আমাদের ভাষার নায়ক আহমদ ছফা - দৈনিকশিক্ষা

আমাদের ভাষার নায়ক আহমদ ছফা

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

আলাউদ্দিন খান সাহেব অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা সহ্য করে, অনেক কষ্ট করে, দ্বারে দ্বারে স্বর্ণমুষ্টি ভিক্ষার মাধ্যমে সুদীর্ঘ জীবনের সাধনায় সঙ্গীত আত্মস্থ করেছিলেন। এই আশ্চর্য মানুষটির জীবন এবং তাঁর সাধনার প্রতি দৃষ্টিপাত করলে একটা পবিত্র আতঙ্কের স্রোত শিরদাঁড়ার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। মানুষের ইচ্ছাশক্তি মানুষকে কতদূর নিয়ে যেতে পারে- এ মানুষটির জীবনই তার এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। -আহমদ ছফা

আহমদ ছফা যেদিন মৃত্যুমুখে পতিত হইলেন তাহার দুই কি তিন দিন পর লেখা একটি নিবন্ধে আমি তাঁহাকে ‘আমাদের কালের নায়ক’ উপাধিতে ভূষিত করিয়াছিলাম। তাহাতে কেহ কেহ-কেহ বা মৃদু আর কেহ বা অট্টহাসি হাসিয়াছিলেন। আজ প্রায় দুই দশক হইতে চলিল।

আমার ধারণা এখনও পরিবর্তিত হয় নাই। আহমদ ছফাই এখনও আমাদের কালের নায়ক। কি ভাবের ঘরে কি ভাষার দরবারে তাঁহার সহিত তুলনা দিবার মতন কোন লেখক- অন্তত ভূ-বাংলাদেশে যাঁহারা বাংলায় লেখেন তাঁহাদের মধ্যে- আমি খুঁজিয়া পাই নাই। কেহ যদি দুই চোখে আঙ্গুল প্রবেশ করাইয়া দেখাইয়া দেন আমি চিরবাধিত থাকিব। প্রয়োজনে নিজের নামটা কাটিয়া ফেলিব।

আজিকার নিবন্ধের সীমা আমি শুদ্ধ ভাষার কথায় টানিব। সকলেই জানেন আহমদ ছফা দীর্ঘজীবী হন নাই। দীর্ঘজীবী হইলে অধিক কি করিতেন তাহা ভাবিয়া লাভ নাই। যাহা তিনি করিয়াছেন শুদ্ধ তাহার জোরেই আজ আবার রাষ্ট্র করিব- আহমদ ছফা আমাদের ভাষারও নায়ক বটেন।

আমরা যাহারা দুইচারি কথা বাংলা গদ্যে লিখিয়া থাকি তাহাদের সকলকেই তাঁহার কাছে শিখিতে হইবে। কেহ কেহ হয় তো বলিবেন, আহমদ ছফার তো কোন দর্শন নাই। কবুল করিতে কসুর করিব না, তিনি প্লাতোন কি আরিস্তোতালেসের লেখার ধার বড় ধারিতেন না। কিন্তু বলিব তাঁহার একটা চরিত্র আছে। সেই চারিত্রশক্তিই তাঁহাকে আমাদের ভাষার নায়ক করিয়াছে।

ইংরেজি ২০০১ সালের ফেব্র“য়ারি মাসে মুদ্রিত ‘উপলক্ষের লেখা’ নামক একটি নিরহংকার নিবন্ধ-সংগ্রহই সম্ভবত তাঁহার জীবিতাবস্থায় প্রকাশিত শেষ বই। এই বইয়ের অন্তর্গত একটি নিবন্ধের নাম ‘আচার্য আলাউদ্দিন খান’। নিবন্ধটি লেখা ১৯৯৮ সালের নভেম্বর মাসে।

নিবন্ধের আয়তন বড়জোর এক হাজার শব্দ। এই সামান্য ক্ষেত্রফলের আওতায় তিনি কি অপূর্ব দক্ষতার সহিত আলাউদ্দিন প্রতিভার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ কি নিপুণ ভাষায় নির্ণয় করিয়াছেন! ইহা এক পরম বিস্ময়ের বিষয়। এই নিবন্ধের উদাহরণ টানিয়া আমি দেখাইব কেন- কি ভাবের বিচারে কি ভাষার জোরে- আহমদ ছফার গদ্যশৈলী এহেন তুলনাহীন শক্তির অধিকারী।

‘আচার্য আলাউদ্দিন খান’ নামক নিবন্ধে আলাউদ্দিন খানের সাধনা বা কৃতিত্ব আহমদ ছফা মাত্র তিনটি কথায় তুলিয়া ধরিয়াছেন। খান সাহেবের প্রথম সিদ্ধি ছাত্রস্বরূপে।

