ইতিহাস বিকৃতি : ঢাবি শিক্ষকের শাস্তি না হওয়ায় ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের ক্ষোভ - দৈনিকশিক্ষা

ইতিহাস বিকৃতি : ঢাবি শিক্ষকের শাস্তি না হওয়ায় ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের ক্ষোভ

ঢাবি প্রতিনিধি |

জাতির পিতা, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য ও ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান খানকে দায়িত্ব থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়ার পর দুই বছরেও তার বিরুদ্ধে স্থায়ী ব্যবস্থা না নেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ।

২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ মার্চ একটি জাতীয় দৈনিকের স্বাধীনতা দিবস সংখ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপি-জামায়াতপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দলের যুগ্ম-আহ্বায়ক মোর্শেদ হাসান খান ‘জ্যোতির্ময় জিয়া’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লেখেন।
সেখানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবমাননা এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ এনে পরদিন বিক্ষোভ করেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।

বিক্ষোভে ওই শিক্ষকের কুশপুতুল পোড়ানোর পাশাপাশি তাকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। অধ্যাপক মোর্শেদকে বরখাস্ত করার দাবিতে উপাচার্যের কাছে স্মারকলিপিও দেওয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিও ওই লেখার প্রতিবাদ ও নিন্দা জানায়।

পরে ২ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান খানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক সকল কার্যক্রম থেকে সাময়িকভাবে অব্যাহতি দিয়ে উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে।

আরও পড়ুন: ইতিহাস বিকৃতির দায়ে ঢাবি শিক্ষককে গ্রেফতার দাবিতে রাজপথে নামছে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ

ওই কমিটির প্রতিবেদনে অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ার কথা বলা হলে মোর্শেদ হাসান খানের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়,তা নিয়ে আইনি সুপারিশ করতে গত বছর ৩০ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমকে দায়িত্ব দেয় বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট।

গত বছর ২৯ মে এক লিখিত সুপারিশে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান তার লেখায় স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে যা লিখেছেন তা সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরিপন্থি। সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের পরিপন্থি। তিনি ১৯৭১ এর ২৫ মার্চের পরে যে আন্দোলনের চিত্র এঁকেছেন তা সংবিধানের সপ্তম অনুচ্ছেদে বর্ণিত বক্তব্যের পরিপন্থি। অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান খানের বিতর্কিত লেখাটি সংবিধানের ষষ্ঠ ও সপ্তম তফসিলে বর্ণিত তথ্যের পরিপন্থি ও ইতিহাসের বিকৃতি।”
শাস্তির সুপারিশ করে এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “আমার মতে, তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া উচিত। সিন্ডিকেটের অন্যান্য সদস্যরা যদি আমার সঙ্গে একমত পোষণ করেন, সেক্ষেত্রে অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খানকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি থেকে অব্যাহতির বিষয়টি উল্লেখ করে তাকে পুনরায় কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া যেতে পারে।”

ওই সুপারিশের পর বিষয়টি অধিকতর পর্যালোচনা ও শাস্তির সুপারিশ করে প্রতিবেদন দিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট সদস্য ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট এএফএম মেজবাহউদ্দিনকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের একটি ‘বিশেষ ট্রাইবুন্যাল’ গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

ওই ট্রাইবুন্যালে মোর্শেদ হাসান খানের পক্ষে সমন্বয় করতে সাদা দলের যুগ্ম-আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. লুৎফর রহমানকে রাখা হয় । এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য হিসেবে ওই ট্রাইবুন্যালে ছিলেন সাবেক ছাত্রনেতা মো. লিয়াকত হোসেন মোড়ল।

এররপর প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি ওই ট্রাইবুন্যাল। তবে সেপ্টেম্বর মাসে অনুষ্ঠেয় সিন্ডিকেট সভার আলোচ্যসূচিতে বিষয়টি রাখা হতে পারে বলে জানা গেছে।

নয়া দিগন্তে প্রকাশিত অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান খানের সেই নিবন্ধ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক খন্দকার বজলুল হক বলেন, “আমি বারবারই বলছি, বিষয়টির দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া দরকার। বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত হলে বাদী ও বিবাদী দুই পক্ষের জন্যই ভাল। না হলে নানা কথা হবে, গসিপ হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর অমর্যাদা কোনোভাবেই কাম্য নয়।’’
তিনি বলেন, “যেহেতু বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে, চূড়ান্ত রায় পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করা উচিত। শিগরিরই সিন্ডিকেটের সভা হবে। সেখানে আমি বিষয়টি নিয়ে কথা বলব।”

