সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে যৌন নিপীড়নবিরোধী কমিটি করার জন্য উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকলেও তার বাস্তবায়ন নেই। বিশেষ করে স্কুল-কলেজগুলোতে ওই কমিটি নেই বললেই চলে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কমিটি আছে নামকাওয়াস্তে। বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে ওই কমিটির কার্যকারিতা নেই। অনেক আগে একবার কমিটি করা হলেও পুনর্গঠন করা হয়নি। অনেক প্রতিষ্ঠানে নিয়মানুযায়ী হয়নি কমিটি। এ ছাড়া উচ্চ আদালতের নির্দেশনা সত্ত্বেও যৌন নিপীড়ন রোধ করার লক্ষ্যে আইন বা বিধিমালা করার উদ্যোগ নেয়নি সরকার। বুধবার (১৭ এপ্রিল) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন শরীফুল আলম সুমন।
জানা যায়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯৮ সালে প্রথম যৌন নিপীড়নবিরোধী নীতিমালা ও আইন করার দাবি উঠেছিল। ওই সময় ছাত্র-শিক্ষকরা মিলে একটি নীতিমালার একটি খসড়া জমা দিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে। এরপর বিভিন্ন সময়ে নারী নির্যাতনের ঘটনায় নানা জায়গা থেকে একই দাবি আসতে থাকে। দীর্ঘ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৮ সালের ৭ আগস্ট কর্মস্থল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারী ও শিশুদের যৌন হয়রানি প্রতিরোধের জন্য দিকনির্দেশনা চেয়ে জনস্বার্থে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির তখনকার নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী। তার পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি কামরুল ইসলাম সিদ্দিকীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ কর্মক্ষেত্রে ও শিক্ষাক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে একটি দিকনির্দেশনামূলক রায় দেন ২০০৯ সালের ১৪ মে। সেই দিকনির্দেশনার পাশাপাশি কেন নতুন আইন বা বিধিমালা প্রণয়ন করতে নির্দেশ দেওয়া হবে না তা জানাতে সরকারের প্রতি রুল জারি করেছিলেন হাইকোর্ট।
প্রায় ১০ বছর আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্থাপিত খসড়া নীতিমালা আমলে নিয়ে হাইকোর্ট প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ও কর্মস্থলে যৌন নিপীড়নবিরোধী কমিটি করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। নতুন আইন বা বিধিমালা প্রণয়ন না হওয়া পর্যন্ত ওই নির্দেশনা মেনে চলতে বলেছিলেন আদালত।
আদালতের নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে যৌন নিপীড়নবিরোধী পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করতে হবে। এর প্রধান হবেন একজন নারী। ওই কমিটিতে একাধিক নারী সদস্য থাকবেন। এর মেয়াদ হবে দুই বছর। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হল, অনুষদ ও ইনস্টিটিউট-ভিত্তিক আলাদা কমিটি করতে হবে। এতে আরো বলা হয়, দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে অভিযোগ কেন্দ্র থাকবে। পাঁচ সদস্যের কমিটি ওই কেন্দ্র পরিচালনা করবে। তদন্তকারী দলকে সর্বাত্মক সহায়তা দিতে বাধ্য থাকবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। কমিটি যৌন হয়রানির কোনো অভিযোগ পেলে তদন্ত ও অনুসন্ধান শেষে পুলিশের কাছে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পাঠাবে। এরপর দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী অপরাধের ধরন ও মাত্রা বুঝে বিচার বিভাগ যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। রায়ে উল্লেখ করা হয়, কমিটি নির্যাতন সম্পর্কে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত এবং পুুলিশের কাছে অপরাধীকে না পাঠানো পর্যন্ত নির্যাতিত ও অভিযুক্ত ব্যক্তির কোনো পরিচয় প্রকাশ করা যাবে না। যতদিন পর্যন্ত জাতীয় সংসদে যৌন হয়রানি রোধে কোনো আইন প্রণয়ন করা না হয় তত দিন সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাইকোর্টের দেওয়া এই নীতিমালা বাধ্যতামূলকভাবে কার্যকর হবে।