ছফা লিখিয়াছেন, ‘আলাউদ্দিন খান সাহেব তাঁর দীর্ঘ জীবনের দুশ্চর তপস্যায় মিয়াঁ তানসেনের ঘরানার সঙ্গীতকে শুধু অধিগত করেননি, অন্যান্য প্রচলিত ঘরানার মর্মবস্তুর সঙ্গে সংশ্লেষ-বিশ্লেষ ঘটিয়ে সঙ্গীতের কান্তিকে অধিকতর উজ্জ্বল এবং ব্যঞ্জনার মধ্যে অধিক দিব্যতা সঞ্চার করে সুরকে এমন দুরধিগম্য উচ্চতায় স্থাপন করলেন যেখানে সুর ব্যক্তিগত অর্জনের সংকীর্ণ সীমারেখা অতিক্রম করে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ার একটা অমোঘ দাবি তুলে ধরল।’

আহমদ ছফার মতে, আলাউদ্দিন খানের দ্বিতীয় সিদ্ধিটি শিক্ষকের ভূমিকায়। তিনি লিখিয়াছেন, ‘সঙ্গীতের ইতিহাসে অনেক অসাধারণ প্রতিভার সন্ধান পাওয়া যায় যাঁরা সুন্দরের আগুনে নিজেদের নিঃশেষ করতে সক্ষম হয়েছিলেন কিন্তু নিজের দাহিকাশক্তিকে অন্যের মধ্যে সঞ্চারিত করা তাঁদের সাধ্যসীমার মধ্যে ছিল না।

সঙ্গীতে অপরকে দীক্ষিত, যোগ্য এবং পারঙ্গম করে তোলার জন্য বিশেষ চারিত্রশক্তির প্রয়োজন। প্রকৃতির দিক থেকে সাধক না হলে এই চারিত্রশক্তি অর্জন করা অসম্ভব।’ আহমদ ছফা দেখিতে পাইয়াছেন, আলাউদ্দিন খান এই সাধক-প্রকৃতি কিছু পরিমাণে উত্তরাধিকারসূত্রে পাইয়াছিলেন বটে কিন্তু কিছুটা সিদ্ধি তিনি নিজের তপস্যার বলেও অর্জন করিয়াছিলেন।

ছফার দৃষ্টিতে, ‘একই ব্যক্তির মধ্যে সাধক এবং শিল্পীর সমন্বয় ঘটার কারণে প্রতিভাবান সঙ্গীতশিল্পীদের মধ্যে যেসব বদগুণের প্রকাশ ঘটতে দেখা যায় আলাউদ্দিন খানকে সেগুলো স্পর্শও করতে পারেনি।’

হয়তো এই কারণেই- ছফার কথায়-‘কুমোর যেভাবে মাটির পুতুল নির্মাণ করে সেভাবে তিনি ছাত্রদের মধ্যে তাঁর ইচ্ছাশক্তিকে ক্রিয়াশীল করে তুলতে পেরেছিলেন। মিয়াঁ তানসেনের সঙ্গীতসাধনার ধারাটি তিনি আপন পুত্র-কন্যা শিষ্য-শিষ্যাদের মধ্যে অধিকতর উজ্জ্বলভাবে জ্বালিয়ে তুলতে পেরেছিলেন।’

আলাউদ্দিন খান সাহেবের তিন নম্বর সিদ্ধিটি ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও পরিবারের গণ্ডি ছাড়াইয়া গিয়াছিল। এই সিদ্ধি সামাজিক। ইহাকে এমন কি ‘বিপ্লব’ বলিতেও আহমদ ছফা কুণ্ঠিত হয়েন নাই। কথাটা আহমদ ছফা এইভাবে বিশদ করিয়াছেন, ‘এ যাবতকাল ধ্রুপদ-সঙ্গীত রাজা-বাদশাহদের দরবারে চর্চিত হয়ে আসছিল। সামন্ত প্রভুদের মর্যাদার স্মারক হিশেবে ধ্রুপদ-সঙ্গীত চিহ্নিত হয়ে আসছিল। সাধারণ মানুষের মধ্যে এই সঙ্গীতের চল একেবারে ছিল না বললেই চলে। এই সঙ্গীতের যাঁরা চর্চা করতেন তাঁরা নিজেদের ঘরানার মধ্যেই সঙ্গীতচর্চা সীমাবদ্ধ করে রাখতেন। আপন পুত্র-কন্যা এবং আত্মীয়-স্বজনের বাইরে অন্য কোন শিক্ষার্থীকে সঙ্গীত শিক্ষা দিতেন না। অনেক সময় জীবিকার তাগিদে বাধ্য কিংবা তাঁদের পৃষ্ঠপোষক কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে বাইরের লোককে সঙ্গীত শিক্ষা দিলেও সঙ্গীতের বিশুদ্ধ অংশটি আপন ঘরানার লোকদের জন্য চোখের মণির মতো সযত্নে গোপন করে রাখতেন। ফলে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর বাইরে ধ্রুপদ-সঙ্গীত কখনো বিস্তারিত এবং প্রসারিত হতে পারত না।’

