আর নয় আকাশভাঙা আর্তনাদ - দৈনিকশিক্ষা

আর নয় আকাশভাঙা আর্তনাদ

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

আমেরিকান রাজনীতিবিদ টমাস জেফারসন (১৭৪৩-১৮২৬) বলেছেন, ‘দুঃখ ভারাক্রান্ত চিঠি বারবার পাঠ করতে নেই।’ নিশ্চয়ই তাতে মানুষের মন ভেঙে যেতে পারে। কিন্তু আমরা নিরুপায়, আমাদের কাছে আসা সব বার্তাই দুঃখ ভারাক্রান্ত, সুখকর কিছুর সন্ধান নেই যে! চারদিকে কেবলই হতাশা-নিরাশার বার্তাবর্ষণ। তার ওপর গেল সপ্তাহে যে দুঃখের বার্তা আমাদের কাছে এসেছে, তাতে হৃদয় যে কেবল ভাঙা কিংবা ভারাক্রান্ত হওয়ার ভেতর সীমাবদ্ধ থাকবে তা নয়, বরং নিঃশেষিত হয়ে যেতে পারে। রোববার (১৩ অক্টোবর) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে সরকারি দলের সহযোগী ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরা।

হত্যাকাণ্ডের কারণ ও ধরন এতটাই বর্বরোচিত ছিল যে, বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের হৃদয় আঁতকে উঠেছে। এদের মধ্যে একটি অংশ রাগে-দুঃখে-ক্ষোভে ফুঁসে উঠে রাস্তায় বিক্ষোভে নেমেছে, আর আরেকটি অংশ শোকে পাথর হয়ে নির্বাক-নিস্তব্ধ! ফেসবুকে অনেকেই মর্মস্পর্শী, হৃদয়বিদারক স্ট্যাটাস ও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। এমন একজন মানুষ পাওয়া যাবে না যার ভেতর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার জন্ম হয়নি। সবাই এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু ও দ্রুত বিচারের দাবি তুলেছেন, যা ষোল আনা যৌক্তিক।

একটি অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর আমরা তার বিচারের দাবিতে সোচ্চার হই। ক্ষেত্রবিশেষে কোনো কোনোটির বিচার হয়, বেশিরভাগেরই হয় না। অনেকেই মনে করেন, এই বিচারহীনতার সংস্কৃতিই পুনঃ পুনঃ অপরাধের জন্ম দেয়। তা অবশ্যই ঠিক; কিন্তু যখন রাষ্ট্র বা সরকার বা তার সংশ্লিষ্ট কেউ অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়, তখন মানুষের দাবি বা চাওয়া বিনা বাক্যে উপেক্ষিত হয়। ‘সাধারণভাবে অপরাধ বলতে সমাজ কর্তৃক শাস্তিযোগ্য কোনো অন্যায় আচরণকে বোঝায়। এ সংজ্ঞার একটি বড় দুর্বলতা হচ্ছে, এতে সমাজের জটিল সমস্যাকে আড়াল করা হয়। কোনো সমাজই চিরস্থির নয়। আসলে প্রতিনিয়ত সমাজ পরিবর্তিত হচ্ছে। একইভাবে অপরাধপ্রবণতা ও এর ধরনও প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। আবার সমাজভেদে অপরাধ আচরণের ভিন্নতা লক্ষ করা যায়।’ বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে, আরও নির্দিষ্ট করে বললে, বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নতুন কিছু নয়, তাই বলে তাকে স্বাভাবিক বলাটা যুক্তিযুক্ত নয়। আবার কোনো একক রাজনৈতিক দলকেও দোষারোপ করাটা কাঙ্ক্ষিত নয়। কিন্তু আবরার হত্যার ঘটনাটি যতখানি পশুত্বের জন্ম দিয়েছে ততটা বোধকরি অতীতে হয়নি। তাই সারা বাংলাদেশ এতটা উত্তাল হয়ে উঠেছে, ক্ষোভে ফেটে পড়েছে। কাউকে তোয়াক্কা না করার যে বেপরোয়া-একতরফা রাজনৈতিক সংস্কৃতি চলছে, আবরারের রক্তক্ষরণ এর একটা উপসর্গ মাত্র। সরকারি দলের ছাত্রসংগঠন যেভাবে বেপরোয়া হয়ে উঠছে তাতে আগামীতে ভিন্নমতের মানুষ কেন, নিজেদেরও রেহাই দেবে না, অন্তত অতীত তাই বলে। ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল, এই ৫ বছরে ছাত্রলীগের নিজেদের কোন্দলে প্রাণ হারিয়েছে ৩৯ জন। আর ছাত্রলীগের দ্বারা অন্য সংগঠনের সদস্য নিহত হয় ১৫ জন।
বুয়েট আমাদের গর্ব- ক্রিয়ার কালে এটা অতীত কাল। আবরারের মৃত্যু আমাদের শুধু বেদনার সাগরে ভাসায়নি, একইসঙ্গে দেশের গর্বস্থানীয় প্রতিষ্ঠানের একটা ক্ষয়িষ্ণু অবস্থার জানান দিয়ে গেল। শুধু আবরারের শেরেবাংলা হলে নয়, আরও একাধিক হলে নাকি রয়েছে সরকারি ছাত্রসংগঠনের ‘টর্চার সেল’। ভিন্নমতের শিক্ষার্থী হলেই তাকে সেই সেলে নিয়ে গিয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। এমনকি ‘র‌্যাগিং’য়ের নামে বিনা দোষে হাসতে হাসতে ‘সিনিয়র’ জুনিয়রকে চড়-থাপ্পড় মেরে আনন্দ-উল্লাস করা হয়- এ তো রীতিমতো ‘বিকৃত বিনোদন’। একাধিক যুবলীগ নেতার টর্চার সেলের কথা আমরা সংবাদমাধ্যমের বদৌলতে জেনেছি; তাই বলে বিশ্ববিদ্যালয়ে, এমনকি আমাদের গর্বের বুয়েটেও!

