ইংরেজি মাধ্যমে বাংলা অলিম্পিয়াড, বাংলা মাধ্যমে নয় কেন? - Dainikshiksha

ইংরেজি মাধ্যমে বাংলা অলিম্পিয়াড, বাংলা মাধ্যমে নয় কেন?

মাছুম বিল্লাহ |

দেশের ইংরেজি মাধ্যম ও ইংলিশ ভার্সন স্কুলের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে  গত ২৩ ফেব্রুয়ারি  অষ্টমবারের মতো অনুষ্ঠিত হলো  ‘বাংলা অলিম্পিয়াড’। নিঃসন্দেহে এটি একটি চমৎকার উদ্যোগ। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ইন্টারন্যাশনাল হোপ স্কুল বাংলাদেশ অষ্টমবারের মতো এই বাংলা অলিম্পিয়াডের আয়োজন করে। 

দেশের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বাংলাদেশে অধ্যয়নরত বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য এ প্রতিযোগিতা উন্মুক্ত ছিল। সারা দেশের শতাধিক ইংলিশ মিডিয়াম ও ইংলিশ ভার্সন স্কুলের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে  অনন্য একটি দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে। আমরা দেশের ইংলিশ মিডিয়াম বিদ্যালয়গুলো নিয়ে মাঝে মাঝে বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক কথাবার্তা শুনে থাকি। যেমন- ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা বাংলাকে অবজ্ঞা করে। তারা ভিনদেশি কালচারে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। দেশি কালচারকে ভিন্ন চোখে দেখে ইত্যাদি।
 
দেশের ৭১টি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের দেড় হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী বাংলা অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করে। শিক্ষার্থীরা ছয়টি ক্যাটাগরি যেমন- কবিতা আবৃত্তি, সঙ্গীত, চিত্রাঙ্কন, উপস্থিত বক্তৃতা, নৃত্য ও রচনা  প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়।  ইন্টারন্যাশনাল হোপ স্কুলের অধ্যক্ষ বলেন, ইংরেজি মাধ্যম স্কুল হলেও মাতৃভাষা বাংলায় যেন শিক্ষার্থীরা দক্ষতা অর্জন করতে পারে, আমরা সেই চেষ্টা করে যাচ্ছি। শুধু আমাদের স্কুল নয়, সারা দেশের ইংরেজি মাধ্যম ও ইংরেজি ভার্সন স্কুলগুলোকেও বাংলা চর্চায় যুক্ত করছে এই আয়োজন। আমরা অধ্যক্ষকে এই উদ্যোগের জন্য ধন্যবাদ জানাই।
বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের বাংলা শেখা, শুদ্ধ বাংলায় লেখা বা কথা বলার অবস্থা কী? শিক্ষার্থীদের ধারণা আছে, তারা সব কিছু দেখছে, প্রত্যক্ষ করছে, কোন বিষয়ে  সুবিধা কিংবা অসুবিধা ভোগ করছে তার ওপরেই যদি কিছু লিখতে দেয়া হয়, তারা লিখতে পারে না। তাদের মেধা আছে, প্রাকটিস করালেই তারা করতে পারবে। কিন্তু আমাদের বিদ্যালয়গুলোতে সেভাবে করানো হয় না। শেখানো হয় না। ফলে, তাদের বাংলা শেখাটা হয়ে ওঠে না। ক্লাসের বাইরের বই তাদের পড়ার জন্য উৎসাহিত করা হয় না। গুরুত্ব দেয়া হয় না। কোচিং এবং পরীক্ষার চাপে রেখে মুক্ত জ্ঞান আহরণ করার সুযোগ দেয়া হয় না।

এই অবস্থা তথাকথিত ভালো বিদ্যালয়গুলোসহ সর্বত্রই এক। কাজেই বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়গুলোতেও বাংলা অলিম্পিয়াড চালু করা প্রয়োজন। তাহলে শিক্ষার্থীরা সাধারণ নিয়মের বাইরে গিয়ে বাংলা শেখার সুযোগ পাবে। আনন্দের মাধ্যমে বাংলা শিখতে পারবে; যেটি তাদের ক্লাসরুমে করা সম্ভব হয় না। আমি অনেক শিক্ষককে এমনকি  ভালো শিক্ষকদেরকেও  স্থানীয় বাংলায় কথা বলতে দেখেছি। আমি তাদেরকে বিভিন্নভাবে অনুরোধ করেছি; যেখানে সম্ভব কঠোরভাবে বলেছি, তারা যাতে স্থানীয় কিংবা অশুদ্ধ বাংলায় কথা না বলেন। কারণ তাদের কাছ থেকে শিক্ষার্থী যারা ভবিষ্যতে দেশকে নেতৃত্ব দেবে, বাংলা শিখবে, আচার আচরণ শিখবে। 

