শিক্ষা ব্যবস্থার সব স্তরেই বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষায় বসতে হয় শিক্ষার্থীদের। এক্ষেত্রে শ্রেণীভিত্তিক স্তর বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের ধরনেও পরিবর্তন আসার কথা। নিম্নস্তরের শিক্ষা কার্যক্রমে প্রশ্নপত্রে গুরুত্ব পাওয়ার কথা মনে রাখা, অনুধাবন, সহজ প্রয়োগের মতো বিষয়গুলো (লোয়ার অর্ডার)। অন্যদিকে উচ্চস্তরের শিক্ষা কার্যক্রমে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে গুরুত্ব পাওয়ার কথা বিশ্লেষণধর্মী, মূল্যায়নধর্মী ও সৃজনশীলতার মতো বিষয়গুলো (হায়ার অর্ডার)। কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক শ্রেণীর প্রশ্নপত্রের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র। সাম্প্রতিক দুটি গবেষণায় উঠে আসে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেয়া উচ্চশিক্ষা স্তরের পরীক্ষাগুলোর প্রশ্নপত্রের ৮০ শতাংশই প্রণয়ন হচ্ছে লোয়ার অর্ডারের বিষয়বস্তু নিয়ে। শনিবার (৯ নভেম্বর) বণিক বার্তা পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন সাইফ সুজন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) দুটি পৃথক থিসিস গবেষণায় এ চিত্র উঠে এসেছে। আইইআরের অধ্যাপক ড. এসএম হাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষক এ গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এর মধ্যে একজন গবেষণা করেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের প্রশ্নপত্র নিয়ে। অন্যজনের বিষয় ছিল রসায়নের প্রশ্নপত্র। গবেষণায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের পদার্থ ও রসায়ন বিষয়ের সব কোর্সের প্রশ্নপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা হয়। এছাড়া গবেষণার অংশ হিসেবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকের সাক্ষাত্কারও নেয়া হয়। রসায়ন বিষয়ের প্রশ্নপত্র নিয়ে গবেষণা চালান উম্মে কুলসুম। পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ের গবেষণাটি করেন উম্মে হাবিবা।
গবেষকরা বলছেন, প্রশ্নপত্রকে মোটা দাগে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। একটি হচ্ছে লোয়ার অর্ডার, অন্যটি হায়ার অর্ডার। লোয়ার অর্ডারের প্রশ্ন করা হয় মনে রাখা (রিমেমবারিং), অনুধাবন (আন্ডারস্ট্যান্ডিং) ও সহজ প্রয়োগভিত্তিক (অ্যাপ্লিকেশন)। হায়ার অর্ডারে গুরুত্ব পায় বিশ্লেষণধর্মী (অ্যানালাইজিং), মূল্যায়নধর্মী (ইভ্যালুয়েশন) ও সৃজনধর্মী (ক্রিয়েটিং) বিষয়গুলো। শ্রেণীর স্তর বাড়ার সঙ্গে প্রশ্নপত্রও ক্রমান্বয়ে হায়ার অর্ডারে নিয়ে যাওয়া হয়। যদিও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বর্ষের প্রশ্নপত্রের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বেশির ভাগ প্রশ্নই লোয়ার অর্ডারে প্রণয়ন করা হয়েছে।
