গ্রামে কিংবা শহরে যেখানেই কোনো আলোচনায় অংশগ্রহণ করি বা গ্রামাঞ্চলের গাছতলায় আড্ডায় বসি, একটা কমন হা-হুতাশ দেখতে পাই। কেউ বলে, কী হবে এতো এতো লেখাপড়া করে? কেউ বলে, দেশ গোল্লায় যাচ্ছে, ছেলে-মেয়েরা বড় বড় ডিগ্রি নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে; চাকরি পায় না, কেউ চাকরি দেয় না; মামা-চাচা-দুলাভাই অথবা নিদেনপক্ষে পরিচিত এমপি-মন্ত্রী না থাকলে চাকরি হয় না। সময় যত যেতে থাকে, আলোচনায় যুক্ত হতে থাকে চিত্র-বিচিত্র বহু কিছু। সীমাহীন আলোচনার সমাপ্তি টানার চেষ্টা করা হয় অনেকটা এ রকম কথা দিয়ে: গেছে, লেখাপড়া গোল্লায় গেছে, ছেলেটাকে পাঠিয়ে দিবো মধ্যপ্রাচ্যে; দেখি আকামা পাই কিনা।
তবে যে যেভাবেই এ সব আলোচনাকে দেখুক না কেন, আমি যথেষ্ট গুরুত্ব দেই। চা দোকান-আমতলা-জামতলা থেকেই ক্ষোভের ভাইরাসগুলো উড়তে উড়তে বসন্তের উড়ন্ত পেঁজাতুলার মতো সমাজের নাকে-মুখে হালকা পরশে নেতিবাচক হাওয়ার সৃষ্টি করে, যা ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করে সোনালি স্বপ্নের ডালপালাকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দেয়। সাবধান না হলে, ‘রাস্তার’ আলোচনা-সমালোচনাকে অবহেলায় পেছনে ঠেলে ফেলে দিলে, সমাজ থেকে স্বপ্নগুলো হারিয়ে যাবে। হারিয়ে যাবে হয়তো ক্রমান্বয়ে, ধীর লয়ে, বোঝা যাবে না সহজে। যখন বোঝা যাবে, তখন তেমন কিছুই করার থাকবে না।
বিষয়টা যেহেতু ডিগ্রিধারীদের শিক্ষার মান এবং পরবর্তীকালে তাদের চাকরিবিষয়ক, সেহেতু ডিগ্রিধারীদের নিয়েই আলোচনা চলুক। ছেলে-মেয়েরা ডিগ্রি নিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরাসরি অথবা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ থেকে। আগের মতো এখন আর সেই ‘কলেজ’ পাওয়া দুষ্কর। এখন সারা দেশে ‘বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ’ এর ছড়াছড়ি। বিশ্ববিদ্যালয় কলেজগুলোতে লেখাপড়ার অবস্থাটা কিরূপ? আমি যেটুকু জানি এবং দেখেছি সেটুকুর ওপর ভিত্তি করে বলতে পারি, সমস্যার তো অন্ত নাই। একে তো শিক্ষক সংখ্যা কম, তার উপর প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষকের সংখ্যা বাড়ছে। সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করে কি শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে? মূলত নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে মৌখিক পরীক্ষার ভিত্তিতে। মৌখিক পরীক্ষার ওপর নির্ভর করে কারো যোগ্যতা কি সঠিকভাবে নিরূপণ করা যায়? প্রয়োজন ভাষাগত দক্ষতা যাচাইয়ের লক্ষে লিখিত পরীক্ষা, প্রযুক্তি জ্ঞান ও কম্পিউটার লিটারেসি পরীক্ষা, ক্লাস ডিমোনেস্ট্রেশন, শিক্ষকতার পেশার জন্য উপযোগী কিনা তা জানার জন্য অ্যাপটিচিউড টেস্ট, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যথাযথ আচরণ করার ক্ষমতা বোঝার জন্য আচরণিক পরীক্ষা ইত্যাদি। সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া প্রয়োজন ভাষাগত দক্ষতা আর আচরণিক যোগ্যতার ওপর। একজন শিক্ষকের বাংলা এবং ইংরেজিতে অবশ্যই গ্রহণযোগ্য দক্ষতা থাকতে হবে।