আহমদ ছফা অধিক গিয়াছেন, ‘আলাউদ্দিন খান সাহেবের আচার্য-জীবনের অভিনবত্ব এইখানে যে তিনি মাইহারে সর্বপ্রথম সর্বসাধারণের জন্য ধ্রুপদ-সঙ্গীতের দুয়ার উন্মুক্ত করে দিলেন। ধ্রুপদ-সঙ্গীত প্রসারের ইতিহাসে খান সাহেবের এই সাহসী পদক্ষেপ রীতিমত একটি বিপ্লব বললে অধিক বলা হবে না।’

আহমদ ছফার ভাষায়, ‘আলাউদ্দিন খান সাহেবের আচার্য-জীবনের মহত্তম কীর্তি হল তিনি সামন্ত-সংস্কৃতির ভেতরে ওতপ্রোত নিমজ্জিত সঙ্গীতের এই সুন্দর ধারাটিকে কোনরকম নান্দনিক বিচ্যুতি না ঘটিয়ে আধুনিক গণতান্ত্রিক যুগের উপযোগী করে তার নতুন জন্ম সম্ভাবিত করেছিলেন। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে বিশেষ একটি গোষ্ঠীর রক্ষণশীল মনোভাব, একচেটিয়াপনার অবসান ঘটানোর জন্য খান সাহেবকে জীবনভর সংগ্রাম করে যেতে হয়েছে।’

আহমদ ছফার এই বিশ্লেষণ বিস্ময়ের বিষয় তাহাতে সন্দেহ নাই। তিনি অতি অল্পকথায় আলাউদ্দিন খান সাহেবের সাধনা ও সিদ্ধির সারমর্ম পেশ করিয়াছেন। তবে যে ভাষায় তিনি এই বিশ্লেষণ দাঁড় করাইয়াছেন তাহাও কম বিস্ময়কর নহে।

আমি আরো খানিকটা উদ্ধৃত করিতে চাহি: ‘উস্তাদ আলাউদ্দিন খান নামটি পূর্ণতার সাক্ষাৎ প্রতীক। আলাউদ্দিনের নামটি স্মরণে এলেই তুষারধবল রৌদ্রকরোজ্জ্বল এমন এক গগনস্পর্শী উত্তুঙ্গ মহিমাশিখরের ছবি দৃষ্টির সামনে উদ্ভাসিত হয় যাঁর শরীর থেকে ক্ষুদ্র-বৃহৎ নদীধারাসমূহ নির্গত হয়ে কলহাস্যে বনভূমি মুখরিত করে সমতলভূমিতে প্লাবন ছুটিয়ে প্রাণতৃষ্ণার তাপে মহাসমুদ্রের মোহনা-সঙ্গমে এসে মিলিত হয়েছে। অতলস্পর্শী মহাসাগরের গভীরতার সঙ্গেও আলাউদ্দিনের তুলনা হতে পারে যেখানে শত শত নদীনির্ঝর অন্তিমযাত্রার প্রবাহ সাঙ্গ করে মধুর লীলাসুখের অনির্বচনীয় আস্বাদ লাভ করে ধন্য হয়েছে।’

এই আচার্য- ওরফে ওস্তাদ- আলাউদ্দিন খানের সাধনা আহমদ ছফার জীবন-সায়াহ্নে একটি উপন্যাসের মধ্যে ধরা পড়িবার উপক্রম করিয়াছিল। তিনি এই উপন্যাসের একটি মাত্র অধ্যায়- ‘সুরসম্রাটের মৃত্যুস্বপ্ন’- শেষ করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। আয়ুতে কুলাইল না বলিয়া অন্য অধ্যায়গুলি আর শেষ করিতে পারেন নাই আহমদ ছফা। দুর্ভাগ্য আমাদের ভাষার! দুর্ভাগ্য আমাদের কালের!

লেখক: সলিমুল্লাহ খান, অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অফ লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ

লেখাটি ২ জানুয়ারি যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত 

অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি - dainik shiksha চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0054020881652832