বিষয়টিতে যারা গুরুত্ব প্রদান করেন তারা ভালো করেন। তাদের কাছে শিক্ষার্থীরা ভালো বাংলা  শিখতে পারে। এ বিষয়ে সরকারের বিশেষ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি নিদের্শনা থাকাও প্রয়োজন; শিক্ষকগণ শ্রেণিকক্ষে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, কোনো অনুষ্ঠানে ও শিক্ষার্থীদের সাথে যেন সব সময়ই শুদ্ধ বাংলা ব্যবহার করেন। তা না হলে শিক্ষার্থীরা স্থানীয় এবং অশুদ্ধ বাংলায় কথা বলা শিখবে, তার প্রভাব তাদের লেখায়ও থাকবে। 
একটি স্ট্যান্ডার্ড ও সুশৃঙ্খল ভাষারীতি আমাদের অনুসরণ করা উচিত প্রাথমিক, মাধ্যমিক  ও উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। যেটি আমরা করছি না। আমার এক বন্ধু সহকর্মী যিনি বাংলার শিক্ষক। তিনি বলছিলেন, নোয়াখালী এলাকার একটি কলেজে শিক্ষার্থীরা নকল করার সময় তিনি ধরে ফেলেন। তারপর থেকে ঐ কলেজের শিক্ষার্থীরা তাকে বলত ‘আন্নে আদের রুহুর তোন উডি গ্যাছেন।’ এই হলো কলেজে শিক্ষার্থীদের ভাষা ব্যবহারের নমুনা। 

তবে হ্যাঁ, স্থানীয় ভাষা ব্যবহার করা আমাদের এক ধরনের ঐতিহ্য। কিন্তু সেটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ব্যবহার করা কতটা ঠিক? আমরা ভাষা ব্যবহার করি ভাব বিনিময় করার জন্য। মনের ভাব প্রকাশের জন্য। অন্যের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য। আমাদের চাহিদা পূরণ করার জন্য। শিক্ষাদানের জন্য। শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য, কাউকে কোনো ম্যাসেজ দেয়ার জন্য। সে বাংলা অবশ্যই হতে হবে প্রমিত বাংলা।  

বরিশালের স্থানীয় বাংলা ভাষা নোয়াখালীতে যারা স্থানীয় ভাষায় কথা বলেন, তারা বুঝতে পারেন না। আবার নোয়াখালীর স্থানীয় ভাষা বরিশালে কিংবা চট্টগ্রামের মানুষ বুঝতে পারেন না। একইভাবে সিলেট অঞ্চলের স্থানীয় ভাষা অন্যান্য এলাকার মানুষ বুঝতে পারেন না। এটি স্বাভাবিকভাবেই  হতে পারে। কিন্তু দেশের সর্বত্র ব্যবহার করার জন্য আমরা অবশ্যই একটি ভাষা ব্যবহার করব যা সবাই এবং সব অঞ্চলের মানুষ  বুঝতে পারবেন। সেটি হতে হবে আঞ্চলিক প্রভাবমুক্ত ও একই রকম। 

ইংরেজি মাধ্যম স্কুল ডন বসকো স্কুল অ্যান্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী  বাংলা অলিম্পিয়াডে ‘রচনা প্রতিযোগিতায়’ অংশগ্রহণ করে। তাকে বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক স্থান নিয়ে রচনা লিখতে হয়েছে। সে এই বিষয়ে চার পৃষ্ঠা লিখেছে এবং বলেছে যে, তার লিখতে কোনো সমস্যা হয়নি বরং ভালো লেগেছে। ইন্টারন্যাশনাল হোপ স্কুলের আর এক শিক্ষার্থী  অংশ নেয় নাচ প্রতিযোগিতায়। সে বলেছে, আমাদের স্কুলে বাংলায় বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয়। আমি আজ বাংলা গানের সঙ্গে যে নাচটা করেছি সেটি স্কুল থেকেই শেখানো হয়েছে। 

