শিক্ষাবোর্ড, মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড, এই তিনটি শিক্ষা বোর্ডের কি উচিৎ ছিলোনা একটি সমন্বিত ব্যবস্থার আওতায় হিসাব করে দেখে নেওয়া যে কোন এলাকায় কতটি সাধারন কলেজ, টেকনিক্যাল কলেজ ও মাদ্রাসা বিদ্যমান আছে এবং আরো কতটি অনুমোদন দেওয়ার প্রয়োজন আছে অথবা আদৌ প্রয়োজন আছে কিনা? সেভাবে হিসাব করে যদি সততারসাথে ও পরিকল্পিতভাবে অনুমতি দেওয়া হতো অথবা না দেওয়া হতো, তাহলে নিশ্চয়ই তৈরি হতে পারতোনা আমাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত এত সংখ্যক কলেজ-মাদ্রাসা। জনগণের করের টাকায় বেতন বহন করতে হতোনা প্রয়োজনের অতিরিক্ত এত সংখ্যক কলেজ শিক্ষকের। দ্বিগুণ বেতন-ভাতা দিয়ে রাখা যেতো প্রয়োজনীয় সংখ্যক অধিক যোগ্য কলেজ শিক্ষক। এই অবস্থার জন্য দায়ী কারা?
নির্ধারিত আসন পূর্ণ না হওয়া কলেজ-মাদ্রাসা গুলো যদি খারাপ প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হয়, তো সারা দেশে হাতে গুনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ব্যতীত সবইতো খারাপ(?) প্রতিষ্ঠান! এই আসন পুরা হওয়া, না হওয়ার মানদন্ডে বিবেচিত ভালো(?) কলেজ-মাদ্রাসাতো আমাদের সব উপজেলাতে গড়ে একটি করেও নেই। তাহলে কেনো এখনো বানানো হচ্ছে, অনুমতি দেওয়া হচ্ছে, স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে, এমপিওভুক্ত করা হচ্ছে আরো নতুন নতুন সাধারন ও কারিগরি/টেকনিক্যাল কলেজ-মাদ্রাসা? কেনো বৃদ্ধি করা হচ্ছে বিদ্যমান কলেজের আসন সংখ্যা? আবেদন বেশি পড়লেই কি কলেজ ভালো হয়ে যায়? এবার ঢাকা কলেজের চেয়ে ঢাকা সিটি কলেজে আবেদন বেশি পড়েছে। কোন কোন দিক বিবেচনায় ঢাকা কলেজের তুলনায় ঢাকা সিটি কলেজ উত্তম?
ঢাকা কলেজের একাডেমিক ভবন, খেলার মাঠ, অডিটোরিয়াম, বিজ্ঞানাগার, প্রাকৃতিক পরিবেশ, ক্যাম্পাসের পরিধি, শিক্ষকগণের যোগ্যতা কোনটি ঢাকা সিটি কলেজের তুলনায় খারাপ? সবদিক থেকেইতো ঢাকা কলেজ উত্তম। তাহলে কেনো বাংলাদেশের সেরা এই সরকারি ঢাকা কলেজটি আজ শিক্ষার্থীদের পছন্দের তালিকায় পিছিয়ে? এটি হচ্ছে এমন হাজারো উদাহরণের একটিমাত্র। সারাদেশেই বিরাজ করছে এমন বা এরচেয়ে খারাপ অবস্থা। কেননা, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা (নিন্দুকেরা বলেন, শিক্ষা অব্যবস্থা!) মনে হচ্ছে আমাদের সন্তানদের সুশিক্ষা দিতে চায়না, সহশিক্ষা দিতে চায়না, সুনাগরিক বানাতে চায়না; কেবল পরীক্ষা নামক দুই/তিন ঘন্টার আনুষ্ঠানিকতায় এ+ দিতে চায়।
কেবল বাছাই করা ভালো শিক্ষার্থীদের কৃতিত্বে ভালো কলেজ নামে খ্যাত শহরকেন্দ্রিক কিছু কলেজে রয়েছে হাজার হাজার শিক্ষার্থী। এখানে শিক্ষকের তোলনায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা আদর্শ অনুপাতের চেয়ে অনেক অনেক বেশি। তদুপরি তাদেরকেই অনুমতি দেওয়া হচ্ছে একাধিক শিফট ও শাখা খুলে আরো বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করার। অথচ, এসব আলোচিত ভালো কলেজ গুলোর আশেপাশে অবস্থিত কোচিং সেন্টার ও শিক্ষকদের প্রাইভেট বানিজ্য কেন্দ্রগুলোর দিকে সামান্য নজর দিলে সহজেই বুঝাযায় সেসব কলেজে কেমন লেখাপড়া হয়।
যাদের ছেলেমেয়ে সেসব কলেজে পড়ে তারা কলেজের বেতন-ফি ও কোচিং-প্রাইভেট পড়ার টাকা যোগাতে গিয়ে হাড়ে হাড়ে টের পান ভালো কলেজ কাকে বলে। শুধুমাত্র বাছাই করা ভালো শিক্ষার্থী ভর্তি করার সুযোগ দিয়ে এবং সেই সব ভালোদের ভালো ফলাফলের ভিত্তিতে সেরা কলেজ ঘোষণা দিয়ে; সরকার নিজেই করে দিচ্ছে তাদের এই শিক্ষা-বাণিজ্য করার অবাধ সুযোগ। অথচ, এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে আনুপাতিক হারে এ, বি, সি, ডি, সকল গ্রেডের শিক্ষার্থী একাদশ শ্রেণিতে (একই কলেজের পৃথক শিফট/শাখায়) ভর্তি করা বাধ্যতামূলক করে দিলেই দেখা যেতো ভালো সূতা দিয়ে ভালো কাপড় বুনা সেই সব কারিগরদের দক্ষতা কতটুকু। দেখা যেতো, কয়টা বি গ্রেড ধারিকে তাঁরা উন্নীত করতে পারেন এ গ্রেডে।
অপরদিকে কাম্য শিক্ষার্থী অভাবে বন্ধ হতে যাচ্ছে সারা দেশে বিদ্যমান হাজার হাজার কলেজে-মাদ্রাসা। ২০ জন থেকে ১০০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে বছরের পর বছর চলে আসছে এমন দু’চারটি করে কলেজ পাওয়া যাবে প্রতি উপজেলাতেই। এমনকি রাজধানী ঢাকার প্রতিটি থানাতেই রয়েছে ৫-৭ টি করে কলেজ; যেখানে কাম্য শিক্ষার্থী নেই। শিক্ষকের তোলনায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা আদর্শ অনুপাতের চেয়ে অনেক অনেক কম হলেও এসব কলেজের শিক্ষক, প্রশাসক, ভবন ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা বিবেচনায় আনা হলে সবই যে মন্দ তা কিন্তু নয়। তাই ছাত্র শিক্ষক অনুপাত কমিয়ে সুষ্ঠু নীতিমালা তৈরি করে সার্বিক বিবেচনায় ভালো কলেজ-মাদ্রাসা গুলোকে সঠিক নিয়মের মধ্যে এনে বাঁচিয়ে রাখা এবং সেগুলোর মান বৃদ্ধি করে সারাদেশে শিক্ষার মান বাড়ানো কি সরকারের দায়িত্ব নয়?
মো. রহমতউল্লাহ্: শিক্ষাবিদ এবং অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, ঢাকা।