যিনি ভাষার সঠিক জ্ঞান রাখেন (বানান, বাক্য গঠন ও পঠন, যতিচিহ্ন ঠিক রেখে পাঠকরণ, ভাষার সঠিক প্রয়োগে সুন্দর করে লিখতে পারা) তিনিই শুধুমাত্র ভালোভাবে নিজ নিজ বিষয়ের বইপত্র/শিখনসামগ্রী অধ্যয়ন করে বিষয়-জ্ঞান সঠিকভাবে অর্জন করতে পারেন, যা শিক্ষকতার জন্য অপরিহার্য। শ্রেণিকক্ষে সাবলীলভাবে বিষয়বস্তু উপস্থাপন করার জন্যও ভাষার ওপর পর্যাপ্ত দখল থাকা আবশ্যক। আবশ্যক মানে আবশ্যক; ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগই নেই। আর শ্রেণিকক্ষের ভেতরে ও বাইরে শিক্ষার্থীদের সাথে পরিমিত সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে তাদের সাথে মিলেমিশে শিক্ষাকে তাদের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য প্রয়োজন আচরণিক দক্ষতা। ভুলে যাওয়া যাবে না যে, কোনো শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের শেখানোর জন্য কসরত করবেন না; তার মূল দায়িত্ব হলো শিক্ষার্থীদের শেখার রাস্তায় চলতে সাহায্য করা অর্থাত্ সঠিক গাইডেন্স দেওয়া। প্রাথমিক, মাধ্যমিক বা উচ্চশিক্ষা যে পর্যায়েই হোক না কেন, শিক্ষাদানের নামে মুন্সিয়ানা দেখানো শিক্ষকের কাজ নয়। পাণ্ডিত্য প্রদর্শনের কোনো প্রয়োজনই নেই। শিক্ষার্থীরাই কোনো বিষয় সম্পর্কে শেখার জন্য শিক্ষকের পথ প্রদর্শনের দক্ষতা, শিক্ষার্থীদের বোধ ক্ষমতা অনুযায়ী প্রাঞ্জল ভাষায় জটিল বিষয় সহজ করে দেওয়ার ক্ষমতা, শারীরিক ভাবভঙ্গি, চেহারায় ভাবের প্রকাশ, আপনজনসুলভ দৃষ্টিতে ও ভঙ্গিতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ভাব বিনিময়—এসব থেকেই শিক্ষকের পাণ্ডিত্য সম্পর্কে শিক্ষার্থীরা ধারণা পেয়ে যাবে। তারা যাকে পণ্ডিত ভাববে, তিনিই পণ্ডিত। পণ্ডিতি ভাব দেখিয়ে পণ্ডিত হওয়া যায় না।
কলেজগুলোতে আরও রয়েছে প্রয়োজনীয় ভৌত সুযোগ-সুবিধার অপর্যাপ্ততা। কোথাও ক্লাসরুম প্রয়োজনের তুলনায় কম, কোথাও ক্লাসরুম থাকলেও মেরামত-রক্ষণাবেক্ষণ-ক্লিনিং-এর অভাবে ব্যবহারের অযোগ্য, পাঠাগারে বই থাকলেও দরকারি বইয়ের সংখ্যা কম আর ডিজিটাল উপকরণের ব্যবহার তো চোখে পড়ে না বললেই চলে। এ ছাড়াও, কলেজগুলোর কর্মকাণ্ডে এখন আর সামাজিক সম্পৃক্ততা দেখাই যায় না। সরকার থেকে প্রায় সব খরচ পেয়ে যাওয়ায় সমাজ এখন আর তার দায়িত্ব আছে বলে মনে করে না। এমপিওভুক্তির অনেক ভালো দিক থাকলেও ভয়ঙ্কর অন্ধকার দিকটি হলো : শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সমাজ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া। মনে পড়ে, আমি যে কলেজটিতে পড়তাম, সেখানে প্রতি সপ্তাহেই প্রতিষ্ঠাতাদের কেউ না কেউ কয়েকবার আসতেন। অধ্যক্ষের অফিসে শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলতেন, খোঁজ-খবর নিতেন। তারা ক্লাসেও যেতেন, ছাত্রদের কোনো ব্যাপারে অসুবিধা হচ্ছে কিনা সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতেন। আর এখন? সরকারি হয়ে যাওয়ার পর নাকি কেউই আর ওদিক মাড়ায় না। ফলে যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে।
