রাস্তায় শিক্ষক: লজ্জা ও দায় কার? - দৈনিকশিক্ষা

রাস্তায় শিক্ষক: লজ্জা ও দায় কার?

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

দেশটা বড় অভাবে এখন , তাইনা ?  শিক্ষকের উপযুক্ত মর্যাদা দিতে রাষ্ট্রের সাধ্যে কুলোয় না । আমরা আবার মধ্যম আয়ের দেশ ! ধিক্কার আমাদের । ধিক্ আমাদের সব অর্জন । স্বাধীনতা লাভের চার যুগ অতিবাহিত হবার পর দুনিয়ার কোন দেশে শিক্ষকরা ন্যুনতম মর্যাদা ও কোনমতে খেয়ে পরে বাঁচার জন্যে আন্দোলন করেন ?

পুরো আট বছরে একটি স্কুল, কলেজ কিংবা মাদরাসা এমপিও পেলো না । সারাদেশে মাত্র পাঁচ-ছ' হাজার নন এমপিও প্রতিষ্ঠান। প্রতি বাজেটে এক হাজার করে এমপিও দিলে তো আট বছরে সব প্রতিষ্ঠান এমপিও পেয়ে যেত । খুব শরম ও লজ্জার কথা । এ  কারো একার শরম নয় । এ লজ্জা রাষ্ট্রের । এ লজ্জা গোটা জাতির ।  অপ্রয়োজনে কিংবা সামান্য প্রয়োজনে রাষ্ট্রের হাজার কোটি টাকা গচ্ছা যায় । কেবল শিক্ষকদের ভাগ্যে ন্যুনতম বেতনটুকু জোটে না ?  গত ক'বছরে হলমার্ক কেলেংকারী , শেয়ার বাজার কেলেংকারি, ডেসটিনি ও ব্যাংক কেলেংকারীতে কী রাষ্ট্রের হাজার কোটি টাকা বেপথে যায় নাই ?

আমাদের মন্ত্রি-এমপিদের মোবাইল ফোন কেনার জন্য পঁচাত্তর হাজার টাকা রাষ্ট্র বরাদ্দ দিতে পারে । শিক্ষকদের সামান্য একটু বেতন ভাতা দিতে পারে না । আজকাল হাজার-বারশ' টাকায় মোবাইল কেনা যায় । সে জায়গায় পঁচাত্তর হাজার টাকা (! ) । আপত্তি থাকতো না যদি শিক্ষকরা ন্যুনতম খেয়ে পরে বাঁচার জন্য খোলা আকাশের নীচে পড়ে না থাকতেন । 'শিক্ষক জাতি গঠনের কারিগর' কিংবা 'শিক্ষক সম্মানের পাত্র' বলে বলে শিক্ষকদের আর কত টকানো হবে কে জানে?

আজ কারা কোটি কোটি টাকার মালিক ? রাষ্ট্রের সম্পদ কারা লুটেপুটে খায় ?  যে শিক্ষক নিজের তাজা রক্ত পানি করে জাতির অনাগত ভবিষ্যত রচনায় দিনান্ত পরিশ্রম করে জীবন যৌবন বিনাশ করেন,  তার প্রাপ্তির খাতা কেবলি শুন্যে ভরা ।

শিক্ষকদের প্রতি এত অবহেলা ও অমনোযোগ সম্ভবত দুনিয়ার আর কোথাও নেই । দেশে যে আটাশ-উনত্রিশ হাজার প্রতিষ্ঠানের এমপিও আছে তার পাঁচ-সাড়ে পাঁচ লাখ শিক্ষক কর্মচারী ই বা ক'টাকা বেতন পান ?  তাদের দিকে একটু তাকালে শিক্ষকদের প্রতি রাষ্ট্রের উদাসীনতা  সুস্পষ্ট হয়ে উঠে । পিয়ন থেকে প্রিন্সিপাল পর্যন্ত  বাড়ি ভাড়া এক হাজার টাকা ।  আজকাল একেবারে সাদামাটা কোন আবাসিক হোটেলে দু'রাত ঘুমালে হাজার টাকা ভাড়া আসে । আমাদের শিক্ষা মন্ত্রি তো একবার বলেছিলেন, একরাত ফুটপাতে থাকলে সন্ত্রাসীদের একশ' টাকা চাঁদা দিতে হয়। সে অনুভুতি থেকে তিনি শিক্ষকদের বাড়ি ভাড়া দ্বিগুণ ( ! ) করে হাজার টাকায় উন্নীত করে বাহবা কুঁড়াবার চেষ্টা করেন । পাঁচগুণ (!) করে চিকিৎসা ভাতা পাঁচশ' টাকা করেন । আজকাল অনেক ডাক্তারের ভিজিট হাজার টাকা । পাঁচশ' টাকার কমে তো কারো ভিজিট নেই । আমাদের ডাক্তার সা'বদের ভাগ্য খুবই প্রসন্ন । প্রাইভেট প্র্যাকটিসে তারা ইচ্ছেমত গলাকাটা ফি নেন । কেউ কিচ্ছু বলে না । মাত্র দু' মিনিটে রোগীর চেকআপ শেষ । মিনিমাম ফি পাঁচশ' টাকা । আর শিক্ষক পুরো মাস পড়িয়ে তিনশ' টাকা নিলে সেটি কোচিং বাণিজ্য হয়ে যায় । প্রজ্ঞাপন জারি হয় । কোচিং বন্ধে নানা উদ্যোগ । আমি বরাবর কোচিংয়ের বিপক্ষে । কিন্তু, যে শিক্ষক ন্যুনতম বেতন পান কিংবা আদৌ পান না তিনি কোচিং না পড়িয়ে বাঁচেন কী করে ?  পরিবার পরিজন বাঁচাবেন কীভাবে ? পরিবার পরিজন বাঁচাতে শিক্ষক হয়ে তো আর চুরি কিংবা ডাকাতিতে যেতে পারেন না । তাহলে দায়ে পড়ে কোচিং পড়ালে শিক্ষক দায়ী হবেন কেন ? এ দায় সরকারের । এ দায় রাষ্ট্রের ।

