এতদিন শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ও ইংরেজির কথা শোনা গেছে। এর বাইরেও অবশ্য প্রাক প্রাথমিক, প্রাথমিক, কিন্ডারগার্টেন, ইবতেদায়ি ও মাদ্রাসা শিক্ষা রয়েছে। যা হোক, দেশে প্রচলিত শিক্ষার প্রধান দুটি মাধ্যম হচ্ছে ইংরেজি ও বাংলা। ইংলিশ মিডিয়ামের কয়েকটি স্কুল-কলেজ থাকলেও অধিকাংশই বাংলা মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অধিকাংশ শিক্ষার্থীও তাই। তবে ইদানিং আবার শোনা যাচ্ছে, ইংলিশ ভার্সনের পাঠ্যবইয়ের কথা। বিষয়টি ঠিক কী ও কেন তা বোধগম্য নয় আমাদেরও। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে যে, কিছুসংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী মূলত বাংলা মাধ্যমে লেখাপড়া করলেও পরীক্ষায় অবতীর্ণ হচ্ছে বাংলা পাঠ্যবইয়ের ইংরেজি ভার্সন পড়ে।
তবে এসব বই মূলানুগ অনুবাদ নয়, বরং যথেচ্ছ ও মর্জিমাফিক অনুবাদ। ফলে শিক্ষার্থীরা কাঙ্ক্ষিত ফল পেতে ব্যর্থ হচ্ছে। অন্যদিকে বিষয়টি শেখাও হচ্ছে না যথাযথভাবে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির রসায়ন ও জীবন বিজ্ঞান বই দুটির কথা। বাংলা মাধ্যমে রচিত বই দুটির প্রথম অধ্যায় বিস্তৃত ৭ পৃষ্ঠা জুড়ে। ইংলিশ ভার্সনে এটি শেষ করা হয়েছে মাত্র এক পৃষ্ঠায়। এখন বাস্তবতা হলো, যত বড় মহাপণ্ডিতই এটি অনুবাদ করে থাকুন না কেন, সাত পৃষ্ঠার বক্তব্য এক পৃষ্ঠায় অনুবাদ করা, তাও আবার বিজ্ঞানের মতো দুরূহ ও জটিল বিষয়ে কখনই সম্ভব নয়।
ফলে ইংলিশ ভার্সনের শিক্ষার্থীরা স্বভাবতই অসম্পূর্ণ ও ভুলভাল শিখে পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়ে কাঙ্ক্ষিত ফল অর্জন করতে পারছে না। উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তিও হতে পারছে না বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যত্র। অথচ বাংলা মাধ্যমে যেসব শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিচ্ছে তারা ভাল করছে এবং ভর্তিও হতে পারছে কাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয় অথবা বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এও সত্য যে, ইংলিশ ভার্সন পড়ানোর জন্য যোগ্য শিক্ষকও নেই অধিকাংশ স্কুল-কলেজে। বছরের পর বছর ধরে এ রকম অর্বাচীন শিক্ষাই চলছে এনসিটিবির তত্ত্বাবধানে।
সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতে, ইংরেজি ভার্সনের শিক্ষার্থীদের জন্য বাংলা পাঠ্যপুস্তকের হুবহু ও নির্ভুল অনুবাদ হওয়া অত্যাবশ্যক। বাস্তবে তা আদৌ হচ্ছে না। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) তা হচ্ছে বলে দাবি করলেও প্রকৃতপক্ষে তা হচ্ছে না। জানা মতে, এনসিটিবি নিজস্ব কোন দক্ষ অনুবাদক ও সম্পাদকমণ্ডলী নেই। ফলে তাদের অনুমতি নিয়ে বাংলা মাধ্যমের কোন কোন অনুবাদ করে প্রকাশ হয়ে থাকে বেসরকারি প্রকাশক, যাদের যোগ্যতা ও দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ফল যা হওয়ার তাই হচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনুমোদনহীন এসব বই পড়ে একদিকে যেমন প্রতারিত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা, অন্যদিকে পরীক্ষায় অকৃতকার্যসহ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতেও ব্যর্থ হচ্ছে।
এক কথায় বা সহজে এর প্রতিকার পাওয়া সম্ভব নয়। প্রথমত এনসিটিবি যেখানে বাংলা মাধ্যমের পাঠ্যপুস্তকই নির্ভুল ও সুচারুভাবে বের করতে পারে না, সেখানে নির্ভুল ও সুপাঠ্য ইংলিশ ভার্সন প্রকাশ করবে কীভাবে? এর পাশাপাশি ইংলিশ ভার্সনের নামে যেসব বই প্রতিবছর প্রকাশিত হচ্ছে এবং পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে, তা আদৌ চালু রাখা সঙ্গত কিনা তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। কেননা শিক্ষার বদলে যা অশিক্ষা ছড়িয়ে দেয়, তা না ছাপাই ভাল। মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশে উন্নত দেশের মতো দক্ষ ও অভিজ্ঞ অনুবাদক ও টেক্সবুক ডেভেলপার নেই। সুতরাং এই জগাখিচুড়ি তথা কেঁচে গণ্ডুস শিক্ষাব্যবস্থা বর্জন করাই শ্রেয়।