অনেক বছর আগের কথা। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সাধারণ বিভাগে একটি বিছানায় শুয়ে আছি। আমার জন্ডিস হয়েছিল। যা খাই তাই বমি করি। কাহিল অবস্থা। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর ডাক্তারের পরামর্শে একটানা প্রায় পনেরো দিন হাসপাতালেই থাকতে হয়েছে। তখনকার দিনে আত্মীয়-স্বজন বলতে তেমন কেউ ঢাকায় ছিল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে পড়ি। ক্লাসের বন্ধুরাই মাঝেমধ্যে খোঁজ নেয়। আর আসে আমার নাটকের দলের কর্মীরা। প্রতিদিন বিকেলে আমার বেডের সামনে একধরনের আড্ডা শুরু হয়।
এক দিনের ঘটনা। বিকেলে একটু চোখ লেগেছে। অর্থাৎ ঘুমিয়ে পড়েছি। হঠাৎ চোখ খুলতেই দেখি একজন লোক আমার বিছানার পাশে টুলের ওপর মাথা নিচু করে বসে আছেন। লোকটি আর কেউ নন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের জনপ্রিয় শিক্ষক আহাদুজ্জামান মোহাম্মদ আলী। তাঁর আরো অনেক পরিচয় আছে। সেটা না-ই বা উল্লেখ করলাম। প্রিয় শিক্ষককে হাসপাতালে আমার বিছানার পাশে এভাবে বসে থাকতে দেখে প্রথমে বিশ্বাসই হচ্ছিল না। আমি ছাত্র হিসেবে খুব যে একটা আহামরি টাইপের ছিলাম, তা-ও তো নয়। সাধারণ মানের ছাত্র। ইত্তেফাকে বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার হিসেবে সাংবাদিকতা শুরু করেছি। পত্র-পত্রিকায় ছোটগল্প লিখি। ‘ঠিকানা’ নামে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বানিয়েছি। টিভির জন্য নিয়মিত নাটক লিখি। একটি নাটকের দলের নেতৃত্ব দিই।
পড়াশোনার বাইরে এটাই আমার জগৎ। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, প্রিয় শিক্ষক আহাদুজ্জামান মোহাম্মদ আলী আমার এই কাজগুলোকে দারুণভাবে উৎসাহিত করতেন। তাই বলে তিনি আমাকে হাসপাতালে দেখতে আসবেন—এটা ছিল কল্পনারও বাইরে। স্যারকে দেখে ধড়ফড় করে বিছানা থেকে উঠে বসতে গিয়ে বাধা পেলাম। অতি নরম কণ্ঠে স্যার আমাকে বললেন, প্লিজ, উঠো না। শুয়ে থাকো! তিনি আমাকে শেষ পর্যন্ত বিছানা থেকে উঠতে দিলেন না। বিছানায় শুয়েই স্যারকে জিজ্ঞেস করলাম, কতক্ষণ হলো এসেছেন? ডান হাতের কবজি উল্টে ঘড়ি দেখে মৃদু হেসে বললেন, তা প্রায় ৪০ মিনিট হবে। তোমার ম্যাডামও (সিতারা পারভিন, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের আরেক জনপ্রিয় শিক্ষক, স্যারের স্ত্রী) এসেছেন। তাঁকে বাইরে গাড়িতে বসিয়ে রেখে এসেছি।
স্যারের কথা শুনে নিজেকে যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। একজন শিক্ষক তার অসুস্থ ছাত্রের বিছানার পাশে ৪০ মিনিট ধরে চুপ করে বসে আছেন। অসুস্থ ছাত্র ঘুমাচ্ছে। তার ঘুমের ব্যাঘাত যেন না ঘটে, সে জন্য ছাত্রকে একবারও ডাক দেননি। সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে হাসপাতালের বাইরে গাড়িতে বসিয়ে রেখে এসেছেন। প্রসঙ্গ টেনে বললেন, তোমার ম্যাডামকে হাসপাতালের ভেতরে আনা গেল না। কারণ প্রেগন্যান্ট মহিলাকে হাসপাতালে অ্যালাউ করা হয় না। তবে তোমার ম্যাডাম তোমার জন্য দোয়া করেছেন। তুমি শিগগিরই ভালো হয়ে যাবে। বলেই স্যার আমার মাথায় হাত রাখলেন। প্রিয় পাঠক, বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, সৃষ্টিকর্তার অপার রহমতে সেদিনই আমি সুস্থ হয়ে যাই। পরের দিন হাসপাতাল ত্যাগ করি।