যেহেতু বুয়েটকে আমরা একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠান মনে করে এসেছি, তাই এর প্রধান নির্বাহী উপাচার্যকেও আদর্শ ভাবাটা স্বাভাবিক। কিন্তু না, তাতেও আমরা হতাশ, তার আচরণে আমরা মর্মাহত! তিনি ৩০ ঘণ্টা অতিবাহিত হওয়ার পরও ক্যাম্পাসে ১০ কদম এগিয়ে এসে আবরারের লাশ দেখতে গেলেন না, অথচ যখন গদি যাওয়ার উপক্রম হয়েছে তখন ২০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে কুষ্টিয়ায় এসে আবরারের কবরে হাজির। এলাকাবাসীর তোপের মুখে পুলিশের সাহায্য নিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। আমাদের প্রাণের বুয়েটের ভিসি সাহেবের এই হাল, এই রুচি? শোকাহত মনেও তার একটি কথায় হাসি পেয়েছে- ‘আমি তো দোষ করিনি, পদত্যাগ করব কেন?’ দোষ-ত্রুটির কারণে মানুষ পদচ্যুৎ হয়, আর স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে ব্যর্থতা, দায়বোধকে স্বীকার করে। এতে মাহাত্ম্যই প্রকাশ পায়। একটি রেল দুর্ঘটনার জন্য ভারতের রেলমন্ত্রী পদত্যাগ করেছিলেন। তার কোনো দোষ ছিল না, ছিল না কোনো দাবিও। কিন্তু তিনি বলেছিলেন, রেলের সার্বিক দায়দায়িত্বকে আমি অস্বীকার করতে পারি না। বুয়েট ক্যাম্পাসে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই অত্যাচার-অনাচার রোধ করতে বুয়েটের ভিসি কি অক্ষম ছিলেন, নাকি তাতে ভিসির সমর্থন ছিল? প্রথমটি হলে তিনি ব্যর্থ আর দ্বিতীয়টি হলে তিনি অপরাধী; দুটির কোনোটিই ভিসি পদে বহাল থাকার জন্য উপযুক্ত নয়। নৈতিকভাবেই তিনি ওই পদে থাকার অযোগ্য।

এককভাবে বললে আবরারের বাবা-মা আজ সন্তানহারা, তাদের একটি সুন্দর স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। কিন্তু সার্বিকভাবে যদি চিন্তা করি তাহলে দেখব, বাবা-মা’র ক’জন কুসন্তান আবরারকে খুন করল- তাদের সন্তানরা থেকেও নেই, তাদের স্বপ্নও ভেঙে চুরমার। আমি বিশ্বাস করি না, এইচএসসি পর্যায়ের কোনো খুনি কিংবা অপরাধী মানসিকতার ছাত্র বুয়েটের মতো একটি প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পায়। যারা ভর্তি হয় তারা পাড়া-মহল্লায় অতিশয় সমাদৃত। এমনকি সেসব শিক্ষার্থীর বাবা-মাকেও এ সমাজ সমীহ করে, দেখে সম্মানের চোখে। সেই টপ স্কোরাররা, স্বপ্নের সন্তানরা ক্যাম্পাসে গিয়ে কীভাবে অমানুষ হয়ে যায়? কারা তাদেরকে অমানুষ হতে প্রেরণা জোগায়? কোন অভিশাপী রাজনৈতিক কুসংস্কৃতি তাদেরকে নরকের দিকে টেনে নিয়ে যায়? আবরার হত্যার বিচারের পাশাপাশি আমাদের এসব প্রশ্নের সঠিক জবাব খুঁজে বের করতে হবে। তা না হলে পাইপ লাইনে থাকা আরও শত আবরারকে আমাদের হারাতে হবে নিশ্চয়ই।