ইংরেজি মাধ্যমের এ রকম অনেক বিদ্যালয় রয়েছে যারা শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা বিকাশের সাথে সাথে বাংলা ভাষা শেখানো ও ব্যবহার করাসহ শুদ্ধ বাংলা ব্যবহারের ওপর বেশ জোর দিয়ে থাকে। আমরা ঐসব ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়গুলোকে সালাম জানাই। বাংলা অলিম্পিয়াডের সমন্বয়ক কামরুল আহসান বলেন, সারা বছরই আমাদের স্কুলগুলোতে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা চর্চা হয়। তবে ভাষার মাসে এই আয়োজনের মাধ্যমে আমরা শিক্ষার্থীদের বাংলা চর্চায় আরো উৎসাহিত করছি। এ বছর আমরা ব্যাপক সাড়া পেয়েছি।আমাদের বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়গুলোরও এই পথ অনুসরণ করা উচিত যাতে আমাদের শিক্ষার্থীরা প্রমিত বাংলা উচচারণ ও লেখা শিখতে পারে, তাদের সৃজনশীলতার সঠিক বিকাশ ঘটাতে পারে। 

বর্তমানে অতিরিক্ত টিভি, ভিডিও গেম, মোবাইল, ল্যাপটপ দেখা ও ব্যবহার করার  ফলে বাচ্চাদের ভাষা ব্যবহার করতে এবং শিখতে  বিভিন্ন রকম সমস্যা দেখা দিচ্ছে। একটি সমস্যা হচ্ছে, বাচ্চা কথা বলছে ঠিকই কিন্তু তার কথা কেউই বুঝতে পারছে না। একইসঙ্গে বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি কার্টুন বা অনুষ্ঠান দেখার ফলে এমনটি হয়। এ রকম কিছু  বাচ্চা ‘উ’ বা ‘ই’ বিচিত্র ধরনের শব্দ করে কিছু বোঝাতে চায়। কিন্তু ঠিকমতো বোঝাতে পারছে না। বাসায় বাবা-মা বা বড়দের কাছে শুনছে অশুদ্ধ ও স্থানীয় বাংলা। ফলে একটা জগাখিচুড়ি পাকিয়ে যায় তাদের বাংলা ভাষা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে। 

আমরা বাংলাভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছি অথচ আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যদি সঠিকভাবে বাংলা বলতে এবং লিখতে না পারে তাহলে এই দিবস পালন কতটা স্বার্থক হচ্ছে সেটি একটি প্রশ্ন। আমরা আমাদের ভাষা শহিদদের সম্মানে ২১ ফেব্রুয়ারি  আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা অর্জন করেছি। অথচ শুদ্ধ বাংলা ব্যবহারে আমরা যদি সতর্ক না হই, মাতৃভাষাকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন না করি তাহলে পুরো বিষয়টিতে একটি ফাঁকা থেকে যাচ্ছে। ইদানিং প্রাইভেট রেডিও চ্যানেলগুলোতে এবং টিভি চ্যানেলের কিছু কিছু অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ও উপস্থাপিকা বাংলার সাথে ইংরেজি মিলিয়ে স্মার্টনেস দেখাতে চান। এটিকে অবশ্য কেউ কেউ বলছেন তারা দর্শক শ্রোতা অর্থাৎ কাস্টমারদের খুশি করার জন্য এ ধরনের ভাষা ব্যবহার করেন। তবে, বাংলা ভাষা ব্যবহার করার সময় তাদের সম্মানের সাথে তা ব্যবহার করা উচিত। 

কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বিদেশে পড়ে আসা এমনকি বাংলাদেশের কিছু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা করে  আসা  তরুণরা  এমন ভাব দেখান যে, বাংলা বলতে তাদের খুব কষ্ট হয়। এই ধরনের ন্যাকামিকে আবার অনেক কর্তৃপক্ষ খুব পছন্দ করেন এবং গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। কিন্তু এ ধরনের ন্যাকামি আমাদের বুঝতে হবে এবং ভবিষ্যৎ বংশধরদের, আমাদের শিক্ষার্থীদের এ থেকে মুক্ত রাখতে হবে। 

লেখক: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক, ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিকে কর্মরত 
 

এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ - dainik shiksha এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ - dainik shiksha পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী - dainik shiksha ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ - dainik shiksha প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0038609504699707