এ তো বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের গল্প। স্কুলজীবনের একটি গল্প বলি। কুড়িগ্রাম জেলা শহর থেকে পাঁচ-সাত মাইল দূরের স্কুল দুর্গাপুর দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে আমি এসএসসি পরীক্ষায় পাস করি। অ্যালজ্যাবরা বুঝতাম না। গসাগু, লসাগু আমার কাছে খুব কঠিন মনে হতো। রাজেন্দ্রনাথ বিএসসি নামে আমাদের একজন শিক্ষক অঙ্ক পড়াতেন। তিনিই এক দিন আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন, কাল থেকে তুমি রোজ সকালে প্রথমে আমার বাড়িতে আসবে। সেখানেই সকালের নাশতা খাবে। আমি তোমাকে অঙ্ক শেখাব। তারপর দুজনে মিলে একসঙ্গে স্কুলে যাব। আমার গ্রামের বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব প্রায় চার কিলোমিটার। স্কুল পেরিয়ে প্রিয় শিক্ষকের বাড়ি যেতে বাড়তি আরো তিন কিলোমিটার পথ। তবু স্যারের কথায় দারুণ উৎসাহবোধ করলাম। ছুটির দিন বাদে প্রতিদিন সাত মাইল পথ হেঁটে সকালে স্যারের বাসায় যাই। স্যার পরম মমতায় আমাকে অঙ্ক শেখাতেন। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, স্কুলের ওই প্রিয় শিক্ষক রাজেন্দ্রনাথ বিএসসি আমাকে অঙ্ক শিখিয়েছিলেন বলেই আমি হয়তো পরবর্তী সময়ে জীবনের হিসাব-নিকাশ বুঝতে শিখেছি।
স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, কালের কণ্ঠ’র দশম জন্মদিন উপলক্ষে শিক্ষক সম্মাননা প্রদানের ব্যাপক আয়োজনের সংবাদ পেয়ে আজকের এই লেখাটি লেখার উৎসাহ পেয়েছি। শিক্ষক সম্মাননা। দেশের একটি প্রথম সারির দৈনিক পত্রিকার জন্মদিন উপলক্ষে এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আয়োজন আর হতে পারে না। আজ যাঁরা রাষ্ট্র ও সমাজের বিভিন্ন স্তরে দায়িত্ব পালন করছেন, তাঁদের সবারই স্মৃতির আয়নায় স্কুল-কলেজ অথবা বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের একাধিক শিক্ষক, শিক্ষয়িত্রী পরম মমতায় আসন গেড়ে বসে আছেন। তাঁদের আমরা কি কোনো দিন আনুষ্ঠানিকভাবে ধন্যবাদ বলেছি? কালের কণ্ঠ’র নান্দনিক এই আয়োজনকে প্রেরণা হিসেবে গ্রহণ করে ১০ জানুয়ারি আমরাও কি নিজেদের প্রিয় শিক্ষক-শিক্ষিকাকে ধন্যবাদ জানাতে পারি না? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাবে আমরা চিঠি লিখতেই ভুলে গেছি। কিন্তু প্রিয় শিক্ষক অথবা শিক্ষিকাকে ধন্যবাদ জানাতে লিখে ফেলতে পারি একটি কৃতজ্ঞতাপত্র।
অথবা তাঁর জন্য পাঠাতে পারি ফুলের শুভেচ্ছা অথবা কোনো উপহার। ভাবতে পারেন কতটা আনন্দ পাবেন তিনি? কালের কণ্ঠ’র জন্মদিন ঘিরে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের সেই সোনালি অতীতকে বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা যেতে পারে অতি সহজেই। ঢাকায় কেন্দ্রীয় আয়োজনের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় প্রতিনিধিদের মাধ্যমেও কালের কণ্ঠ গোটা দেশে প্রিয় শিক্ষককে ধন্যবাদ জানানোর রেওয়াজ চালু করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ দেশের ৬৪টি জেলার কালের কণ্ঠ প্রতিনিধি যদি ১০ জন করেও স্থানীয় গুণী শিক্ষককে ‘ধন্যবাদ, স্যার’ শীর্ষক সম্মাননা জানানোর উদ্যোগ নেন, তাহলে একই দিনে সারা দেশে ৬০০-রও অধিক গুণী শিক্ষক-শিক্ষিকা আলোচনায় উঠে আসবেন। প্রিয় শিক্ষককে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য একটি বিশেষ দিন থাকলে কী এমন ক্ষতি হবে? ওই দিন দেশের সব শিক্ষক-শিক্ষিকা সম্মানিত হবেন। এর ফলে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই একটা ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা দেবে। কালের কণ্ঠ’র পাশাপাশি আপনি নিজেও প্রিয় শিক্ষক অথবা শিক্ষিকাকে ‘ধন্যবাদ’ জানাতে পারেন অনায়াসেই। এ জন্য আপনার ইচ্ছাশক্তিই যথেষ্ট। জগতের সব শিক্ষক-শিক্ষিকার প্রতি রইল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। ধন্যবাদ, স্যার।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক-আনন্দ আলো
সূত্র: ইত্তেফাক