সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হচ্ছে সবকিছু। প্রতিক্ষণ আপডেটেড হচ্ছে বিভিন্ন প্রযুক্তি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বারবার পরিবর্তন করা হচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালনার কৌশলও। মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হচ্ছে। সংবিধানসহ আইনের নানা ধারা-উপধারারও পরিবর্তন করা হচ্ছে প্রয়োজনের আলোকে। কিন্তু থমকে আছে কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ। ১৯৭৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ প্রবর্তিত হওয়ার পর গত হয়েছে চার দশক। দীর্ঘ এই সময়ে একবারও সংশোধন, পরিবর্তন, পরিবর্ধন করা হয়নি এ অধ্যাদেশ। তাই বলে এটি কখনো সংশোধন করা যাবে না, বিষয়টি এমনও নয়। শিক্ষকদের বেতন-ভাতা, গবেষণার মান বৃদ্ধিতে বরাদ্দ বাড়ানোসহ শিক্ষা ও গবেষণার মান নিশ্চিতকরণে নতুন কিছু ধারা সংযোজন করা যেতেই পারে। নতুন প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও অভিন্ন নীতির আওতায় আসতে পারে।
ক্লাস-পরীক্ষার ক্ষেত্রে ন্যূনতম বিধান, বছরে ন্যূনতম গবেষণা-প্রকাশনা, গবেষণার আবশ্যিক বিধান সংযোজন করা যেতে পারে। সেন্টার অব এক্সিলেন্স নির্মাণের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আধুনিক গবেষণাগার নির্মাণ ও গবেষণার সর্বোচ্চ পরিবেশ তৈরিও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের জন্যে বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে গবেষণার বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং বিশেষ গবেষণার জন্যে বিশেষ বোনাসের বিধানও রাখা যেতে পারে। সার্বিকভাবে সংশোধনের লক্ষ্য যদি হয় শিক্ষা ও গবেষণার মান বৃদ্ধি এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের স্বার্থরক্ষা, তবে মনে হয় সম্মানিত শিক্ষকদের কোনো পক্ষই এ ক্ষেত্রে আপত্তি করবেন না। অধ্যাদেশের অপব্যাখ্যা দিয়ে অনেকেই বলে থাকেন যে, ‘বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশে তো নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষা নেওয়ার কথা উল্লেখ নেই।’ এমন শিক্ষকও খোঁজে পাওয়া যায়, যিনি তাঁর বিভাগীয় পাঠদানের অংশ হিসেবে প্রতিবছর একটিমাত্র কোর্স নির্ধারিত সময়ের প্রায় একবছর পর শুরু করেন।
একটি বিষয়ের পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়ন করতে প্রায় একবছর সময় নিয়েছেন, এমন শিক্ষকও আছেন। এমন শিক্ষকও আছেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেওয়ার অনুমতি নিয়েছেন, কিন্তু ক্লাস নেন একাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। কোনো কোনো শিক্ষক জড়িত এসব বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার কাজেও। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল দায়িত্বের বাইরে এসব প্রতিষ্ঠানেই তারা বেশি সময় দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এমন অবস্থায় আর্থিক সুবিধার কাছে নিজের প্রধান দায়িত্ব, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসটিই গৌণ হয়ে পড়ে। শিক্ষকদের এমন কর্মকাণ্ডে বিভাগে সেশনজট তৈরিসহ একাডেমিক জটিলতা তৈরি হয়। অথচ এসব শিক্ষকই আবার প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে সময়ানুবর্তী ও যথেষ্ট দায়িত্বশীল। সেশনজটের কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক সেশন পিছিয়ে পড়েছে। কিন্তু অধ্যাদেশের দুর্বলতার কারণে তাঁদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়ারও সুযোগ থাকে না বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের।