কেউ কেউ দাবি তুলেছেন, দেশে ছাত্র রাজনীতির আজকের যে হাল তারপরও তা চলতে দেয়া যায় না, বন্ধ করে দেয়া উচিত। আমি তাদের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমতও নই, আবার বিরোধিতা করতেও পারছি না, কারণ হল বাস্তব অবস্থা। একমত পোষণ করতে পারছি না এ কারণে যে, আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে ছাত্রদের ’৫২, ’৬৬, ’৬৯, ’৭১ আর ’৯০-এর মহান গৌরবগাথা দিনগুলো। আর বিরোধিতা করতে পারছি না এ কারণে যে, আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে ছাত্র রাজনীতির নামে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, পার্সেন্টেজ, নিয়োগ বাণিজ্য, একচেটিয়া ক্ষমতা, খুন আর অসহিষ্ণুতা। এটা ঠিক যে উন্নত দেশগুলোতে ছাত্র রাজনীতির প্রকোপ আমাদের মতো নয়। কিন্তু পাশাপাশি এটাও মনে রাখতে হবে, সেসব দেশে অপরাধের সামাজিকায়ন ঘটেনি। নরওয়ে, নিউজিল্যান্ডের মতো শান্তিপ্রিয় দেশেও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হয়, তবে তা সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নেয়নি, জবাবদিহিতা অনেকখানি শক্তিশালী। আমাদের দেশে সামাজিক অবস্থা অত্যন্ত নাজুক, আর জবাবদিহিতা তো জবরদস্তির ডাকনাম। যে কারণে এখানে সৃজনশীল ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজন আছে। কিন্তু বাদ সাধবে ‘সৃজনশীল’ কথাটা নিয়ে। এত কলঙ্ককে মুছে ফেলে, এত অভিশাপকে মোচন করে ছাত্র রাজনীতিকে প্রকৃত ধারায় ফিরিয়ে আনা যাবে কিনা, এ নিয়ে সন্দেহ দূর করা সম্ভব নয়। তাই, ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি যারা করছেন, তাদের সমর্থন না করলেও বিরোধিতা করা যাচ্ছে না।

একটি ছাত্রসংগঠনের চরিত্র কেমন হবে তা নির্ভর করে তার অভিভাবক জাতীয় রাজনৈতিক দলটির চরিত্র কেমন তার ওপর। জাতীয় রাজনীতিতে বর্তমান আওয়ামী লীগের দৃষ্টিভঙ্গি ও চর্চার প্রকৃতির ওপর নির্ভর করেই ছাত্রলীগ গড়ে উঠবে। জাতীয় রাজনীতির চরিত্রের বাইরে এককভাবে ভিন্ন কোনো সত্তা নিয়ে গড়ে ওঠা কোনো সংশ্লিষ্ট সংগঠনের পক্ষে অসম্ভব। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, জবরদস্তি, পরমতসহিষ্ণুতার অনুপস্থিতি, খুন, দলবাজি ও গণতন্ত্র চর্চার অভাব আমাদের জাতীয় রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে পরিলক্ষিত হচ্ছে। জাতীয় রাজনীতির ধারা পরিবর্তন না করে কেবল ছাত্র রাজনীতির চরিত্র পরিবর্তন করার কথা চিন্তা করা কোনোভাবেই বিজ্ঞানসম্মত নয়। তাই প্রথমেই প্রয়োজন জাতীয় রাজনীতিতে পরিবর্তন আনা। এর কোনো প্রকার ইঙ্গিত আমরা আপাতত না দেখলেও কাল থেকে দেখতে চাই। তা না হলে মুখের কথা মুখেই থেকে যাবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সংবাদমাধ্যমে আবরার হত্যার বিচারে অনমনীয় পদক্ষেপের কথা উচ্চারণ করেছেন। আমরা তার বলিষ্ঠ উচ্চারণের প্রতি আস্থাশীল। কিন্তু আশঙ্কার কথা হল, কেবল একজন আবরারের খুনিদের বিচারে সীমাবদ্ধ থাকলে তা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য তেমন কোনো সুখকর ফল বয়ে আনবে না। প্রয়োজন হল খুনি তৈরির যে প্রক্রিয়া তা সমূলে উৎপাটন করা। তা না হলে দু’দিন পরপরই আমরা আরও শত আবরারের মায়ের ‘আকাশভাঙা আর্তনাদ’ শুনতে পাব। আমি আবরার ফাহাদের আত্মার শান্তি কামনা করছি- যার বেশি কিছু করতে আজকে অক্ষম। ক্ষমা করো আবরার।

মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য - dainik shiksha হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক - dainik shiksha সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি - dainik shiksha ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার - dainik shiksha রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0075840950012207