২০১৮ এর ২৬ মার্চ  দৈনিক নয়া দিগন্তে প্রকাশিত ‘জ্যোতির্ময় জিয়া’ নিবন্ধে অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান খান লেখেন, “আওয়ামী নেতাদের বেশিরভাগই স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তাদের পরিবার পরিজনসহ ভারতে চলে গেলেন এ দেশবাসীকে মৃত্যু ফাঁদে ফেলে  দিয়ে নেতৃত্বহীন অবস্থায়। যাকে ঘিরে এ দেশের মানুষ স্বপ্ন দেখত সেই শেখ মুজিবুর রহমানও। জাতির এ সঙ্কটকালীন মুহূর্তে ত্রাতারূপে আবির্ভূত হন তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান। দেশপ্রেমের মহান মন্ত্রে উজ্জীবিত এই টগবগে যুবকের কণ্ঠে ২৬ মার্চ রাতে বজ্রের মতো গর্জে ওঠে স্বাধীনতার ঘোষণা। স্বাধীনতার ডাক এসেছিল শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেপ্তার হওয়ার পর, তার আগে নয়। আমার জানা মতে, তিনি কোনো স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি।”

নিবন্ধের আারেক জায়গায় স্বাধীনতার পরের বর্ণনা দিতে গিয়ে মোর্শেদ হাসান লিখেছেন, “দেশবাসী দেখলো শেখ মুজিব একদলীয় বাকশালী শাসনব্যবস্থা চালু করে নিজেই যেন দাঁড়িয়ে গেলেন নিজের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে। ১৯৭২ থেকে ৭৫-এর ১৫ অগাস্টের আগ পর্যন্ত দেশে বাক স্বাধীনতা বলতে কিছুই ছিল না।”

এর আগে ২০১৬ এর ৩০ মে দৈনিক যায়যায়দিন পত্রিকায় ‘স্মৃতিময় জিয়া’ শিরোনামে এক লেখাতেও অধ্যাপক মোরশেদ হাসান খান একই ধরনের বক্তব্য দেন।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এখনও তার বিরুদ্ধে স্থায়ী ব্যবস্থা না নেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস ফেইসবুকে লিখেছেন, “জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে এমন মন্তব্য করা কেউ তো মানুষ নামের অযোগ্য, আবার কেমনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মত এমন প্রগতিশীল একটা উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক হন, এটা চিন্তার বিষয়!

“আবার রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তার সুপারিশকেও কোন অদৃশ্য শক্তির কারণে মূল্যায়ণ করা হচ্ছে না এটা দুশ্চিন্তার বিষয়, তবে যাই হোক, আশা করি কালক্ষেপণ না করে অচিরেই এই জাতীয় কুলাঙ্গার শিক্ষককে চিরতরে অব্যাহতি দিয়ে সংবিধান ও জাতির পিতাকে অবমাননা করার শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।”

ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য বলেন,“জাতির পিতাকে অবমাননা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি করে এতদিন পর্যন্ত বহাল তবিয়তে আছে, এটা খুবই দুঃখজনক ঘটনা। ছাত্রলীগ ওই শিক্ষককে আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে। অবিলম্বে বিষয়টি সমাধান করা হোক এবং এই শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করা হোক।”

এদিকে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের সংগঠন ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ মোর্শেদ হাসান খানকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চাকরিচ্যুত করার দাবিতে মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে। এ বিষয়ে উপাচার্য বরাবর স্মারকলিপি দেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক আল মাহমুদ।
এ বিষয়ে কথা বলতে অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান খানকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি কেটে দেন।  

তবে সাদা দলের আহ্বায়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অধ্যাপক লুৎফর রহমান বলেন, “তিন সদস্য বিশিষ্ট ট্রাইবুনালে সিন্ডিকেট থেকে ছিলেন দুইজন । আমি ছিলাম অধ্যাপক মোর্শেদের প্রতিনিধি হিসেবে। আমরা বিষয়টি নিয়ে বেশ কয়েকবার বসেছি। এর আগে অনেকগুলো ইনডিপেনডেন্ট বডি কাজ করেছে এবং তাদের পর্যালোচনা তুলে ধরেছেন। এখন ট্রাইবুনাল প্রতিবেদন দিলেও বিচার করা বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার দ্বায়িত্ব সিন্ডিকেটের। সিন্ডিকেটেই বিষয়টির সমাধান হবে।”

আর উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, “আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন হল, তদন্ত কমিটির পর ট্রাইব্যুনালের রিপোর্টের ভিত্তিতে সিন্ডিকেট সিদ্ধান্ত নেবে। সাধারণত আমাদের তদন্তগুলো এক-দেড় বছর সময় লাগে। আমরা হিসেবে করে দেখেছি, কোনো বিচারই দেড় বছরের কমে হয়নি।

“এরই মধ্যে প্যানডেমিকের কারণে ৬-৭ মাস সময় চলে গেছে, এই সময়টা কাজ করতে পারেনি ট্রাইবুনাল। এখানে প্রত্যেকটি ধাপে ইনডিপেনডেন্ট বডি কাজ করছে। তাদের পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশের ভিত্তিতেই সিন্ডিকেট সিদ্ধান্ত নেবে।“
ট্রাইবুনালের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট এএফএম মেজবাহউদ্দিনকে ফোন করে প্রতিবেদন দিতে বিলম্বের কারণ জানতে চাইলে ফোন কেটে দেন তিনি।

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0038678646087646