বাংলাদেশ দৃশ্যমানভাবেই এগিয়েছে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত দিকে গত প্রায় এক দশকে অনেকটা দ্রুতগতিতেই সামনে হাঁটছে। মনে পড়ে স্বাধীনতা-উত্তরকালে দরিদ্র দেশের মানুষ হিসেবে আফসোস হতো এই ভেবে যে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমরা একেবারেই পরমুখাপেক্ষী।
আমাদের শিল্পোন্নয়ন নেই। রফতানি খাতকে প্রায় শূন্যই বলা যায়। সবকিছুই আমদানি করতে হয়। পাকিস্তান আমলে কৃষিভিত্তিক দেশ হিসেবে চিহ্নিত এ অঞ্চলে শিল্পোন্নয়ন প্রায় স্থবিরই ছিল। একমাত্র পাট ছাড়া রফতানিযোগ্য কোনো শিল্পোৎপাদন ছিল না বললেই চলে। এসব দেখে আমাদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা বিরাজ করত। মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধটি লিখেছেন এ কে এম শাহনাওয়াজ।
সে জায়গায় আজ অনেকটা উল্টো চিত্র দেখছি। ক্ষুদ্র বৃহৎ অনেক শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে। আইটি সেক্টরের অগ্রগতিও কম নয়। এখন বাংলাদেশের রফতানিযোগ্য পণ্যের তালিকা বেশ বড় হয়েছে।
কিন্তু সার্বিকভাবে দেশের অগ্রগতিকে এগিয়ে নিতে হলে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্র তথা বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমার্জনা ও অগ্রগতির যে প্রয়োজন, সে দিকটির দিকে কি আমাদের নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি রয়েছে? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার ভিশন প্রকাশ করেছেন। তাতে এখন আমরা উন্নত বিশ্বের কাতারে নিজেকে যুক্ত করার স্বপ্ন দেখি।
বর্তমান বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে এ স্বপ্নকে কেউ আর অলীক স্বপ্ন বলবে না। কারও যদি এভারেস্ট চূড়ায় ওঠার স্বপ্ন থাকে, তবে এভারেস্টে না উঠতে পারলেও কাঞ্চনজঙ্ঘা বা অন্তত অন্নপূর্ণা পর্যন্ত পৌঁছতেই পারে। আর আগেই হাল ছেড়ে যে শুধু অন্নপূর্ণা পর্যন্ত যেতে চায়, তার পক্ষে চিম্বুক পাহাড়ের চূড়ায় ওঠাটাও অনিশ্চিত হয়ে যাবে।
আমি ক্লাসে সভ্যতার ইতিহাস বোঝাতে উত্থান, বিকাশ, পতন ও নবউত্থানের ঘূর্ণায়মান বৃত্তের কথা বলি। সভ্যতার উত্থান কোনো এক প্রেক্ষাপটে কোনো এক অঞ্চলে শুরু হতেই পারে। তারপর সেই সভ্যতার মানুষ ও পরিচালকদের সক্ষমতায় সভ্যতার ঊর্ধ্বমুখী বিকাশ ঘটবে। বৃত্তের শেষ উচ্চতা পর্যন্ত বিকাশ ধারা।
এরপর ঘূর্ণায়মান বৃত্তের কারণে সভ্যতার অবধারিত পতন প্রক্রিয়া শুরু হয়। তারপর চূড়ান্তভাবে পতন ঘটে সভ্যতার। কিন্তু তাই বলে নিঃশেষ হয়ে যায় না সে সভ্যতা। চলন্ত বৃত্তের সাথী হয়ে আবার নবউত্থান ঘটতে পারে।
এ সূত্রের আলোকে আমি ক্লাসে বাংলার ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত করতে চাই শিক্ষার্থীদের। ইতিহাস থেকে জানা যায়, আমাদের অতীতটা খুব উজ্জ্বল ছিল। শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি সব ক্ষেত্রে এ দেশটি ছিল সোনাফলা। এ দেশের সম্পদের আকর্ষণে ধারাবাহিকভাবে রোম, আরব আর ইউরোপীয় বণিকরা ছুটে আসত।