যৌন হয়রানি বা নিপীড়নের সংজ্ঞায় আদালত বলেছিলেন, শারীরিক ও মানসিক যেকোনো ধরনের নির্যাতন যৌন হয়রানির পর্যায়ে পড়ে। ই-মেইল, এসএমএস, টেলিফোনে বিড়ম্বনা, পর্নোগ্রাফি, অশালীন উক্তিসহ কাউকে ইঙ্গিতপূর্ণভাবে সুন্দরী বলাও যৌন হয়রানির পর্যায়ে পড়ে। এ ছাড়া কোনো নারীকে ভয়ভীতি প্রদর্শন, যেকোনো ধরনের চাপ প্রয়োগ করা, মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে সম্পর্ক স্থাপন করা, অশালীন চিত্র, দেয়াল লিখন ও আপত্তিকর কোনো কিছু করা যৌন হয়রানির মধ্যে পড়ে।
আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, শ্রম মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফেকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ), বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফেকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ), বাংলাদেশ পুলিশ, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ ১৯ প্রতিষ্ঠানকে রুলের জবাব দিতে বলেছিলেন আদালত।
বাস্তবে আদালতের নির্দেশনা মেনে বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কমিটি করেনি। এমনকি ওই কমিটি গঠনের ব্যাপারে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর থেকেও।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব কামরুন নাহার বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমরা বৃহস্পতিবার বসব। যৌন নিপীড়ন রোধে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী কোথায় কী কার্যক্রম চলছে তা জানার চেষ্টা করব। যদি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা দপ্তরকে কোনো সুপারিশ করতে হয় সেটাও করব। আমরা যৌন নিপীড়ন রোধে একটি ক্যাম্পেইন করতে চাই। জনগনকে সচেতন করে তুলতে চাই। এ ব্যাপারে আমাদের মিডিয়ার সহায়তাও প্রয়োজন।’
বিকেএমইএর সাবেক সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘যৌন নিপীড়ন রোধে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী আমাদের কমিটি হয়তো নেই, কিন্তু লেবার ল-তে যেভাবে বলা আছে সেভাবে আছে। এতে আদালতের মূল যে নির্দেশনা তা কার্যকর হচ্ছে। আমাদের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে মহিলা কল্যাণ অফিসার আছে। প্রতিটি ফ্লোরে অভিযোগ বাক্স আছে। কেউ যদি মনে করেন তিনি সমস্যায় পড়েছেন, তাহলে অভিযোগ জানালে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব দেশের বাইরে থাকায় তাঁদের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। একাধিক অতিরিক্ত সচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে কেউ বলেন, জেনে জানাবেন; আবার কেউ সচিব ফেরার পর কথা বলতে পরামর্শ দেন।
ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফি যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে বিচার চাইতে গিয়ে উল্টো হেনস্তার শিকার হয়। সম্প্রতি যৌন নিপীড়ক অধ্যক্ষের নির্দেশে পুড়িয়ে হত্যা করা হয় রাফিকে। ওই ঘটনার পর আবারও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়নবিরোধী কমিটি গড়ার বিষয়টি আলোচনায় আসে।
ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, ‘আমার জানা মতে বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়েই যৌন নিপীড়নবিরোধী কমিটি আছে। তবে এর সব কার্যকর আছে কি না সেটা ভাবার বিষয়। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, ফলে অভিযোগ উত্থাপিত হলে তারাই তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে পারে। আমাদের কাছে মাঝেমধ্যে এসংক্রান্ত চিঠি আসে। আমরা তা সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়ে দিই।’
