আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, তদারকি জোরদার করা, পরিচালক ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১ আবার সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই আইনের খসড়ায় এবার ব্যাংকের পরিচালক ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা।
এসব বিধান রেখে ব্যাংক কোম্পানি আইনের একটি খসড়া সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ওয়েবসাইটে দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের মতামত দিতে বলা হয়েছে। তাদের মতামত পাওয়ার পর আইনটি চূড়ান্ত করা হবে।
প্রস্তাবিত খসড়ায় আর্থিক কেলেঙ্কারির কারণে ব্যাংক থেকে অপসারিত ব্যক্তির ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ, তাদের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি জব্দ এবং কিছু ক্ষেত্রে বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা দেয়া হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংককে। শুধু তাই নয়, বিদ্যমান আইনে ‘জনস্বার্থে’ বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যান, পরিচালক বা প্রধান নির্বাহীকে (এমডি) অপসারণ করতে পারে।
কিন্তু সরকারি ব্যাংকের এমডিকে অপসারণ করতে পারলেও পর্ষদ বা চেয়ারম্যানকে অপসারণ করতে পারে না। এজন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করতে হয়। তারা এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়। সংশোধিত আইনে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতা আরও বাড়ানোর হচ্ছে। বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এমডির নিচের স্তরের কর্মকর্তাদের অপসারণ করতে পারে না। এজন্য ব্যাংকের এমডিকে নির্দেশ দিতে হয়। এমডি পর্ষদের মাধ্যমে অপসারণ করতে পারেন। সংশোধিত আইনে এমডির নিচের স্তরের দুই ধাপ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরাসরি অপসারণ করতে পারবে।
তবে আইনের অনেক ধারা সরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রে প্রয়োজ্য নয় বলে রাখা হয়েছে। এটি নিয়ে অনেকে আপত্তি করেছেন। কেননা সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো ভালো চলছে না। জাল-জালিয়াতি ওইসব ব্যাংকেই বেশি হচ্ছে। এ কারণে সরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রেও ব্যাংক কোম্পানি আইনের সব ক্ষমতা প্রয়োগ করার বিধান রাখার কথা বলেছেন তারা। কেননা সরকারি ব্যাংকগুলোও এখন কোম্পানির আওতায় পরিচালিত হয়। এ কারণে এদেরও কোম্পানি আইনের আওতায় পুরোপুরি নিয়ে আসা উচিত।
আইনের খসড়ায় প্রত্যেক ব্যাংককে ‘স্বেচ্ছা ঋণখেলাপিদের চিহ্নিত করার জন্য দুটি করে কমিটি গঠন’ এবং ‘স্বেচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের তালিকা’ বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রেরণের কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে স্বেচ্ছা ঋণখেলাপিদের তালিকা ‘ছবি’সহ ব্যাংকের ওয়েবসাইট ও পত্রপত্রিকায় প্রকাশ করার নির্দেশনা থাকছে।
বিদ্যমান ব্যাংক কোম্পানি আইনে ‘স্বেচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’ বিষয়ে কিছু উল্লেখ ছিল না। কিন্তু আইন সংশোধন করে স্বেচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘স্বেচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ গ্রহীতা অর্থ এরূপ কোনো দেনাদার ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি যে নিজের বা স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে প্রদত্ত অগ্রিম, ঋণ বা অন্য কোনো আর্থিক সুবিধা বা এর অংশ বা এর ওপর অর্জিত সুদ বা এর মুনাফা বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক জারিকৃত নির্দেশনা অনুযায়ী যদি-
