উচ্চশিক্ষার ২০ বছরের কৌশলপত্র নিয়ে কিছু কথা - দৈনিকশিক্ষা

উচ্চশিক্ষার ২০ বছরের কৌশলপত্র নিয়ে কিছু কথা

মো. শহীদুল ইসলাম |

১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপ্রধান জেনারেল আইয়ুব খান এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পাকিস্তানের রাজনৈতিক মসনদ দখল করেন। মাত্র দুই মাস পরে ওই বছরের ৩০ ডিসেম্বর তিনি এস এম শরিফের নেতৃত্বে ১১ সদস্যের একটি জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন করেন এবং ১৯৫৯ সালের ২৬ আগস্ট রিপোর্টটি গ্রহণ করেন।

১৯৫৯ সালের ৫ জানুয়ারি আইয়ুব খান কমিশন উদ্বোধন করেন। কী জন্য সে কমিশন? কী তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সে সম্পর্কে কমিশনের সদস্যদের তিনি জোরের সঙ্গে বলেন, ‘For a reorganization and reorientation of the existing educational system so as to evolve a national system which would better reflect our spiritual, moral and cultural values.’ তিনি পাকিস্তানের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় সন্তুষ্ট নন। তার পুনর্গঠন ও পুনর্নির্মাণ চান, যেন তা পাকিস্তানবাসীর মধ্যে নতুন এক আধ্যাত্মিক, নৈতিক, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের জন্ম দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করে কমিশনকে উপদেশ দেন, যেন উপযুক্ত ও মেধাবী ছাত্ররা সেখানে ঢুকতে পারে। সেই সঙ্গে উচ্চশিক্ষার গুণগত মানের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি। কমিশনকে সাবধান করে দেন যে ‘Any such scheme would, however have to ensure that the poor students was assisted in continuing his studies.’ একই সঙ্গে তিনি তাদের এ কথাও স্মরণ করিয়ে দেন যে ‘In framing its proposal he asked the commission to keep in mind the limited resources of the country’. এভাবে তিনি চোরকে চুরি করতে বললেন, আবার গৃহস্থকে সতর্ক করে দিলেন।

আইয়ুবের এই উপদেশ বাস্তবায়নের ঝুঁকি সম্পর্কে কমিশন প্রথম থেকেই উদ্বিগ্ন ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায় রিপোর্টের ভূমিকার ৬ নম্বর ধারায়। ‘সাতচল্লিশের দেশভাগের আগে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন আমাদের মনে কিছু ‘নেগেটিভ’ মনোভাব তৈরি করেছে। সে মনোভাব সংক্রামক রোগের মতো পাকিস্তানের প্রথম ১০ বছরেও আমাদের মধ্যে ক্রিয়াশীল ছিল, এটা খুব দুঃখের কথা।

’ সে মনোভাব কী? কমিশনের মতে, ‘Every action of Government whether intrinsically good or bad, met with a strong protest. Even those measures that were clearly in the public interest, and there were many, felt the sting of aggressive criticism. Government was viewed as an evil, and non-co-operation became the badge of patriotism. Passivity, which before had been an attitude of indifference was transformed into weapon of resistance. The goal was independence, the tactics were negativism and all our attitudes and actions were inspired by the end to be achieved….
এখানে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রতি কমিশনের আনুগত্যের লক্ষণ সুস্পষ্ট। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন আমাদের আইনগত সিদ্ধ সরকারকে অস্বীকার করতে শেখাল, সরকার ভালো-মন্দ যা-ই করুক না কেন, তার বিরোধিতা করতেই হবে। কারণ সেটাই দেশপ্রেম বলে বিবেচিত হতো; আমাদের মধ্যে মারমুখী সমালোচনার প্রবণতার জন্ম হলো; সরকার একটি দুষ্টগ্রহ বলে বিবেচিত হয় এবং তার বিরোধিতা করাই দেশপ্রেম বলে বিবেচিত হলো এবং তা ক্রমে প্রতিরোধের অস্ত্র হয়ে উঠল; লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা কিন্তু উপায় হলো বিশৃঙ্খল ‘নেগেটিভিজম। ’ যেনতেন প্রকারে আমাদের স্বাধীনতা পেতেই হবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই প্রবণতা পাকিস্তান আমলেও আমাদের মধ্যে কার্যকর থাকে। আমাদের মধ্যে দুটি প্রধান প্রবণতা রেখে যায়। প্রথমটি হলো ‘Lack of acceptance of a recognized authority in public life’ এবং দ্বিতীয় হলো ‘Spirit of indiscipline among the students’. আইনগত প্রতিষ্ঠিত অথরিটিকে অস্বীকার করার প্রবণতা এবং ছাত্রসমাজের উচ্ছৃঙ্খলতা। ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের মধ্যে রেখে যায় ‘The disruptive forces of communalism, regionalism and provincialism’. মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টিকারী সাম্প্রদায়িকতা, আঞ্চলিকতা ও প্রাদেশিকতা।