মাউশি অধিদপ্তরের পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক ড. মো. আবদুল মান্নান বলেন, ‘সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়নবিরোধী কমিটি করার ব্যাপারে আমরা আগেও বলেছি। আবারও আদালতের নির্দেশনা অনুসারে কমিটি করতে আমরা পরিপত্র জারি করব। সেই কমিটি যাতে কার্যকর হয়, সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তবে সংশ্লিষ্ট অনেকেই বলছেন, শুধু যৌন নিপীড়নবিরোধী কমিটি করলেই হবে না। নিপীড়িতরা যেন অভিযোগ জানাতে পারে, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, নিপীড়ক ঊর্ধ্বতন বা ক্ষমতাবান কেউ। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে অভিযোগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, সে নিশ্চয়তা দিতে হবে। নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা না দিলে কেউ কমিটির কাছে অভিযোগ জানাতে যাবে না।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়নবিরোধী কমিটির প্রধান অধ্যাপক রাশেদা আখতার বলেন, ‘আমাদের কাছে অভিযোগ এলে আমরা তা তদন্ত করি। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে প্রতিবেদন জমা দিই। তাঁরা ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এখনো একটা অভিযোগ জমা আছে। আগামী সপ্তাহে সেটার তদন্ত শুরু করব। গত পাঁচ বছরে আমরা ১২ থেকে ১৩টি অভিযোগের তদন্ত করেছি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এ কে এম গোলাম রাব্বানী বলেন, ‘আমাদের উপ-উপাচার্যকে প্রধান করে যৌন নিপীড়নবিরোধী কমিটি রয়েছে। অভিযোগ এলে আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নিই। সম্প্রতি পাঁচ-সাতজনের বিরুদ্ধে এই কমিটি অভিযোগের সত্যতা পেয়েছিল। সে অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ব্যবস্থাও নিয়েছে।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরো কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়নবিরোধী কমিটি কার্যকর আছে। এর বাইরে বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটি থাকলেও তাদের কার্যকারিতা নেই।
অন্যদিকে অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও নেই যৌন নিপীড়নবিরোধী কমিটি। এ বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না কোথাও। তবে বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির ভাইস চেয়ারম্যান ও ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী বলেন, ‘আমার ধারণা, অর্ধেকের বেশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ কমিটি আছে। এত দিন সমিতির পক্ষ থেকে বিষয়টি মনিটর করা হয়নি। এবার বিষয়টি নিয়ে আমরা সদস্যদের সতর্ক করে তুলব। সমিতির আগামী সভায় আমি বিষয়টি উপস্থাপন করব।’
গত বছর অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ, সুপ্রিম কোর্টের ২০০৯ সালের নির্দেশনার প্রয়োগ ও কার্যকারিতা’ বিষয়ে একটি গবেষণা চালায়। তাতে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩০ জন নারী শিক্ষার্থীর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। সেখানে দেখা যায়, শিক্ষাক্ষেত্রে যৌন নিপীড়ন রোধে কমিটি গঠনের কথা জানে না ৮৪ শতাংশ শিক্ষার্থী, আদালতের নির্দেশনার কথা জানে না ৮৭ শতাংশ। আর ওই নির্দেশনার কথা কেবল শুনেছে ১৩ শতাংশ। এ ছাড়া কর্মক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশনা সম্পর্কে জানে না ৬৪.৫ শতাংশ এবং নির্দেশনার কথা জানে কিন্তু বিস্তারিত জ্ঞান নেই ১৪ শতাংশের। গবেষণায় তিনটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র একটিতে যৌন নিপীড়ন রোধে কমিটি থাকার তথ্য মেলে।
গবেষণা প্রতিবেদনে সুপারিশ অংশে বলা হয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিজ উদ্যোগে যৌন হয়রানি বন্ধে আদালতের নির্দেশনাটি শিক্ষার্থীদের জানাবে এবং কমিটি গঠন করবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন সেটা তদারকির কাজ করতে পারে। কর্মক্ষেত্রেও একইভাবে সচেতনতা বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ তদারকি করতে পারে। এ ছাড়া সরকারি উদ্যোগেও একটি তদারকি কমিটি থাকা উচিত। একই সঙ্গে সব প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলায় একটি সমন্বিত ‘অ্যাডভোকেসি নেটওয়ার্ক’ গড়ে তোলারও সুপারিশ করা হয়।