তবে সুখের বিষয় হলো, ইতোমধ্যে সরকার বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় সিইডিপি প্রকল্প হাতে নিয়েছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এটি বাস্তবায়ন করছে, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন প্রশিক্ষণে সহযোগিতা করছে, বৃটেনের নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মালয়েশিয়ান ক্যাম্পাসে কলেজ প্রিন্সিপাল আর শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। ভালো পরিবর্তন আমরা আশা করছি। কলেজ শিক্ষায় বেশি জোর দিতে হবে বিশেষত এ জন্যই যে, প্রায় আড়াই হাজার কলেজে ৭০ শতাংশের বেশি গ্র্যাজুয়েট তৈরি হয়। মূলধারার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো (সরকারি আর বেসরকারি) সব মিলে বাকি তিরিশ শতাংশ গ্র্যাজুয়েট তৈরির দায়িত্বে।
বিয়াল্লিশটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে চলমান ৩৭টি বিশ্ববিদ্যালয় (এফিলিয়েটেড কলেজসহ) ৩১ লাখ ৫০ হাজার ৪০৯ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করিয়েছে ২০১৬ সালে (ইউজিসি’র বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী)। উন্মুুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্যগুলো ভর্তি করিয়েছে ২ লাখ ৬০ হাজার ৮৪ জন আর একই বছরে ডিগ্রি পর্যায়ে উন্মুুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিকৃত মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২ লাখ ৫৬ হাজার জন। বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদানের জন্য এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ কীভাবে হয়? দু’একটি ব্যতিক্রম বাদে, নিয়োগ হয় মৌখিক, শুধু রেজাল্টের ভিত্তিতে পরীক্ষার মাধ্যমে। কে না জানে, শুধু মৌখিক পরীক্ষা দুর্নীতির সুতিকাগার। যাকে ইচ্ছা তাকে দরদি প্রশ্ন করে আকাশে তুলে ফেলা যায়, আবার যাকে ইচ্ছা তাকে ‘দুঃসহ’ প্রশ্নে জর্জরিত করে নাকানি-চুবানি খাইয়ে অপদার্থ প্রমাণ করা যায়। আমার বিশ্বাস, লিখিত পরীক্ষাসহ ওপরে উল্লিখিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হলে সঠিক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া সম্ভব। উন্মুুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে লিখিত পরীক্ষা, কম্পিউটার/আইসিটি টেস্ট, ভিডিও ক্লাস টেস্ট এবং সর্বশেষে মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষক নিয়োগ দিতে গিয়ে ভালো ফল পেয়েছি। এতে শুধু উপযুক্ত ব্যক্তিরাই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছেন না, অনাকাঙ্ক্ষিত তদবিরও শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে।