তাই আমাদের দরকার পরিবর্তন। মানসিক পরিবর্তন। সেই ‘মহান’ উদ্দেশ্য সামনে রেখে অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী জেনারেল আইয়ুব খান শরিফ কমিশন গঠন করেন এবং তার সীমারেখা বাতলে দেন। সেই উপদেশ শিরোধার্য করে কমিশন ১৯ নম্বর ধারায় বলছে, সরকার সম্পর্কে দেশের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন দরকার। কারণ সরকার দেশবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের সর্বোচ্চ সংস্থা। ব্রিটিশ সরকারের মতো পাকিস্তান সরকার কোনো বিদেশি শাসক নয় যে তার বিরোধিতা করতে হবে। তাদের অর্থভাণ্ডার থেকেই সরকার দেশবাসীর কাঙ্ক্ষিত দাবি পূরণ করে। সুতরাং দেশবাসীকে বুঝতে হবে যে সরকার তার অর্থভাণ্ডার থেকে অনির্দিষ্টকাল মানুষের মঙ্গলের জন্য কাজ করে যেতে পারে না। দেশবাসীকেও তাদের কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। সেদিকে লক্ষ রেখে দেশবাসীকে শিক্ষার ঐতিহ্যিক ধারণা পাল্টাতে হবে। দ্রুত তাদের এই ধারণা পরিত্যাগ করতে হবে যে সস্তায় শিক্ষা পাওয়া যায়। ‘They must rapidly set aside the erroneous belief that education can be had on the cheap…good education is expensive and educational expansion means more expense. The people must accept the fact that since it is they and their children who benefit most from education, the sacrifices required must be borne, primarily by them.’ শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ছাত্র ও তাদের অভিভাবকরাই সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়। তাই শিক্ষার খরচের একটি অংশ তাদের খরচ করা উচিত। শিক্ষা দ্বারা রাষ্ট্র যেন কোনোভাবে লাভবান হয় না। তাই কমিটি সুপারিশ করে যে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার ৫০ শতাংশ জনসাধারণকে বহন করতে হবে। সে জন্য আলাদা বিশেষ ‘শিক্ষা কর’ ধার্য করা হবে।

এ ছাড়া শরিফ কমিশনের আরো লক্ষ ও উদ্দেশ্য ছিল। তার মধ্যে একটি হলো এই যে পাকিস্তানি আদর্শের আলোকে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা, যেন দেশের সব মানুষ নিজেকে ঐক্যবদ্ধ এক পাকিস্তানি জাতির অংশ মনে করতে পারে।

