মালিকানার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশে প্রধানত তিন ধরনের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যথা—পাবলিক, এফিলিয়েটেড বেসরকারি ও সম্পূর্ণ ব্যক্তি বা গোষ্ঠী মালিকানাধীন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাজেট পদ্ধতিও প্রতিষ্ঠানের ধরন অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন। পাবলিক বা সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বাজেটের প্রায় ৯০ শতাংশ অর্থ আসে সরকারি তহবিল থেকে। বাকি ১০ শতাংশ আসে প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ব্যবস্থাপনা যথা—টিউশন ফি, পরীক্ষা ফি ইত্যাদি উৎস থেকে। এফিলিয়েটেড বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় ৬০ শতাংশ অর্থ পায় সরকার থেকে। বাকি ৪০ শতাংশ ব্যয় নির্বাহে তাদের নিজস্ব আয়ের ওপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু সম্পূর্ণ ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিষ্ঠানের ব্যয় নির্বাহে সরকার থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা পায় না। নিজেদের আয় থেকেই তাদের সব ব্যয় নির্বাহ করতে হয়।
আয়ের ক্ষেত্রে ভিন্নতা থাকলেও সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যয়ের খাত যথা—টিউশন ফি, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, মেইনটেন্যান্স খরচ, কেনাকাটা ইত্যাদি প্রায় একই রকম। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তাই আয়ের ক্ষেত্র বৃদ্ধিতে ছাত্রদের টিউশন ফির ওপরই নির্ভর করতে হয়। মানের শিক্ষা নিশ্চিত করতে ব্যয় বাড়াতে হয় বলে বেড়ে যায় ছাত্রদের টিউশন ফিও। আর এখানেই প্রশ্ন ওঠে বিভিন্ন মহল থেকে। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য যে বাজেট সরকার নির্ধারণ করে থাকে সেটাই কি যুক্তিসংগত বা যথার্থ? এই প্রশ্নের উত্তর জানা জরুরি। উচ্চশিক্ষায় বাজেট বৃদ্ধিতে কার্পণ্য কেন তার কারণ খুঁজে বের করতে হবে।
বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার শিক্ষা বাজেট নিয়ে ইউনেসকো, ইউনিসেফের মতো বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রতিষ্ঠান বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। এসব প্রতিষ্ঠানের রিপোর্টে যা প্রকাশ পায় তা বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রের উন্নয়নে প্রশ্নবোধক চিহ্ন বসিয়ে দেয়।
ইউনেসকোর ২০১৭ সালের রিপোর্টের ভাষ্য মতে, ‘যদিও বাংলাদেশের মোট বাজেটের আকার দিন দিন বাড়ছে, কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে বাজেটের বরাদ্দ সেই হারে বাড়েনি।’ ২০১২ সালে ইউনিসেফের রিপোর্টে বলা হয়, ‘২০০৮-০৯ এবং ২০১২-১৩ সালের মধ্যে মোট বাজেট গড়ে বৃদ্ধি পেয়েছে ২৮.৭ শতাংশ। অন্যদিকে শিক্ষাক্ষেত্রে সেই সময়কালে বাজেট বৃদ্ধি পেয়েছে গড়ে ২০.১ শতাংশ, যা মোট বাজেটের প্রায় ৮.৬ শতাংশ কম। এ ছাড়া জিডিপিতে শিক্ষায় কম বরাদ্দের দিকে বাংলাদেশ অন্যতম।’
ইনস্টিটিউট অব স্ট্যাটিসটিকসের ২০১৩ সালের উচ্চশিক্ষায় ব্যয়সংক্রান্ত নিবন্ধের (Expenditure on Education as % of GDP) তথ্য মতে, ‘বাংলাদেশের জিডিপিতে মোট খরচের মাত্র ১.৯৭ শতাংশ উচ্চশিক্ষায় ব্যয় হয়, যা ৭৮টি দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন। উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষায় জিডিপির ৫ শতাংশ বরাদ্দ থাকে। ভারতে জিডিপির প্রায় ৪ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়। মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের তুলনায় বরাদ্দ রাখা হয় ১০ গুণ বেশি। দক্ষিণ এশিয়ার ছোট দেশগুলোও কিন্তু বাংলাদেশ থেকে বেশি অর্থ বরাদ্দ রাখে উচ্চশিক্ষার জন্য। উচ্চশিক্ষায় নেপাল ব্যয় করে ৪.০৯ শতাংশ, পাকিস্তানে ব্যয় ৪.৫০ শতাংশ, আফগানিস্তান ব্যয় করে ৪.৫৪ শতাংশ এবং ভুটানের ব্যয় ৫.৫৯ শতাংশ।
বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাজেট ডকুমেন্ট থেকে দেখা যায়, ২০০৯ থেকে ২০১০ সালে জাতীয় বাজেট বৃদ্ধি পেয়েছে ১৭.৮০ শতাংশ এবং ইউজিসির বাজেট বৃদ্ধি পেয়েছিল ২৪.৬০ শতাংশ। কিন্তু ২০১৩ সালে জাতীয় বাজেট বৃদ্ধি পায় ১৭.২১ শতাংশ এবং ইউজিসির বাজেট বৃদ্ধি পায় মাত্র ৭.০৭ শতাংশ।
ইউজিসির ২০১২ সালের তথ্য মতে, ২০০৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য বরাদ্দ ছিল মোট শিক্ষা বাজেটের ৭.৮৭ শতাংশ এবং জাতীয় বাজেটের ০.৮৮ শতাংশ। অন্যদিকে ২০১২ সালে সেটি কমে গিয়ে মোট শিক্ষা বাজেটের ৬.৪৮ শতাংশ, জাতীয় বাজেটের ০.৭৩ শতাংশ হয়।
উপরোল্লিখিত তথ্যগুলো থেকে স্পষ্টত দেখা যাচ্ছে, উচ্চশিক্ষা খাতে বাংলাদেশের বাজেট বরাদ্দ ক্রমেই কমেছে। এতে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণা, শিক্ষক নিয়োগ, অবকাঠামো উন্নয়ন, পেশাগত দক্ষতা ও শিক্ষার মানে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ক্রমতালিকায় বিশ্বের সেরা ৭০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। এ দেশের জনসংখ্যার ঘনত্ব বেড়েই চলেছে। যেখানে ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর জন্য শিক্ষা বরাদ্দ বাড়ানো দরকার, সেখানে এই বরাদ্দ কমতে দেখা যায়। ইউজিসির ২০১২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০০৯ সালে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে একজন শিক্ষার্থীর মাথাপিছু জিডিপি ব্যয় ছিল ২৮.২ শতাংশ, সেখানে ২০১১ সালের রিপোর্টে দেখা যায় এই বরাদ্দ নেমে আসে ২০ শতাংশে। ২০০৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য বরাদ্দ ছিল শিক্ষা বাজেটের ৭.৮৭ শতাংশ, যা মোট জাতীয় বাজেটের ০.৮৮ শতাংশ। অন্যদিকে ২০১২ সালে বরাদ্দ ছিল শিক্ষা বাজেটের ৬.৪৮ শতাংশ, যা জাতীয় বাজেটের মাত্র ০.৭৩ শতাংশ।
২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট নিয়ে দেশের প্রতিথযশা অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদ বিশ্লেষকরা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বিশ্লেষণপূর্ণ মতামত ব্যক্ত করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আখতারুজ্জামানের (তৎকালীন প্রোভিসি) ভাষায়, প্রতিবছর বাজেটের আকার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার বরাদ্দ বাড়ে। এটা কিন্তু আসলে প্রকৃত চিত্র হওয়ার কথা নয়।
কিছুদিন আগেই মাননীয় অর্থমন্ত্রী উপস্থাপন করলেন ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট। এই বাজেট বিভিন্ন আঙ্গিকে বিশ্লেষণ করছেন অর্থনীতিবিদরা। কিন্তু এবারও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। আমাদের প্রত্যাশা, উচ্চশিক্ষা বাজেট নিয়ে অর্থবহ সিদ্ধান্ত নেবে যথাযথ কর্তৃপক্ষ। বিশাল জনগোষ্ঠীকে যদি শিক্ষা ও প্রযুক্তি দিয়ে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তর করা যায়, তাহলেই আমাদের উন্নত দেশ গঠনের প্রচেষ্টা সফল হবে। ধীরে ধীরে শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় মানসম্মত শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। শিক্ষার মান রক্ষা করতে হলে অবশ্যই অর্থ বাড়াতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : উপাচার্য নর্দান ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি, খুলনা চেয়ারম্যান, নর্দান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ ট্রাস্ট
সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