ইউরোপে যখন ৯ শতকে একটু একটু করে গির্জাকেন্দ্রিক প্রাথমিক শিক্ষার যাত্রা শুরু হয়েছিল, এরও অন্তত একশ’ বছর আগে বাংলার বৌদ্ধবিহারগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হতে থাকে।
বাঙালি পণ্ডিতদের নেপাল, তিব্বত, চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে অনুরোধ করে নিয়ে যাওয়া হতো তাদের দেশে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে। তারা যখন অনেকটা উচ্চতায় ইউরোপের দেশগুলো তখন মাত্র সামন্ত সভ্যতা থেকে বেরিয়ে আধুনিকতার পথে পা ফেলছে।
এরপর অনেকটা দ্রুততায় এরা ভৌগোলিক আবিষ্কারের পথে বাণিজ্য বিপ্লব ঘটাল। আর এর সূত্র ধরে ঘটে গেল শিল্পবিপ্লব। এতেও উন্নত বিশ্বের উচ্চতায় ওঠা হয়তো সহজ হতো না, যদি না এসব অগ্রগতিতে মানুষের মধ্যে মুক্তচিন্তার জন্ম না নিত।
আর এ সচেতনতা আঠারো শতকে ফরাসি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে আলোড়ন তুলল। ১০ শতকের শেষ ও ১১ শতকের শুরু থেকে ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি এবং সবশেষে ইংল্যান্ডে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকল বিশ্ববিদ্যালয়। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার দরজা খুলে গেল।
এভাবে মুক্তবুদ্ধির চর্চার পথ ধরে ইতালিতে সংঘটিত হয়ে গেল রেনেসাঁস। শিল্পবিপ্লবে যে পুঁজিবাদের উদ্ভব হল এর সঙ্গে জ্ঞানচর্চার সম্মিলন যে একটি নতুন শক্তির জন্ম দিয়েছিল তা ইউরোপের অনেক দেশের আকাশছোঁয়া উন্নতিকে নিশ্চিত করে।
আজকের এ লেখাটির প্রেক্ষাপট এখানেই। আমাদের উন্নত বিশ্বে পৌঁছার পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য জ্ঞানচর্চা যে জরুরি এ কথা বলার জন্যই আমার বিনীত নিবেদন। শুধু মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাশক্তি আর দূরদৃষ্টিই শেষ কথা নয়, এ পথ পরিক্রমণে জ্ঞানশক্তিরও সহায়তা প্রয়োজন।
এ সত্যটি যদি আমরা বিবেচনায় না রাখি তবে লক্ষ্য অর্জন কঠিন হয়ে যাবে। দেশকে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে এগিয়ে নেয়ার জন্য রাজনৈতিক অঞ্চল এবং আমলাতন্ত্রে যেভাবে জ্ঞানচর্চার সঙ্গে যুক্ত থাকা দরকার তেমনটা থাকছে বলে মনে হয় না। জ্ঞানচর্চার চারণ অঞ্চলগুলোও তেমন প্রণোদনা পাচ্ছে না।
সেই খ্রিস্টপূর্ব যুগে মহান আলেকজান্ডার যেভাবে ভাবতে পেরেছিলেন এতকাল পর আমরা সেভাবে ভাবতে পারছি বলে মনে হচ্ছে না। বিশ্ববিজেতা হওয়ার স্বপ্ন নিয়েই বেরিয়েছিলেন মেসিডোনের এই তরুণ রাজা। তিনি বুঝেছিলেন জ্ঞানচর্চার শক্তি ছাড়া তিনি শক্তিমান হতে পারবেন না।
তাই তিনি গ্রিক জাতির- বিশেষ করে হেলেনীয় জ্ঞানের সঙ্গে সমন্বয় ঘটালেন প্রাচ্যদেশীয় জ্ঞান-ক্ষেত্রের। মিসরে বসালেন জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র। এভাবেই আলেকজান্দ্রিয়া নতুন নামকরণে হেলেনিস্টিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটল।