এবারে দেখি বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বা বিমক (UGC) যে কৌশলপত্রটি রচনা করেছে তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ কী? এ সম্পর্কে মোটামুটি বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। শরিফ কমিশনের সঙ্গে তার যে জায়গাটিতে ঘনিষ্ঠতা, সেটুকুই উল্লেখ করব। উচ্চশিক্ষার প্রকার ও তার মানোন্নয়নের জন্য সম্পদ দরকার। সে সম্পদ আসবে কোথা থেকে? শরিফ কমিশনের মতো এখানেও Executive Summary-i vii পৃষ্ঠায় ‘Financing the strategy’ শীর্ষক অধ্যায়ে কৌশলপত্র বলছে, ‘but it is clear that government alone cannot continue to bear all the costs of higher education. Thus it is inevitable that tuition fees will be required to contribute to the financial burden and the strategy envisages that GoB’s share of university funding will be 70% by 2026, leaving 30% to be found from income generation and tuition fees.’ শরিফ কমিশনের মত, সোজা কথায় ‘ফেল কড়ি মাখো তেল। ’ কৌশলপত্র বলছে ‘The new strategy will bring increased educational opportunities for students, but they and their parents will have to meet up increased fees…. With a world class education, students will have job market access both within and outside the country.’ শরিফ কমিশন যা বলেছিল, হুবহু একই কথা বলছে ২০ বছরের কৌশলপত্র। তাই কৌশলপত্রের রচয়িতা প্রথম থেকে শঙ্কার মধ্যে ছিলেন যে এর কপালেও শরিফ কমিশনের ভাগ্যবরণ করতে হতে পারে। বাষট্টির মতো না হলেও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসমাজ এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে এবং কিছু পরিবর্তন করতে বাধ্য করেছে সরকারকে। তাই মূল রিপোর্টের শুরুতেই কৌশলপত্র বলছে : “However, many of the reports particularly those by the Sharif Commission and the Hamoodur Rahman Commission-proved controversial because of their ‘elitist’, ‘discrematory’ and ‘anti-poor’ bias, there were widespread demonstration and agitation against the Hamoodur Rahman Commission Report (শরিফ কমিশনের কথা বলতে তারা হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্টের কথা বলেছে। ) which was rejected outright by students and teachers’’.তাই এই কৌশলপত্রটি বাস্তবায়নের আগে ছাত্র-শিক্ষক স্টকহোল্ডারদের মাঝে এক সমঝোতায় পৌঁছানোর উপদেশ দেওয়া হয়। সে ধরনের কোনো সমঝোতায় পৌঁছানোর খবর আমাদের জানা নেই। কিন্তু শরিফ কমিশনবিরোধী আন্দোলনকারী নেতাদের কেউ কেউ আজ ক্ষমতায় থেকে শরিফ কমিশনের সুপারিশমালা বাস্তবায়ন করছেন। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস!

আরেকটি ছোট্ট কথা। ছাত্র-শিক্ষকের আন্দোলন ও বিরোধিতার মুখে শরিফ কমিশন প্রত্যাহৃত হয়েছিল। সে কথার উল্লেখ থাকলেও কৌশলপত্রে স্বাধীনতার পরে প্রথম শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট ‘কুদরাত-এ-খুদা’ কমিশনের রিপোর্টের কোনো উল্লেখ নেই। এই মৌনাবলম্বন অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। কারণ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানের (১৯৭২) আলোকে রচিত খুদা কমিশনের বিরুদ্ধে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো বিরোধিতা বা আন্দোলন হয়নি। সমালোচনা ছিল। সেটা কী করে বাতিল হলো? কে বাতিল করল? কেন বাতিল করল? এর কোনো উল্লেখ না থাকায় ২০ বছরের কৌশলপত্রের রাজনৈতিক মতাদর্শিক ষড়যন্ত্র উলঙ্গ করে দিয়েছে। সংবিধান থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ও ‘জাতীয়তাবাদ’ শব্দযুগল উচ্ছেদ করার সঙ্গে ২০ বছরের কৌশলপত্রের প্রণেতাদের এক ভাবাদর্শিক মেলবন্ধন কারো নজর এড়িয়ে যায় না। তবু বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের ধারক ও বাহক ক্ষমতাসীন সরকার সেই প্রতিক্রিয়াশীল, বৈষম্যমূলক ধনিক শ্রেণির পক্ষে ও গরিববিরোধী শিক্ষানীতি (২০ বছরের কৌশলপত্র) বাস্তবায়ন করে চলেছে। এর বিরুদ্ধে মুষ্টিমেয় ছাত্র ছাড়া এ দেশের প্রগতিশীল শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের কোনো মাথাব্যথা লক্ষ করা যায় না। ১৯৯২ সালের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আইন এবং ২০০৬ সালের উচ্চশিক্ষার ২০ বছরের কৌশলপত্রটি এ দেশের উচ্চশিক্ষার ‘অন্তর্জলীযাত্রা’ সম্পন্ন করেছে। উচ্চশিক্ষার লাশটি কবরস্থানে পড়ে রয়েছে আর আমরা সে লাশ সামনে নিয়ে বিলাপ করছি।

লেখক : শিক্ষাবিদ

প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0066108703613281