উচ্চতর ডিগ্রিধারী শিক্ষক সংকটে বিশ্ববিদ্যালয় - দৈনিকশিক্ষা

উচ্চতর ডিগ্রিধারী শিক্ষক সংকটে বিশ্ববিদ্যালয়

শরীফুল আলম সুমন |

উচ্চতর ডিগ্রিধারী শিক্ষকের সংকটে ভুগছে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। বিশেষ করে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ সংকট তীব্র। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে নতুন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ সংকট সবচেয়ে বেশি। আর বেসরকারি ৮-১০টি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্য সব বিশ্ববিদ্যালয়ে সংকট ভয়াবহ রকমের। মূলত উচ্চতর ডিগ্রিধারী শিক্ষক সংকটের কারণেই ওই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে জোরদার হচ্ছে না গবেষণা কার্যক্রম।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক নতুন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর ডিগ্রিধারী শিক্ষকের সংকট বিরাজ করছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রধানত প্রভাষক ও জুনিয়র শিক্ষক দিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।

ইউজিসি সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালে ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম চালু ছিল। এতে মোট শিক্ষক ছিলেন ১৩ হাজার ৭৯৯ জন। তাঁদের মধ্যে অধ্যাপক তিন হাজার ৯০৬ জন, সহযোগী অধ্যাপক দুই হাজার ১৭৫ জন, সহকারী অধ্যাপক চার হাজার ৭৩৮ জন, প্রভাষক দুই হাজার ৭২৮ জন এবং অন্যান্য ২৫২ জন। আর পাঁচ হাজার ৮৪৫ জন উচ্চতর ডিগ্রিধারী শিক্ষকের মধ্যে পিএইডি ডিগ্রিধারী ছিলেন চার হাজার ৭৬৬ জন এবং অন্যান্য উচ্চতর ডিগ্রিধারী ৯৮৫ জন।

তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় মূলত অধিভুক্ত ও অঙ্গীভূত কলেজের মাধ্যমে শিক্ষা প্রদান করে। এ জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সংখ্যা ৮৪ জন, যাঁদের মধ্যে অধ্যাপক মাত্র আটজন। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৩৫ জন শিক্ষকের মধ্যে মাত্র ২০ জন অধ্যাপক। আর আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো শিক্ষকই নেই।

২০১৭ সালের পরিসংখ্যানে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে দেখা যায়, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯০ জন শিক্ষকের মধ্যে মাত্র সাতজন অধ্যাপক, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২২৩ জন শিক্ষকের মধ্যে আটজন অধ্যাপক, কবি নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৬৭ জনের মধ্যে ১২ জন অধ্যাপক, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৮০ জনের মধ্যে মাত্র তিনজন অধ্যাপক, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৮৯ জন শিক্ষকের মধ্যে চারজন অধ্যাপক, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫২ জনের মধ্যে ১০ জন অধ্যাপক, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৪১ জন শিক্ষকের মধ্যে একজনও অধ্যাপক নেই, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০০ জনের মধ্যে ১২ জন অধ্যাপক এবং বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৭৩ জন শিক্ষকের মধ্যে মাত্র একজন অধ্যাপক।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, ‘নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চতর ডিগ্রিধারী শিক্ষকের সংকট রয়েছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে বলতে গেলে, লেকচারারের পরে তেমন সংখ্যক শিক্ষকই নেই। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে সঙ্গে আমরাও ইউজিসির পক্ষ থেকে এ অবস্থার উত্তরণ ঘটাতে কাজ করছি।’