ইতিহাসের পাঠ থেকেই তো আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। আমরা কি আমাদের রাজনীতিকে জ্ঞানমুখী করতে পেরেছি? আমলাতন্ত্র তো তাদের অচলায়তনে আটকে আছে। ব্রিটিশ আমল থেকেই এ দেশের আমলাতন্ত্রে রাজকীয় উন্নাসিকতা রয়েছে। যেন নানা বিদ্যায় প্রাজ্ঞ অবস্থানে তারাই বসে আছেন।
অন্যদিকে জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রভূমি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলছে স্থবিরতা। বিশ্ব কোথায় এগিয়েছে আর ভবিষ্যতে এগিয়ে চলার পথে কী কী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে এর সঙ্গে সমন্বয় করে খুব কমই শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়ন করা হচ্ছে। সাতপুরোন সিলেবাসে পড়ে থেকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শুধু ডিগ্রি প্রদান কেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে।
ডিজিটাল বিশ্বের সঙ্গে সমন্বয় করে বিজ্ঞানচর্চায় আমরা কতটা এগোতে পেরেছি তা ভেবে দেখার সময় বয়ে যাচ্ছে। আধুনিক বিজ্ঞানচর্চা জন্য যেসব প্রণোদনা রাষ্ট্রের দেয়ার কথা তা নিয়ে কি রাষ্ট্র ভাবছে? আজ সময় এসেছে সনাতনী পদ্ধতিতে বিভাগগুলোর স্বতন্ত্র বিষয় চর্চায় এগিয়ে চলা নয়; সমন্বিত জ্ঞানের ক্ষেত্রে পথ হাঁটার।
যাকে আমরা ইংরেজিতে বলি ‘মাল্টি ডিসিপ্লিনারি অ্যাপ্রোচ’। এদিকে আসার মানসিক প্রস্তুতি অনেকটাই নেই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনেক বিভাগ পরিচালকদের। সেই সাতপুরোন সিলেবাসে আমরা সমাজবিজ্ঞানের বিষয়গুলো পড়াচ্ছি। কলাবিদ্যা চর্চায়ও তেমন আধুনিক ধারণা তৈরি হয়নি।
তবে এভাবে দোষারোপ করাটাও ঠিক হবে না। আমাদের স্বার্থবাদী রাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে জ্ঞানচর্চার তপোবন তৈরি না করে রাজনৈতিক শক্তির কেন্দ্র বানাতে চাইছে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান সৃষ্টির প্রতিষ্ঠান তা বিবেচনা করে নীতিনির্ধারণের মতো এখন অভিভাবক নেই অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে।
এখন অবস্থাটা এমন তৈরি করে ফেলা হয়েছে, পাণ্ডিত্যে উজ্জ্বল কোনো অধ্যাপকের মূল্য নেই, মূল্য আছে রাজনীতির দৌড়ে এগিয়ে থাকা অধ্যাপকের। তাদের হাতেই এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবকত্ব।
আমি শিক্ষক রাজনীতি করা একটি অনুষদের অভিভাবক অধ্যাপককে বলেছিলাম, দিন দিন শিক্ষকদের ক্লাস ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা বাড়ছে, জবাবদিহিতা নেই বললেই চলে, কোর্স কারিকুলাম নিয়ে নতুন কোনো ভাবনা নেই, আপনার এখানে ভূমিকা রাখা উচিত। তিনি হেসে বললেন, এ নিয়ে তো কথা বলা যায়ই, কিন্তু এতে আমার ভোট কমে যাবে।