মানসম্মত উচ্চশিক্ষা নিশ্চিতকরণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে সরকারের সমন্বয় করার জন্য ১৯৭৩ সালে বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু উচ্চশিক্ষা দেখভালের দায়িত্বে থাকলেও কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না ইউজিসি। আইনি সীমাবদ্ধতা, রাজনৈতিক প্রভাব, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা প্রভৃতি কারণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণের এখতিয়ার ইউজিসির হাতে নেই। বাস্তবায়নের ক্ষমতা না থাকায় প্রতিষ্ঠানটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নানা ধরনের অনিয়মের ব্যাপারেও সেই অর্থে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠালেও অনেক সুপারিশ মাসের পর মাস, এমনকি বছরের পর বছর ধরে পড়ে থাকে ফাইলবন্দি অবস্থায়। এছাড়া মন্ত্রণালয় সেই সুপারিশ অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে পারে, না-ও পারে। মন্ত্রণালয় কোনো প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলে আদালতে মামলা হয়, আদালত স্থগিতাদেশ দেন। এভাবেই চলতে থাকে। আদালতের স্থগিতাদেশের অবসান ঘটানোর দায়িত্ব মন্ত্রণালয়ের, সে ক্ষেত্রে তাদের আন্তরিকতা নিয়ে কথা থাকে। এছাড়া স্বায়ত্তশাসনের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় শিক্ষক যাচ্ছেতাইভাবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষকদের যথাযথ মূল্যায়ন, পরিপূর্ণ আর্থিক সুযোগ-সুবিধা প্রদান, শিক্ষা ও গবেষণার পর্যাপ্ত সুবিধা নিশ্চিত করে ন্যূনতম দায়িত্ব পালনে কিছুটা আবশ্যিক নিয়ম করা যেতেই পারে।
আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতির পূর্বশর্ত হচ্ছে, উচ্চমানের গবেষণার অবকাঠামো তৈরি। এ কাঠামোতে প্রকাশিত গবেষণা জার্নালের মান নিয়েও প্রশ্ন থাকে। গবেষণার পিয়ার-রিভিউ প্রসেসে গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ধরন, গবেষকের রেপুটেশন, আগের পাবলিকেশন রেকর্ড প্রভৃতি বিষয় বিবেচনায় আনা হয়। বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই এ সূচকে শীর্ষে নেই। আন্তর্জাতিক তো পরের কথা, এ কারণে এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকাতেও বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই।
আমাদের দেশে আধুনিক ও আন্তর্জাতিকমানের গবেষণা খুব একটা চোখে পড়ে না। বিশ্বজনীনতার যুগে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দ্রুত পরিবর্তন ও উন্নয়ন হচ্ছে। প্রতি বছর সফটওয়্যার নতুন ভার্সন পাচ্ছে, নতুন নতুন প্যাকেজ ও টুল বের হচ্ছে। এসবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সর্বশেষ আর্টিকেল, বই, রিপোর্ট সম্পর্কে অবগত না থাকলে আমাদের গবেষণার মান উন্নত হবে না। জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান-উত্পাদনের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় তখন আমাদের পরাজয় হবে অবশ্যম্ভাবী। আমাদের দুর্ভাগ্য, অনেক বিভাগের শিক্ষকই শিক্ষকতার শুরুর দিকেই কেবল বিভাগের নোটপত্র তৈরি করেন, অথবা তার ছাত্রকালীন নোটই ক্লাস নেওয়ার জন্য ব্যবহার করেন। এভাবে চলতে থাকে বছরের পর বছর। ফলে তাঁর জ্ঞানের গভীরতা ও পরিধি যেমন বাড়ে না, তেমনি শিক্ষার্থীরাও বঞ্চিত হয় প্রাগ্রসর জ্ঞানের সংস্পর্শ থেকে। এমন অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যেগুলো গবেষণা খাতে নিজেদের ব্যয় দেখিয়েছে। কিন্তু কোনো গবেষণা প্রকল্প ওই বছর পরিচালিত হয়নি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা মাস্টার্সে যে থিসিস করেন, তা এ খাতে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণাগত কাঠামো এখনো পুরোপুরি পরিষ্কার নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন উন্নত দেশে গবেষণা ও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোরই অবদান বেশি। বাংলাদেশে তার উল্টো। এখানকার অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নিয়েও প্রশ্ন আছে। সদিচ্ছার অভাব, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও পর্যবেক্ষণের অভাবে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার মান নিম্নমুখী।