এ বিষয়ে অধ্যাপক ড. এসএম হাফিজুর রহমান বলেন, আমাদের গবেষণার মূল লক্ষ্য ছিল, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগুলোর মূল্যায়ন প্রক্রিয়া যাচাই করা। সেখানে আমরা দুটি বিষয় দেখার চেষ্টা করেছি। একটি হলো লার্নিং অ্যাসেসমেন্ট প্রসেস (শিখন মূল্যায়ন প্রক্রিয়া) ও কারিকুলামের কন্টেন্ট ডিস্ট্রিবিউশন (বিষয়বস্তুর বিন্যাস)। গবেষণায় দেখা যায়, উচ্চশিক্ষা স্তর হওয়া সত্ত্বেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার প্রশ্নের বেশির ভাগই লোয়ার অর্ডারের। এর মানে শিক্ষার্থীরা তাদের অর্জিত জ্ঞান নতুন নতুন প্রেক্ষাপটে কীভাবে প্রয়োগ করবে, সেটিই যাচাই করা হচ্ছে না। যদিও স্নাতক সম্পন্ন করে একজন গ্র্যাজুয়েট সরাসরি চাকরির বাজারে প্রবেশ করছে।
তিনি আরো বলেন, দক্ষতা যাচাই না করে নিম্নমানের প্রশ্নে সহজেই পাসের সুযোগ পাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। এর ফলে পাস করে বের হয়েও বেকার থাকছেন অনেকেই। তাই অ্যাসেসমেন্ট ফ্রেমওয়ার্ক (মূল্যায়ন কাঠামো) অনুসরণের মাধ্যমে প্রশ্নপত্রের গুণগত মান নিশ্চিত করতে হবে।
গবেষণায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের রসায়ন বিষয়ের চারটি বর্ষের প্রশ্নপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা হয়। সেখানে দেখা যায়, ৮৬ দশমিক ৮৩ শতাংশই নিম্নস্তরের। উচ্চস্তরের প্রশ্ন মাত্র ১৩ দশমিক ১৭ শতাংশ। স্নাতক প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত কোর্সগুলোর তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৩ দশমিক ১৪ শতাংশ প্রশ্ন মনে রাখা, ৪৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ অনুধাবন ও ১৮ দশমিক ২৬ শতাংশ প্রশ্ন সহজ প্রয়োগভিত্তিক। অন্যদিকে হায়ার অর্ডারের প্রশ্ন শূন্য দশমিক ৪১ শতাংশ বিশ্লেষণধর্মী, শূন্য দশমিক ৪৩ শতাংশ মূল্যায়নধর্মী ও শূন্য দশমিক ৭৩ শতাংশ সৃজনধর্মী।
পদার্থবিজ্ঞানের প্রশ্নের ক্ষেত্রেও বেশির ভাগই লোয়ার অর্ডারে করা হয় বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, পদার্থবিজ্ঞানের প্রথম বর্ষের প্রশ্নে মনে রাখাভিত্তিক প্রশ্ন আছে ২০ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এছাড়া অনুধাবন ও সহজ প্রয়োগভিত্তিক প্রশ্ন করা হয় যথাক্রমে ৪৮ দশমিক ৫৫ ও ২২ দশমিক ১ শতাংশ। অন্যদিকে হায়ার অর্ডারে ৬ দশমিক ৫২ শতাংশ বিশ্লেষণধর্মী ও ২ দশমিক ১৮ শতাংশ সৃজনধর্মী প্রশ্ন করা হয়। এ বর্ষের প্রশ্নে মূল্যায়নধর্মী কোনো প্রশ্নই রাখা হয়নি। অন্যান্য বর্ষের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে একই চিত্র।
গবেষণাপত্রে আরো বলা হয়েছে, অ্যাসেসমেন্ট ফ্রেমওয়ার্কে শুধু প্রশ্নের সংখ্যা ও মান বণ্টন নিয়ে দিকনির্দেশনা থাকলেও এর গুণগত মান নিয়ে কোনো ধরনের নির্দেশনা নেই। নম্বর বণ্টনের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে প্রায়োগিক জ্ঞানের ওপর খুব কম নম্বর রাখা হয়।
গবেষক দলের একজন সদস্য বলেন, অনেক ক্ষেত্রে গুটিকয়েক অধ্যায় থেকেই বেশির ভাগ প্রশ্ন করা হচ্ছে। ফলে পূর্ণ সিলেবাস শেষ না করে হাতেগোনা কয়েকটা অধ্যায় পড়েই পাসের সুযোগ পাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। কয়েকটি পরীক্ষার প্রশ্নে দেখা যায়, দুটি অধ্যায় পড়েও পাস নম্বর পাওয়া সম্ভব।