মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হবিগঞ্জে নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জাতীয় পার্টির সাবেক নেতা ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রয়েছে। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপিল বিভাগ আজ (মঙ্গলবার ১৪ জানুয়ারি) এই রায় ঘোষণা করেন। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে কায়সারকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত বিচার শুরুর পর আপিলে আসা এটি নবম মামলা, যার ওপর চূড়ান্ত রায় হলো।
ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে কায়সার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করেছিলেন। কায়সারের আপিলের ওপর শুনানি শেষে গত ৩ ডিসেম্বর প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপিল বিভাগ রায়ের জন্য ১৪ জানুয়ারি তারিখ ধার্য করেছিলেন।
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন চার বিচারকের আপিল বেঞ্চ মাত্র এক মিনিটে রায়ের সংক্ষিপ্তসার জানিয়ে দেয়। কায়সারের আপিল আংশিক মঞ্জুর হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের ভিত্তিতে সর্বোচ্চ সাজা বহাল থাকে। এই বেঞ্চের অন্য তিন সদস্য হলেন- বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি জিনাত আরা এবং বিচারপতি মো. নুরুজ্জামান।
ধার্য তারিখে আজ রায় ঘোষণা করলেন আপিল বিভাগ। রায়ে কায়সারের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। রায়ের পর রিভিউ আবেদন করা হবে বলে জানিয়েছেন আসামি পক্ষের আইনজীবী। তাতে সর্বোচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত না বদলালে আসামি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইতে পারবেন। তাতেও তিনি বিফল হলে সরকার সাজা কার্যকরের পদক্ষেপ নেবে।
একাত্তরের মুসলিম লীগ নেতা কায়সার ছিলেন পাকিস্তানি বাহিনীর একজন বিশ্বস্ত সহযোগী। ‘কায়সার বাহিনী’নামে দল গড়ে তিনি যেসব যুদ্ধাপরাধ ঘটিয়েছেন, সেজন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হবিগঞ্জের মানুষ তাকে একজন কুখ্যাত ব্যক্তি হিসাবেই চেনে।
সেই কায়সারই স্বাধীন বাংলাদেশে জিয়াউর রহমানের আমলে হয়ে যান বিএনপির লোক, হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সময় জাতীয় পার্টির; দল বদলের কৌশলে প্রতিমন্ত্রীও বনে যান।
পাঁচ বছর আগে ট্রাইব্যুনাল তার রায়ে বলেছিল, “কায়সার এতোটাই নগ্নভাবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পক্ষ নিয়েছিলেন যে নিজের গ্রামের নারীদের ভোগের জন্য পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দিতেও কুণ্ঠিত হননি।”
সেই রয়ে সাতটি অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল কায়সারকে মৃত্যুদণ্ড দেয়, যার মধ্যে দুই নারীকে ধর্ষণের ঘটনা রয়েছে। এই দুই বীরাঙ্গনার মধ্যে একজন এবং তার গর্ভে জন্ম নেওয়া এক যুদ্ধশিশু এ মামলায় সাক্ষ্যও দেন। আর একটি ঘটনায় ছিল নির্বিচারে হত্যার অভিযোগ।
এছাড়া অপহরণ, আটকে রেখে নির্যাতন ও হত্যায় সংশ্লিষ্টতার চারটি অভিযোগে তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড এবং তিনটি অভিযোগে আরও ২২ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিল যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ মে ট্রাইব্যুনাল কায়সারের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলে সেই রাতেই গ্রেপ্তার করা হয় মুসলিম লীগের এই সাবেক নেতাকে। বয়স ও স্বাস্থ্যগত পরিস্থিতি বিবেচনায় ট্রাইব্যুনালে তাকে শর্তসাপেক্ষে জামিন দেয়।
যুদ্ধাপরাধের ১৬টি ঘটনায় অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে পরের বছর ২ ফেব্রুয়ারি সৈয়দ কায়সারের বিচার শুরু করে ট্রাইব্যুনাল। ওই বিচার শেষে ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ ডিসেম্বর তার মৃত্যুদণ্ডের রায় আসে।
সেই রায়ের পর একাত্তরের এই যুদ্ধাপরাধীকে কারাগারে পাঠানো হয়। আপিল বিভাগের মঙ্গলবারের রায়ের সময় তিনি ছিলেন গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারের কনডেম সেলে।