“(১) তাহার ঋণ পরিশোধ করিবার জন্য আর্থিক সচ্ছলতা বা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ঋণ পরিশোধ করিতে ব্যর্থ হইলে, বা
(২) জাল-জালিয়াতি, প্রতারণা ও মিথ্যা তথ্য প্রদানের মাধ্যমে অস্তিত্ববিইীন কোনো প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির নামে ঋণ গ্রহণ করিলে বা (ত) তাহাকে যে উদ্দেশ্যে ঋণ প্রদান করা হইয়াছিল সেই উদ্দেশ্যে ব্যবহার না করিয়া ঋণের অর্থ অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহার করিলে অথবা স্থানান্তর (পাচার) করিলে বা (৪) ঋণ বা অগ্রিমের বিপরীতে প্রদত্ত জামানত ঋণ প্রদানকারী ব্যাংক-কোম্পানির অজ্ঞাতে হস্তান্তর বা স্থানান্তরর করিলে,”
বিদ্যমান আইনে পরিবারের সংজ্ঞা দেয়া ছিল নাম, সংশোধিত আইনে পরিবারের ‘শ্বশুর-শাশুড়ি’কে অন্তর্ভুক্ত করে পরিবার সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘পরিবার অর্থ কোনো ব্যক্তির স্বামী বা স্ত্রী, পিতা, মাতা, পুত্র, কন্যা, ভাই, বোন, পুত্রবধূ, কন্যার জামাতা, শ্বশুর, শাশুড়ি, নাতি-নাতনি এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল সকলকে বুঝাইবে।’
সংশোধিত আইনে পরিচালকদের শেয়ার ক্রয়ের ক্ষেত্রে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। সংশোধিত ধারা ১৪ক-এ বলা হয়েছে, ‘(১) কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কোম্পানি বা তাহার স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি, একই গ্রুপভুক্ত প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি কিংবা একই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ব্যাংকের শেয়ার কেন্দ্রীভূত করা যাইবে না এবং কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, কোম্পানি বা তাহার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি, একই গ্রুপভুক্ত প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি, পৃথক সত্তা থাকা সত্ত্বেও কিংবা একই পরিবারের সদস্য একক, যৌথ বা উভয়ভাবে কোনো ব্যাংকের শতকরা দশ ভাগের বেশি শেয়ার ক্রয় করিবেন না। এই আইন কার্যকর হওয়ার দুই বছরের মধ্যে এই উপধারার বিধান মোতাবেক শেয়ার ধারণ সংরক্ষণ নিশ্চিত করিতে হইবে।’
ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৫৮ক-এর (১) এ বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যাংক মনে করে যে, তার তারল্য, সম্পদের গুণগত মান ও মূলধন পরিস্থিতি বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত হারে ও পন্থায় তারল্য, সম্পদ ও মূলধন সংরক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে না। পাশাপাশি এর অবস্থা দিন দিন আরও খারাপ হবে তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করবে। উপধারা (ঘ)-এ বলা হয়েছে, জনস্বার্থে ও দেশের সামগ্রিক অর্থব্যবস্থার স্বার্থে বাংলাদেশ ব্যাংক ওই ব্যাংকের পুনর্গঠন বা ক্ষেত্রবিশেষে অবসায়ন করতে পারবে। এছাড়া ৫৮(খ) এবং ৬৯(১) ধারা মোতাবেক অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একত্রীকরণ করতে পারবে। ব্যাংকের দুর্বলতার জন্য দায়ীদের ক্ষেত্রে আইনে ফৌজদারি মামলা, অপসারণ এবং শেয়ার বাজেয়াপ্তের কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি ব্যাংক হিসাব জব্দ এবং আদালতের আদেশ নিয়ে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে পারবে।
আইনে বলা হয়েছে, “প্রত্যেক ব্যাংক কোম্পানি পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের সমন্বয়ে একটি ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করিবে প্রত্যেক ব্যাংক-কোম্পানি উহার পর্ষদ সদস্যদের সমন্বয়ে একটি নমিনেশন ও রেমুনারেশন কমিটি গঠন করিবে। প্রত্যেক ব্যাংক কোম্পানি উহার পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের সমন্বয়ে একটি কমপ্লায়েন্স কমিটি গঠন করিবে।