প্রশ্ন হতে পারে, শিক্ষক তার নিজের বিবেক দিয়ে দায়িত্ব পালন করবেন না কেন? এর উত্তরে নষ্ট রাজনীতির দিকেই তাকাতে হয়। এখন শিক্ষকতায় শিক্ষকের চেয়ে চাকরিজীবীদের নিয়োগ হচ্ছে বেশি। অনেকের কাছে আমার এই কথাটি অদ্ভুত মনে হতে পারে। শিক্ষক ২৪ ঘণ্টাই শিক্ষক।
চাকরিজীবী দশটা-পাঁচটার হিসাবে চলেন। শিক্ষকের দায়িত্ব শিক্ষকতা ও গবেষণা। জ্ঞানচর্চার সঙ্গে তার সম্পর্ক। এ কারণে সবচেয়ে চৌকস মেধাবীদের জন্য উন্মুক্ত ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা।
এখন শিক্ষক হওয়ার পূর্বশর্ত মেধাবী ফল নয়। রাজনৈতিক যোগাযোগই প্রধান। পুরো নিয়োগ পদ্ধতিতেই নানা কৌশলে পথ তৈরি করা থাকে। ফলে দিনে দিনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকের সংখ্যা কমে চাকরিজীবীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এসব বাস্তবতায় এখন আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একাডেমিক পরিকল্পনা নেয়ার কথা, তা হচ্ছে না সঠিক অভিভাবকত্বের অভাবে। ভিশনটাই আটকে গেছে। ভবিষ্যৎ একাডেমিক পরিকল্পনা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনায় সেমিনার-সিম্পোজিয়াম তেমন একটা হয় বলে মনে হয় না।
বিভাগগুলো একাডেমিক মানোন্নয়ন নিয়ে খুব একটা মনোযোগী থাকে না। ধরি, ইতিহাস বা ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগগুলোতে ত্রিশ বছর আগে যে কারিকুলাম ও সিলেবাসের আলোকে পড়ানো হতো তার চেয়ে খুব একটা এগিয়ে যায়নি।
যেমন বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক ইতিহাসের পাশাপাশি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস গুরুত্বের সঙ্গে পড়ার কথা; কিন্তু শিক্ষকতায় মেধাবী শিক্ষকদের অংশ কমে যাওয়ায় নতুন করে চর্চা করা আগ্রহী শিক্ষকদের অভাবে প্রয়োজনীয় কোর্স চালু করা সম্ভব না।
কম মেধাবী চাকরিজীবী শিক্ষকদের নিজেদের একাডেমিকভাবে তৈরি করার বদলে শিক্ষক রাজনীতিতে সময় দেয়া অধিক জরুরি। পরে যখন মনে করি ইতিহাস বিষয়ের সঙ্গে প্রত্নতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, ভূগোল এসব বিষয়কে সমন্বিত করা দরকার তখন খুব সাড়া পাওয়া যায় না।
এ ধারার বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে ভাবি, বাংলাদেশকে উন্নত দেশের পর্যায়ে নিয়ে যেতে হলে যে চ্যালেঞ্জগুলোর মোকাবেলা করতে হবে তার অন্যতম বড় নিয়ামক হচ্ছে জ্ঞানচর্চার মানোন্নয়ন। এ কারণে অবশ্যই স্বার্থবাদী রাজনীতির ঘূর্ণাবর্ত থেকে বের করে আনতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবকত্বের দায়িত্ব তুলে দিতে হবে শিক্ষানুরাগী পণ্ডিত অধ্যাপকদের হাতে। প্রকৃত মেধাবীদের ফিরিয়ে আনতে হবে শিক্ষকতায়। সর্বোপরি সরকারি দৃষ্টি থাকতে হবে নির্মোহভাবে। জ্ঞানচর্চার উন্নয়ন ছাড়া এগিয়ে চলার পথ খুব মসৃণ হতে পারে না।
লেখক: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়