রাজধানীর স্বনামধন্য একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজ। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আবুল হোসেন ও গভর্নিং বডির সভাপতি স্বেচ্ছাসেবক লীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সদ্যোবিদায়ি সাধারণ সম্পাদক আরিফুর রহমান টিটুর বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় তৈরি হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষকদের মধ্যে গ্রুপিং তৈরি হয়েছে, কমেছে পড়ালেখার মান। এমনকি যেই প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য আগে তদবিরের স্তূপ জমত, এখন সেখানে ডেকেও শিক্ষার্থী পাওয়া যাচ্ছে না। শনিবার (১৪ ডিসেম্বর) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন শরীফুল আলম সুমন।
জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষক নিয়োগে বাণিজ্য, কেনাকাটায় অনিয়ম, শিক্ষকদের সাময়িক বরখাস্ত করে পুনর্বহাল, ফেল করা শিক্ষার্থীদের প্রমোশন দিয়ে টাকা আদায়সহ নানা অনিয়ম চলছে। তবে এ ব্যাপারে কোনো শিক্ষক মুখ খুললে বা প্রতিবাদ করলে তাঁকেও বরখাস্ত করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, চার মাস আগে ১৪ জন শিক্ষককে বেশ কিছু অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। শুধু একজন শিক্ষক বাদে অন্যদের এরই মধ্যে চাকরিতে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, ১৩ জনকে ফিরিয়ে আনার বিনিময়ে অর্থের লেনদেন হয়েছে।
গত জুলাই মাসে ২২ জন শিক্ষক ও আটজন কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয়। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ বিধিমালা অনুযায়ী, মাধ্যমিকের শিক্ষকদের স্নাতক পাস হতে হবে এবং বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) সনদ থাকতে হবে। কিন্তু তাঁদের কারোরই এনটিআরসিএর সনদ নেই। এমনকি তাঁদের মধ্যে চারজন শিক্ষক রয়েছেন, যাঁরা উচ্চ মাধ্যমিক পাস। এসব নিয়োগেও আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে।
জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ আবুল হোসেন পাঁচ বছর ধরে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বড় অঙ্কের বেতন-ভাতা উত্তোলন করছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ড থেকে অধ্যক্ষ নিয়োগে বারবার তাগাদা দেয়া হলেও এ বিষয়ে কর্ণপাত করছে না গভর্নিং বডি। অভিযোগ রয়েছে, নানা অনিয়ম চালিয়ে যেতেই বর্তমান গভর্নিং বডির সভাপতি স্থায়ী অধ্যক্ষ নিয়োগে আগ্রহী নয়। এমনকি প্রতিষ্ঠানের গচ্ছিত কোটি কোটি টাকার ফান্ড এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে হস্তান্তর করেও আর্থিক সুবিধা নিচ্ছেন তাঁরা।
গত ২১ অক্টোবর ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক অধ্যাপক ড. মো. হারুন-অর-রশিদ ঢাকা জেলা শিক্ষা অফিসারের তদন্তের পরিপ্রেক্ষিতে এক চিঠিতে প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির সভাপতির কাছে অনিয়মের ব্যাখ্যা ও ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন। কিন্তু সেসবের তোয়াক্কা করছে না গভর্নিং বডি।
কলেজ পরিদর্শক স্বাক্ষরিত চিঠিতে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক দিয়ে পাঠদান করানো, একাডেমিক কার্যক্রম সহকারী প্রধান শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে পরিচালনার বিষয়টি নিশ্চিত করা, অনিয়মতান্ত্রিক নিয়োগ ও দায়িত্ব দেয়া বন্ধ এবং সরকারি বিধি অনুসরণ করে জরুরি ভিত্তিতে অধ্যক্ষের শূন্য পদ পূরণ করতে বলা হয়।
ঢাকা জেলা শিক্ষা অফিসারের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, এই প্রতিষ্ঠানপ্রধানের পদে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব বিধি মোতাবেক দেয়া হয়নি। পদোন্নতির বিধান না থাকলেও অনিয়মতান্ত্রিকভাবে সহকারী শিক্ষক পদ থেকে প্রভাষক পদে, প্রভাষক পদ থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। পদোন্নতিপ্রাপ্ত পদের নির্ধারিত ও প্রাপ্য বেতন স্কেলের অনেক ওপরের স্কেলে বেতন-ভাতা দেয়ায় প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। সৃষ্ট-অনুমোদিত পদ, প্রয়োজনীয় শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের কাম্য যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও জনবল কাঠামোর বাইরে অপ্রয়োজনীয় অনেক শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
গভর্নিং বডির সভাপতি আরিফুর রহমান টিটু বলেন, ‘অধ্যক্ষ নিয়োগ প্রক্রিয়া আমরা শুরু করেছিলাম; কিন্তু মামলা হওয়ায় এ বিষয়ে এগোনো যাচ্ছে না। এ ছাড়া ঢাকা জেলা অফিসের যে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে, তা আমার সময়ের নয়। এর পরও যেসব সুপারিশ করেছে, সেগুলো আমরা পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করেছি। আর আমাদের স্কুলটি ভিন্ন ধরনের। ইংলিশ মিডিয়ামই বেশি। তাই এখানে শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসিএ সনদের প্রয়োজন নেই। তবে একজন শিক্ষককে নানা অনিয়মের অভিযোগে বরখাস্তের পর তিনি বিভিন্ন জায়গায় অভিযোগ দিচ্ছেন। আসলে আমরা নিয়ম-নীতি মেনেই প্রতিষ্ঠানটি চালাচ্ছি। কোনো অনিয়মের সুযোগ এখানে নেই।’ প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আবুল হোসেনের বক্তব্য জানতে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি তা ধরেননি।
জানা যায়, বর্তমানে ১৯টি অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর থেকেও এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে একটি তদন্ত চলমান রয়েছে। এই কমিটির প্রধান, অধিদপ্তরের উপপরিচালক অধ্যাপক নাসির উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের তদন্ত শেষ পর্যায়ে রয়েছে। যেসব লিখিত অভিযোগ পেয়েছি, এর বাইরে সরেজমিনে গিয়েও আমরা আরো অভিযোগ পেয়েছি। সব কিছুই তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হবে।’
সূত্র জানায়, বর্তমান গভর্নিং বডির সভাপতি স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা দ্বিতীয় মেয়াদে সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর দায়িত্ব গ্রহণের পরই মূলত প্রশাসনিক ব্যবস্থার অবনতি ঘটেছে। অভিযোগ রয়েছে, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে সঙ্গে নিয়ে তিনি নিয়ম-নীতির লঙ্ঘন করে যাচ্ছেন।