এমপিও নীতিমালা জারি হলো । তাতে তো ভাল কিছু খুঁজে পাইনে । এমপিওভুক্তির জন্য যোগ্য ও অযোগ্য প্রতিষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে । যে প্রতিষ্ঠান কুড়ি-পঁচিশ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত সেটির যোগ্যতা-অযোগ্যতা খোঁজাখুজি না করে শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিও দেয়া অপরিহার্য । পাঠদানের অনুমতি ও স্বীকৃতি দেবার সময় যোগ্যতা-অযোগ্যতা যাচাই বাছাই তো অবশ্যই করা হয়েছে । তাহলে এখন আবার নতুন করে যোগ্যতা ও অযোগ্যতার কথা ওঠে কেন ? 

শোনা যাচ্ছে এবার এক হাজারের মত প্রতিষ্ঠান এমপিও পাবে । দয়া করে তা না করে সব স্বীকৃতিপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানকে এমপিও'র আওতায় নিয়ে আসুন । সবার বেতন ভাতা একসাথে দিতে না পারলে কয়েক কিস্তে দেন । তবু এমপিও নামক সোনার হরিণের পেছনে শিক্ষক-কর্মচারীদের আর ঘুরিয়ে কষ্ট দিয়েন না ।

প্রায় এক মাস ধরে ন্যুনতম মর্যাদা ও কোনমতে খেয়ে পরে বাঁচার তাগিদে নন এমপিও শিক্ষকগণ ঢাকার রাজপথে পড়ে আছেন । তাঁদের সম্মানের সাথে বাড়ি ফিরে যাবার সুযোগটা করে দিন । অনেক মা শিক্ষক নিজের দুধের শিশুকে বাড়ি ফেলে রেখে  মরা-বাঁচার আন্দোলনে এখন ঢাকায় । সত্যি এ বড় কষ্টের বিষয় । সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ সাহেব সেদিন বলেছেন -'শিক্ষক রাজপথে আর মাদক ব্যবসায়ী সংসদে'। তার এ কথায় শিক্ষকদের প্রতি রাষ্ট্রের উদাসীনতার বিষয়টি ফুটে উঠেছে । রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও ক্ষমতা অপব্যবহারের বিষয়টি ও তিনি আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দিয়েছেন । এক সময় শুনতাম দেশে কোটিপতি বাইশ পরিবার । এখন বাইশ পরিবারের জায়গায় বাইশ হাজার পরিবার হয়েছে । কেবল এ দেশে শিক্ষকদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন নেই । কুড়ি টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেতন নিয়ে এ দেশের বেসরকারী শিক্ষকদের চাকুরীর সুচনা হয়েছিল । তারপর কত আন্দোলন সংগ্রাম করে করে আজকের অবস্থান । দ্বিগুণ (!) বাড়ি ভাড়া , পাঁচগুণ (!) চিকিৎসা ভাতা পেতে ও তাদের বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে । জানিনে, এদেশের বেসরকারি শিক্ষকদের বঞ্চনা ও অবহেলার আগুণে আর কত জ্বলে পুড়ে ছাই হতে হবে।

শিক্ষক না হয় জ্বলে পুড়ে ছাই হলেন । কিন্তু শিক্ষাকে বাঁচানো কী অপরিহার্য নয় ?  শিক্ষা বাঁচাতে শিক্ষক বাঁচানো চাই । শিক্ষক না বাঁচলে শিক্ষা বাঁচার আর কোন পথ নেই ।

লেখক: অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট,  সিলেট ও দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।

রোজায় স্কুল: শিক্ষার্থী উপস্থিতি কম, নজরদারিও ঢিলেঢালা - dainik shiksha রোজায় স্কুল: শিক্ষার্থী উপস্থিতি কম, নজরদারিও ঢিলেঢালা পেনশন প্রজ্ঞাপনে উদ্বিগ্ন ঢাবি উপাচার্য - dainik shiksha পেনশন প্রজ্ঞাপনে উদ্বিগ্ন ঢাবি উপাচার্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গবেষণা অনুদান করমুক্ত - dainik shiksha শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গবেষণা অনুদান করমুক্ত ব্রাজিলে তীব্র গরমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ - dainik shiksha ব্রাজিলে তীব্র গরমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের নামে প্রতারণা, সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের নামে প্রতারণা, সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উচ্চ মাধ্যমিকের সমমান পেলো ‘হেট’ - dainik shiksha উচ্চ মাধ্যমিকের সমমান পেলো ‘হেট’ আটকের ১৩ দিন পরেও বরখাস্ত হননি অধ্যক্ষ - dainik shiksha আটকের ১৩ দিন পরেও বরখাস্ত হননি অধ্যক্ষ please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0032708644866943