আজ পবিত্র হজ। ইসলাম ধর্মের পাঁচটি স্তম্ভের একটি হচ্ছে হজ। ভাষা ও বর্ণের ভেদাভেদ ভুলে বিশ্বের প্রায় ১৬৪টি দেশের ২০-২৫ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান হজ পালনের লক্ষ্যে মিনা থেকে আরাফাতে যাবেন। মূলত ৯ জিলহজ আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করাই হজ। আরাফাতের ময়দানে ইবাদত করাকেই হজের মূল অনুষ্ঠান বলা হয়। এদিন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা ‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হাম্দা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুল্ক, লা শারিকা লাক’ তালবিয়া পাঠ করে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়ে পাপমুক্তির আকুল বাসনায় সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত তারা আরাফাতের ময়দানে থাকবেন। কেউ পাহাড়ের কাছে, কেউ সুবিধাজনক জায়গায় বসে ইবাদত করবেন। ‘লাব্বাইক’ ধ্বনিতে আজ মুখর হবে আরাফাতের ময়দান। আগামীকাল মঙ্গলবার সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত হবে ঈদুল আজহা। এদিন পশু কোরবানির মধ্য দিয়ে শেষ হবে হজের আনুষ্ঠানিকতা।
এদিকে হজকে কেন্দ্র করে পবিত্র মক্কা নগরীর ঐতিহাসিক মিনা প্রান্তর পরিণত হয়েছে তাবুর শহরে। পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে উন্নত শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রশস্ত সাদা তাবুগুলো মুখরিত সারাবিশ্ব থেকে আসা ও স্থানীয় লাখ লাখ মুসুল্লির তালবিয়া ধ্বনিতে। ইসলামী রীতি অনুযায়ী, আরাফাত থেকে মিনায় ফেরার পথে সোমবার সন্ধ্যায় মুজদালিফায় মাগরিব ও এশার নামাজ পড়বেন সমবেত মুসলমানরা। মুজদালিফায় রাতে থাকার সময় তারা পাথর সংগ্রহ করবেন, যা মিনার জামারায় শয়তানকে উদ্দেশ্য করে ছোড়া হবে। ১০ জিলহজ আগামীকাল মঙ্গলবার ফজরের নামাজ আদায় করে মুজদালিফা থেকে মিনায় ফিরবেন। হাজিরা মিনায় বড় শয়তানকে পাথর মারবেন, কোরবানি দেবেন, মাথার চুল কামাবেন। এরপর মক্কায় গিয়ে কাবা শরিফ তাওয়াফ করবেন। তাওয়াফ, সাঈ শেষে আবার মিনায় ফিরে ১১ ও ১২ জিলহজ বুধবার ও বৃহস্পতিবার) অবস্থান করবেন। সেখানে প্রতিদিন তিনটি শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করবেন হাজীরা। প্রত্যেক শয়তানকে ৭টি করে পাথর মারতে হয়। মসজিদে খায়েফের থেকে মক্কার দিকে আসার সময় প্রথমে জামারায় সগির বা ছোট শয়তান, এরপর জামারায় ওস্তা বা মেজ শয়তান, এরপর জামারায় আকাবা বা বড় শয়তানকে পাথর মারতে হবে। সবশেষে কাবা শরিফকে বিদায়ী তাওয়াফের মধ্যে দিয়ে শেষ হবে হজের আনুষ্ঠানিকতা।
গতকাল সারাদিন এবং রাত মুসলমানরা মিনায় কাটিয়েছেন ইবাদত-বন্দেগীর মধ্যে দিয়ে। আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় তারা জিকির ও নামাজ পড়েছেন জামাতের সঙ্গে। হজের মূল আনুষ্ঠানিকতার জন্য আজ সোমবার সকালে তারা সমবেত হবেন বিদায় হজের স্মৃতি জড়িত আরাফাতের ময়দানে। সেলাইবিহীন শুভ্র এক কাপড়ে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত তারা সেখানে থাকবেন। চার বর্গমাইল আয়তনের এই বিশাল সমতল মাঠের দক্ষিণ দিকে মক্কা হাদা তায়েফ রিং রোড, উত্তরে সাদ পাহাড়। সেখান থেকে আরাফাত সীমান্ত পশ্চিমে আরও প্রায় পৌনে ১ মাইল বিস্তৃত। মুসলমানদের কাছে পবিত্র এই ভূমিতে যার যার মতো সুবিধাজনক জায়গা বেছে নিয়ে তারা ইবাদত করবেন; হজের খুতবা শুনবেন এবং জোহর ও আসরের নামাজ পড়বেন।
সৌদি দৈনিক আলআরাবিয়ার খবরে বলা হয়, বাদশাহ সালমান এবার হজের খুতবা পড়ার দায়িত্ব দিয়েছেন মসজিদে নববীর ইমাম শেখ হুসেইন বিন আবদুল আজিজকে। এ খুতবা রেডিও ও টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হবে বিশ্বময়।
আজ কাবা শরিফে নতুন গিলাফ পরানো হবে : প্রতিবছর (৯ জিলহজ) হজের দিন হাজীরা সব আরাফাতের ময়দানে থাকেন এবং মসজিদে হারামে মুসল্লির সংখ্যাও থাকে কম। আজ কাবা শরিফের গায়ে পরানো হবে নতুন গিলাফ। আরবরা কাবাকে আবৃত করে রাখা কাপড়টিকে বলে কিসওয়া আর আমরা বলি গিলাফ। হাজিরা আরাফাত থেকে ফিরে এসে কাবা শরিফের গায়ে নতুন গিলাফ দেখতে পান। নতুন গিলাফ পরানোর সময় পুরোনো গিলাফটি সরিয়ে ফেলা হয়। পুরোনো গিলাফ কেটে মুসলিম দেশের সরকারপ্রধানদের উপহার দেয়া হয়।
জানা গেছে, হজ পালনে সৌদি আরবে হাজির হওয়া মুসলমানরা গত শনিবার বিকাল থেকে জড়ো হতে শুরু করেন ১০ কিলোমিটার দূরে তাবুনগরী মিনায়। সেখানে স্থাপিত তাবুতে অবস্থান নিয়ে ইবাদত মশগুলে রয়েছেন মুসল্লিরা। এর মধ্য দিয়ে শুরু হলো পবিত্র হজ পালনের আনুষ্ঠানিকতা। হজের অংশ হিসেবে মিনা, আরাফাত ময়দান, মুজদালিফা ও মক্কায় পাঁচদিন অবস্থান করবেন পবিত্র হজব্রত পালনে যাওয়া মুসল্লিরা। এর আগে সেলাইবিহীন দুই টুকরা সাদা কাপড় পরে হজের নিয়ত করে মিনার উদ্দেশে রওনা হন হজযাত্রীরা।
মুসলমানদের বিশ্বাস অনুযায়ী, আদি পিতা আদম ও আদি মাতা হাওয়া পৃথিবীতে পুনর্মিলনের পর এই আরাফাতের ময়দানে এসে আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন। ১৪শ’ বছরের বেশি সময় আগে এখানেই ইসলামের শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) দিয়েছিলেন তার বিদায় হজের ভাষণ। এই আরাফাতে উপস্থিত না হলে হজের আনুষ্ঠানিকতা পূর্ণাঙ্গ হয় না। তাই হজে এসে যারা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, তাদেরও অ্যাম্বুলেন্সে করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হয় স্বল্প সময়ের জন্য।
সৌদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মেজর জেনারেল মনসুর আল-তুর্কি গত শনিবার মিনায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, এবার হজে আসা মানুষের সংখ্যা সব মিলিয়ে ২০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। তারা যাতে নির্বিঘেœ সুষ্ঠুভাবে হজ সম্পন্ন করতে পারেন, সেজন্য সব প্রস্তুতিই নেয়া হয়েছে।
সৌদি আরবের সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী, বিশ্বের ১৬৪টি দেশের ২০ লাখের বেশি মুসলমান এবার হজ করছেন, যাদের মধ্যে বাংলাদেশির সংখ্যা সোয়া এক লাখের মত। আরব নিউজ জানিয়েছে, হজে আসা মুসলমানদের নিরাপত্তার জন্য মক্কার চারপাশে ছয়টি চেকপয়েন্ট বসানো হয়েছে। সেখানে অনুমতিপত্র পরীক্ষা করে তারপর সবাইকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে। যাতায়াতের সুবিধার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে ২১ হাজার বাস। এই পুরো প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে সৌদি সরকারের ১৪০০ কর্মকর্তা কর্মচারীর পাশাপাশি নারী-পুরুষ মিলিয়ে ১৪৮৫ জন স্বেচ্ছাসেবী।