মূল কথায় ফিরে আসি। যে গ্রাজুয়েটরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হচ্ছে তাদের শিক্ষার মান বা কোয়ালিটি কেমন? শিক্ষার মানের কোনো সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা নেই। তাই আমি শিক্ষার মান বলতে কর্মক্ষেত্রে সঠিকভাবে কাজ করতে পারার উপযুক্ততাকে বুঝাচ্ছি—ফিট্ ফর পারপাস্। তারা কেমন ফিট্? যদি ৮০/২০ রুলকে গুরুত্ব দেই, তাহলে সাধারণভাবে আশি শতাংশকে নিয়েই মাথাটার ব্যথা। গবেষণালব্ধ তথ্যের অবর্তমানে নিশ্চিত হয়ে কিছু বলা যাবে না। তবে দু-একটা উদাহরণ দিলে কিছুটা হলেও আশি শতাংশের কোয়ালিটির কিছুটা আঁচ করা যাবে, যদিও তার সাধারণীকরণের কোনো সুযোগ নেই। উন্মুুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মকর্তা নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী মাস্টার্স ডিগ্রিধারী প্রার্থীদের অনেকেই (অন্তত ৭০%) সঠিকভাবে তাদের পাবলিক পরীক্ষা/ডিগ্রির নাম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম, কি কি বিষয় অধ্যয়ন করেছে সেগুলোর নাম, এমনকি দু’একজন শিক্ষকের নামও লিখতে গিয়ে যে হযবরল অবস্থার সৃষ্টি করেছে তা রীতিমত উদ্বেগ সৃষ্টিকারক।
সংশ্লিষ্ট সবার সম্মিলিত উদ্যোগে আমাদের তৈরি করতে হবে এমন ধরনের গ্রাজুয়েট—যারা সঠিকভাবে মাতৃভাষাসহ ইংরেজিতে পারদর্শী হবে, উভয় ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারবে/প্রেজেন্টেশন করতে পারবে এবং অন্যদের সাথে যথাযথভাবে মৌখিক ও লিখিত উপায়ে যোগাযোগ করতে পারবে, অন্যান্য সফ্ট স্কিলগুলোও আয়ত্ত করবে যাতে সৃজনশীল হওয়ার পাশাপাশি সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে যৌক্তিক চিন্তা করতে পারবে, কর্মক্ষেত্রে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে পারবে, বিজ্ঞানমনস্ক হবে, প্রযুক্তি বিষয়ক শিক্ষা গ্রহণ করবে, সাবলীলতার সঙ্গে কম্পিউটার চালাতে পারবে। মনে রাখা দরকার, আমরা ভিশন-২০২১ অনুসারে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার স্বপ্ন দেখছি। এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য সরকারি সংস্থাগুলোসহ শিল্প-কারখানায় প্রচুর সংখ্যক মধ্যম স্তরের তারুণ্যদীপ্ত ব্যবস্থাপক প্রয়োজন। প্রবেশ-স্তরেও সৃজনশীল, উদ্বাবনী শক্তিসম্পন্ন ব্যবস্থাপক/দক্ষ কর্মী প্রয়োজন। নলেজ ওয়ার্কারতো লাগবেই। যেভাবে চলছে এভাবে চললে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ব্যবস্থাপক তৈরি হবে না। নির্ভর করতে হবে অন্য দেশের উপর। ইতোমেধ্যে কয়েক লক্ষ বিদেশি দক্ষ ব্যবস্থাপক এবং কর্মী বাংলাদেশে কাজ করছে এবং দেশি গ্রাজুয়েটদের বেকার রেখে এরা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আসন গেড়ে বসেছে।
পরিশেষে বলতে চাই, বই দেখে দেখে পড়ানো ‘পুস্তক-শিক্ষক’ এবং না বুঝেই বই মুখস্ত করা ‘স্টিল-শিক্ষার্থী’ বা ‘জোম্বীশিক্ষার্থী’ এ দুয়ে মিলে যদি শিক্ষা ব্যবস্থাকে গিলে ফেলে, তাহলে সেখানে শিক্ষা ব্যবস্থায় ধস নেমে আসা শুধু সময়ের ব্যাপার; কাঙ্ক্ষিত গ্র্যাজুয়েট তৈরি করা তো বহুত দূরের স্বপ্ন।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও গবেষক; উপাচার্য,বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়