যুবলীগ দক্ষিণের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট তার প্রধান আস্তানা কাকরাইলের ভূঁইয়া ট্রেড সেন্টারে একটি বিশেষ কক্ষে একটি ভল্ট রাখতেন। সেই ভল্টে ন্যূনতম কোটি টাকা থাকত। আর ভল্টের সব হিসাব-নিকাশ দেখভাল করতেন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু যুবলীগ দক্ষিণের সহসভাপতি এনামুল হক আরমান। মূলত সম্রাটের 'ভল্ট ম্যানেজার' ছিলেন আরমান। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর পরপরই কাকরাইলের ওই কার্যালয়ের ভল্টের অর্থ সরিয়ে ফেলা হয়। তাই গত রোববার সম্রাটকে গ্রেফতারের পর কাকরাইলের কার্যালয়ে তল্লাশি করে ভল্টে গচ্ছিত কোনো অর্থ পাওয়া যায়নি। মূলত 'নজরানা' ও চাঁদাবাজির অর্থ কাকরাইলের ভল্টে রাখা হতো। একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। শুক্রবার (১১ অক্টোবর) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন সাহাদাত হোসেন পরশ।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এদিকে, গণপূর্ত বিভাগের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কিছুদিন ধরে শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ও যুবলীগ পরিচয়ধারী জি কে শামীমের সঙ্গে সম্রাটের বিরোধ চলছিল। এ বিরোধের জেরে সম্রাটকে হত্যার পরিকল্পনা করছিল জিসান। মূলত জিসান ও জি কে শামীমের লোকজনই গণপূর্ত বিভাগের টেন্ডার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল। এই নিয়ন্ত্রণ নিজের কাছে নিতে তার ঘনিষ্ঠ লোকজনকে গণপূর্তে বসানোর চেষ্টা করে আসছিলেন সম্রাট। জি কে শামীম ও জিসানের কারণে সেটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি তার। এ নিয়ে জিসান ও জি কে শামীমের সঙ্গে তার ঠাণ্ডা লড়াই চলছিল। এ ছাড়া জিসান দেশত্যাগ করার আগে জি কে শামীমের সব সাম্রাজ্য দেখভাল করত। সে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার পর জি কে শামীম তার আলাদা দেহরক্ষী নিয়োগ করে। তার আগে জিসানই তার দেহরক্ষীর মতো ছিল।
জানা গেছে, কাকরাইলের ভূঁইয়া ট্রেড সেন্টারের একটি ফ্লোর কেনা ছিল সম্রাটের এক ভাইয়ের নামে। আরেকটি ফ্লোর কেনা হয় মোস্তফা জামান পপির নামে। এ দুই ফ্লোর ছাড়া পুরো ভবনের দখল নেন সম্রাট। বছরের পর বছর ধরে মালিকপক্ষকে একটি টাকাও ভাড়া দেননি তিনি। তদন্ত-সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, যুবলীগের অনেক নেতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থাকলেও দক্ষিণ যুবলীগের সহসভাপতি আরমান ছিলেন সম্রাটের অত্যন্ত প্রিয়ভাজন। ১৮ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার অভিযান শুরুর পর অনেক নেতাকর্মী গা-ঢাকা দিলেও আরমান সম্রাটের সঙ্গে ছিলেন ছায়ার মতো। গ্রেফতারের আগ পর্যন্ত তারা দু'জন একসঙ্গে ছিলেন। গ্রেফতার হন একই সঙ্গে।
জানা গেছে, এনামুল হক আরমানের রাজনীতি শুরু বিএনপি দিয়ে। ক্ষমতার পালাবদলে তিনিও দল পরিবর্তন করেন। নাম লেখান যুবলীগে। ঢাকা দক্ষিণ মহানগর যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটকে 'গুরু' মানেন আরমান। ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের সহসভাপতির পদও বাগিয়ে নেন। এরপর খুব কম সময়ের মধ্যে আঙুল ফুলে কলাগাছ হন আরমান। একসময়ের গুলিস্তানের লাগেজ ব্যবসায়ী আরমান এখন শতকোটি টাকার মালিক। অবৈধ টাকা বৈধ করতে সিনেমায় কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। চলচ্চিত্র জগতেও আধিপত্য ছিল তার। নিজেই 'দেশ বাংলা মাল্টিমিডিয়া' নামে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান খোলেন। আরমানের প্রযোজনায় এ পর্যন্ত একটি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে, যার নাম 'মনের মত মানুষ পাইলাম না'। পরে 'আগুন' নামে আরেকটি সিনেমার শুটিং শুরু হয়।
এদিকে সম্রাট, আরমান, খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াসহ অনেকের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের হিসাব নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি দেশে-বিদেশে একাধিক প্রতিষ্ঠানে তাদের সম্পদের ব্যাপারে খোঁজ নিতে চিঠি দিয়েছে। সিআইডির একজন কর্মকর্তা জানান, সম্পদের উৎস দেখাতে ব্যর্থ হলে এখন যারা কোটি কোটি টাকার মালিক, তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত হবে। রাতারাতি তারা 'ফকিরেও' পরিণত হতে পারে।
এদিকে, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ভর্তি সম্রাটের শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল বলে জানিয়েছেন সংশ্নিষ্ট চিকিৎসক। তার ব্লাড সুগার, ইলেকট্রোলাইট, বিলোরবিন, ইসিজি ও ইকোকার্ডিওগ্রাফি করানো হয়েছে। এর রিপোর্টে সম্রাটের পিত্তথলিতে পাথর আছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া বাকি সব রিপোর্টে অবস্থা স্বাভাবিক রয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে কারাগারে ফেরত পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে।