ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত রাজধানীর সাত সরকারি কলেজে 'স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস' কোর্সটি পড়াচ্ছেন ইতিহাস ছাড়াও অন্য বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষকরা। কোর্সটি স্নাতক পর্যায়ের সব শিক্ষার্থীর জন্য বাধ্যতামূলক। শুক্রবার (১২ এপ্রিল) সমকালের এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান এমনকি দর্শন বিষয়ের শিক্ষকদের দিয়েও পাঠগ্রহণ চলছে ইতিহাসের এ কোর্সটির। ইতিহাস বিষয়ের শিক্ষকদের মধ্যেও একধরনের ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে এ বিষয়টি নিয়ে। কেবল ক্লাস নেওয়াই নয়, বিষয়টির প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও খাতা মূল্যায়নও করা হচ্ছে নানা বিষয়ের শিক্ষকদের দিয়ে। এ কোর্সটি পাঠদানের ক্ষেত্রে অত্যন্ত বিশৃঙ্খল, জটিল ও অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
রাজধানীর এ সাতটি কলেজ হলো সরকারি তিতুমীর কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, ঢাকা কলেজ, বেগম বদরুননেসা কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, সরকারি বাঙ্লা কলেজ ও সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজ।
এ কলেজগুলো ২০১৭ সালের আগে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত ছিল। ২০১৩ সালে 'স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস' কোর্সটি সারাদেশে স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়। তখন থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সারাদেশের প্রায় দুই হাজার কলেজে ইতিহাসের শিক্ষকরাই এটি পড়াতেন। ২০১৭ সালে রাজধানীর সাতটি কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অধিভুক্ত হয়।
গত বছরের ১৩ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সাত কলেজকে এক আদেশে জানায়, 'স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস' কোর্সটি ইতিহাসের পাশাপাশি ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষকরাও পড়াতে পারবেন। এরপর থেকেই মূলত এ বিষয়টি নিয়ে গোলমেলে অবস্থার সৃষ্টি হয়। বর্তমানে এ সাতটি কলেজে এ তিনটি বিভাগের শিক্ষকরা এটি পড়ানোর পাশাপাশি প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও খাতা দেখার কাজও করছেন।
এ পরিস্থিতি উত্তরণে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) কর্তৃপক্ষ গত ৩১ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে লেখা এক চিঠিতে, 'স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস' কোর্সটি পড়ানোর জন্য ইতিহাস বিষয়ের শিক্ষকদেরই দায়িত্ব দেওয়ার অনুরোধ জানায়। তবে গত তিন মাসেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাতে কর্ণপাত করেনি।
সরেজমিন গিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর ঢাকা কলেজে শেখ ইশতিয়াক নামে সাভারের একটি বেসরকারি কলেজের দর্শন বিষয়ের শিক্ষকও 'স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস' কোর্সটি পড়াচ্ছেন। শিক্ষকরা জানান, তিনি ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ মোয়াজ্জেম হোসেন মোল্লার ঘনিষ্ঠজন। তারা বলেন, রাজধানীর এ সাতটি কলেজে ইতিহাস বিষয়ের প্রায় অর্ধশত শিক্ষক কর্মরত রয়েছেন। কোনো কারণেই অন্য বিষয়ের বেসরকারি কলেজের শিক্ষক এনে পাঠদান করানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই।
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর ৩ নম্বর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যে বলা হয়েছে- শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করে তোলা ও তাদের চিন্তা-চেতনায় দেশাত্মবোধ, জাতীয়তাবোধ ও তাদের চরিত্রে সুনাগরিকের গুণাবলির বিকাশ ঘটানো। এর আলোকে সরকারি কলেজ ইতিহাস শিক্ষক পরিষদ ২০১০ সালের ১৬ এপ্রিল তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রীর উপস্থিতিতে এক কর্মশালায় বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাস আবশ্যিক পাঠ্যকরণের দাবি তোলে। এরই একপর্যায়ে এসে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ২০১৩ সালের ২১ জুলাই এক গণশুনানির আয়োজন করে। এতে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, অধ্যাপক মেসবাহ কামাল, অধ্যাপক তাইবুল হাসান খান, অধ্যাপক মোহাম্মদ সেলিম, ড. সুলতানা নিগার চৌধুরীসহ বরেণ্য শিক্ষকরা যুক্তি ও তথ্য দিয়ে ইতিহাস বিষয়টি আবশ্যিকভাবে পাঠ্যকরণের দাবি তোলেন। এরপর ওই বছর থেকেই 'স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস' কোর্সটি স্নাতক স্তরে আবশ্যিক পাঠ্য করা হয়। গত পাঁচ বছর ধরে এটি ইতিহাসের শিক্ষকরাই পড়িয়ে আসছেন সারাদেশে। ২০১৭ সালে রাজধানীর সাতটি কলেজ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়। এর পরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গত বছরের ১৩ মে ইতিহাসের বিষয় ছাড়াও রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ের শিক্ষকদের এটির পাঠদানের সঙ্গে যুক্ত করে।
রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মঞ্জুমা হক বলেন, 'এ কোর্সটি পুরোপুরি ইতিহাস বিষয়ের একটি কোর্স। আবশ্যিক করার পরে টানা পাঁচ বছর ইতিহাসের শিক্ষকরাই এটি পড়িয়েছেন, প্রশ্ন করেছেন, খাতা দেখেছেন। হঠাৎ করে এতদিন পরে অন্য বিষয়ের শিক্ষকদের এটি পাঠদানের দায়িত্ব দেওয়ার যৌক্তিকতা কোনোভাবেই থাকতে পারে না।'
ঢাকা কলেজের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আবদুল কুদ্দুস সিকদার বলেন, 'ইতিহাস বিভাগের শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফসল হিসেবে এ কোর্সটি চালু করে সরকার। কোর্স বাধ্যতামূলক করার ক্ষেত্রে একমাত্র অবদান তাদের। তাই তাদেরই শুধু এ কোর্স পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া উচিত।'
এ বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তপন কুমার পালিত বলেন, বিশেষায়িত একটি বিষয়ের পাঠদান ওই বিষয়ের শিক্ষকদের দিয়েই করতে হয়। 'স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস' কোর্সটি ইতিহাসের শিক্ষকদের দিয়েই পড়াতে হবে। ইতিহাস আর রাষ্ট্রবিজ্ঞান এক নয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আবশ্যিক বিষয় হওয়ায় এ বিষয়ের বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর পাঠদান, খাতা দেখা ও প্রশ্ন প্রণয়নের সঙ্গে আর্থিক লাভের বিষয় রয়েছে। এ কারণে ইতিহাসের বিষয় হলেও 'স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস' কোর্সটির প্রতি কলেজগুলোর অন্য বিষয়ের শিক্ষকদেরও নজর পড়েছে। এ নিয়ে কলেজগুলোতে শিক্ষকদের মধ্যে শুরু হয়েছে দ্বন্দ্ব। এর ফলে কোর্সটি পাঠদানে সৃষ্টি হয়েছে অচলাবস্থা।
উদ্ভূত অবস্থায় ইউজিসির পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ম্যানেজমেন্ট বিভাগের পরিচালক মো. কামাল হোসেন গত ৩১ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানকে ইউজিসির সিদ্ধান্ত জানিয়ে লেখা এক চিঠিতে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত কলেজে 'স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস' কোর্সটি উক্ত কলেজসমূহের শুধু ইতিহাস বিভাগের শিক্ষকরা পাঠদান, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও উত্তরপত্র মূল্যায়ন করতে পারবেন। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে উপাচার্যকে অনুরোধ করা হয় এ চিঠিতে।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় অনুষদের ডিন এবং ওই সাত কলেজের সমন্বয়ক অধ্যাপক ড. শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম বলেন, 'সাত কলেজের সব কলেজে ইতিহাসের পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই। শিক্ষক কম, ছাত্র বেশি। শিক্ষক স্বল্পতা থাকলে ইসলামের ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষকদের দিয়ে পাঠদান করাতে অধ্যক্ষদের বলা হয়েছে। যেসব কলেজে ইতিহাসের পর্যাপ্ত শিক্ষক আছে, সেখানে এটি দরকার হবে না।'