ইউজিসি সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালে ৯৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালু ছিল। আর সেগুলোতে শিক্ষকের সংখ্যা ছিল ১৬ হাজার ২০। তাঁদের মধ্যে পূর্ণকালীন শিক্ষক ১০ হাজার ৯৩২ আর খণ্ডকালীন ছিলেন পাঁচ হাজার ৮৮ জন। পূর্ণকালীন শিক্ষকদের মধ্যে অধ্যাপক ৭৯২ জন, সহযোগী অধ্যাপক ৬৮০ জন, সহকারী অধ্যাপক দুই হাজার ৫৫৪ জন এবং প্রভাষক ছয় হাজার ৬৯৩ জন। আর খণ্ডকালীন শিক্ষকের মধ্যে অধ্যাপক এক হাজার ৬১১, সহযোগী অধ্যাপক ৭৬০, সহকারী অধ্যাপক ৯২০ এবং প্রভাষক এক হাজার ৪৪৩ জন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ অনুযায়ী, খণ্ডকালীন শিক্ষকের সংখ্যা পূর্ণকালীনের এক-তৃতীয়াংশের বেশি হওয়া যাবে না। অথচ এই আইন মানছে না বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর ডিগ্রিধারী শিক্ষকের সংখ্যা খুবই সামান্য। পূর্ণকালীন ১০ হাজার ৯৩২ জন শিক্ষকের মধ্যে পিএইচডি ডিগ্রিধারী ছিলেন এক হাজার ৪০৫ জন। আর খণ্ডকালীন পাঁচ হাজার ৮৮ জন শিক্ষকের মধ্যে পিএইচডি ডিগ্রিধারী ছিলেন দুই হাজার ১০ জন। যদিও খণ্ডকালীন এই শিক্ষকরা মূলত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের। তাঁদের সংখ্যা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবেও ধরা হয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর ডিগ্রিধারী শিক্ষকের যে হিসাব পাওয়া যায় তা মূলত হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের; যেমন এই সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ৬৯৯ জন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে। এরপর যথাক্রমে ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশে ১৭০ জন, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে ১৫৩ জন, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে ১৪৫ জন, আহ্ছানউল্লাহ্ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে ১১২ জন উচ্চতর ডিগ্রিধারী শিক্ষক আছেন। অন্যদিকে সর্বনিম্নসংখ্যক অর্থাৎ একজন করে উচ্চতর ডিগ্রিধারী শিক্ষক রয়েছেন ব্রিটানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, টাইমস ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, জার্মান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ এবং ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজে।

ইউজিসির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পূর্ণকালীন শিক্ষকের চেয়ে খণ্ডকালীন পিএইচডি ডিগ্রিধারী শিক্ষকের সংখ্যা বেশি। পূর্ণকালীন পিএইচডি ডিগ্রিধারী শিক্ষকের সংখ্যা বাড়লে শিক্ষার্থীরা বেশি উপকৃত হবে।

শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষকরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার জন্য আসতেন। কিন্তু এখন কেউ ঢাকার বাইরে যেতে চান না। কারণ এখন শিক্ষকদের গবেষণা, নতুন জ্ঞান আহরণ ও লেখাপড়া করার আগ্রহ কম। এ ছাড়া আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রয়োজনমতো উচ্চতর ডিগ্রিধারী শিক্ষকও সরবরাহ করতে পারছে না। এরও প্রধান কারণ গবেষণা নেই। এ ছাড়া যাঁরা তরুণ বয়সে বাইরে গিয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নিচ্ছেন, তাঁরাও আর দেশে ফিরছেন না। সবশেষ কথা, উচ্চতর ডিগ্রিধারী শিক্ষক তৈরিতে সরকারের আগ্রহও অতটা নেই। ইউজিসি বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যাপারে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। অথচ তাদের ছোট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতিই বেশি ভূমিকা পালন করা উচিত।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘বর্তমানে নতুন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিভাগীয় প্রধান পদে সহকারী অধ্যাপকের চেয়ে উচ্চপদের শিক্ষক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আবার ছোট বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপকরা বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক হয়ে চলে আসছেন। আর অভিজ্ঞ শিক্ষকরা নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে চান না। ফলে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উচ্চতর ডিগ্রিধারী শিক্ষক সংকটে ভুগছে। আর পাঁচ-সাতটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বাদে বাকিগুলোতে চরম মাত্রায় বাণিজ্যিকীকরণ চলছে। কোনো রকমে চার বছর কাটাতে পারলেই হলো। তাদের মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ ও তৈরিতে কোনো নজর নেই। এ ব্যাপারে ইউজিসিকে বড় ভূমিকা পালন করতে হবে।’

 

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ

দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0043249130249023