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার সুষ্ঠু অবকাঠামো নেই বললেই চলে। প্রথম সারির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও উন্নতমানের গবেষণাগার ও মানসম্মত গবেষণাপত্রের খুবই অভাব। যোগ্য মানবসম্পদ সৃষ্টি, শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রমের গতিবৃদ্ধি ও মান-উন্নয়ন এবং সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্যে প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি করে সেন্টার অব এক্সিলেন্স প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। কেবল প্রতিষ্ঠা করলেই চলবে না, সেগুলোকে কার্যক্ষম করতে হবে। গবেষক-শিক্ষকগণের আন্তরিকতার সঙ্গে গবেষণায় মনোনিবেশ করতে হবে। গবেষণায় সময় দিতে হবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও গবেষণার ন্যূনতম মান বাধ্যতামূলক করতে হবে। গবেষণা পরিচালনার লক্ষ্যে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বরাদ্দ রাখতে হবে। গবেষণা বিষয়ক প্রকাশনা ও সাময়িকীও বের করতে উদ্যোগ নিতে হবে। কেবল পদোন্নতি নয়, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিয়মিত গবেষণা লেখালেখিই বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত এগিয়ে রাখতে পারে। মানসম্মত শিক্ষা-গবেষণা নিশ্চিতকরণে আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোতেও এরকম কঠোর নিয়ন্ত্রণ থাকা জরুরি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণত ভর্তি পরীক্ষার মধ্য দিয়েই সেশনজট শুরু হয়। এইসএসসি পরীক্ষা ও এর ফল প্রকাশে লেগে যায় জুলাই-আগস্ট। এর পর একেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা হয় একেক সময়ে। সব থেকে আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় তাও অক্টোবরে। এর পর ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ক্লাস শেষ করতে লেগে যায় আরো দুই-এক মাস। জুলাই থেকে সেশনের হিসাব করা হয় আমাদের দেশে। এ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষার্থীরা ক্লাস শুরু করে বছরের প্রায় পাঁচ থেকে ছয় মাস পরে। আর অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা শেষ হতে আরো কয়েক মাস সময় লেগে যায়। এ ক্ষেত্রে আমাদের পুরো শিক্ষাব্যবস্থার সময়সূচিতেই পরিবর্তন আনতে হবে। উদ্যোগ নিলে বছরের শুরুতেই এসএসসি, মার্চ বা এপ্রিলে এইচএসসি পরীক্ষার আয়োজন করা যেতে পারে। জুনের মধ্যে সব ভর্তি পরীক্ষা শেষ করে জুলাই থেকে ক্লাস শুরুর একটি কার্যকরি পরিকল্পনা নিলে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রে সমন্বিত পদ্ধতির প্রবর্তন করা যেতে পারে। এতে বহুদিক থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে।
১০ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের ধারাবাহিকতা আর শিক্ষাখাতে নেওয়া নানামুখী কর্মসূচির কারণে এই খাতে মোটাদাগে একটা স্থিতিশীলতা এসেছে। শিক্ষায় ডিজিটাল পদ্ধতির প্রবর্তন, অবকাঠামো উন্নয়ন, নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন ও এমপিওভুক্তিকরণসহ অগ্রগতির আরও খবর আছে। সেই সাথে আছে চ্যালেঞ্জও। টানা তৃতীয়বারে সরকারের মেয়াদে এখন যেমন সুযোগ আছে শিক্ষাখাতের আধুনিকায়ন আর মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে, তেমনি এই খাতে রয়েছে খানিকটা চ্যালেঞ্জও। যাতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এগোলে সুফল মিলবে।
লেখক : সাবেক মেম্বার, পাবলিক সার্ভিস কমিশন ও সাবেক ভিসি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
সৌজন্যে: ইত্তেফাক