উচ্চশিক্ষায় ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা’ উপেক্ষিত কেন? - দৈনিকশিক্ষা

উচ্চশিক্ষায় ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা’ উপেক্ষিত কেন?

মোহাম্মাদ আনিসুর রহমান |

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ তথ্যমতে, বাংলাদেশে ৪২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ১০৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ৩টি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধিকাংশ অনুষদ কিংবা বিভাগের ক্ষেত্রে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে তাত্পর্যপূর্ণ কোনো মৌলিক বই মাতৃভাষা বাংলায় নেই বললেই চলে। সঙ্গত কারণে শিক্ষকগণও ইংরেজি বই শিক্ষার্থীদেরকে পড়ার জন্য বলে থাকেন। বাংলা ভাষায় লিখিত মৌলিক বইয়ের অভাব এবং বিকল্প না থাকায় এক প্রকার বাধ্য হয়ে বুঝে কিংবা না বুঝে ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পড়তে হয়। যত্সামান্য যারা বাংলা মাধ্যমে পড়ালেখা করেন, তাদেরকে ইংরেজি থেকে অনুবাদ করে ‘নোট’ তৈরি করে পড়তে হয়। নিঃসন্দেহে অন্য যে কোনো ভাষায় দক্ষতা অর্জন করা গৌরবের বিষয়। তবে, একটি সনদপত্রের প্রত্যাশায় আমরা অন্য ভাষায় যা শিখে থাকি, তার দৌড় অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরীক্ষার খাতা পর্যন্তই। আমাদের মনে রাখা দরকার, ‘অসম্পূর্ণ জ্ঞান অজ্ঞতার চেয়েও বেশি বিপজ্জনক’ হয়।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পেশাগত জীবনে শিক্ষকদের তেমন কোনো জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতা না থাকায় মাতৃভাষায় মৌলিক বই কিংবা গবেষণাপত্র প্রকাশে কোনো বাধ্যবাধকতার সংস্কৃতি গড়ে উঠেনি। এমনকি রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রশাসনের তোষামোদ করে পদোন্নয়ন অতিসহজ বলে গবেষণাপত্রকে এখনো কেউ তেমন গুরুত্ব দেন না। চাকরি করছেন কিংবা ৩৫-৪০ বছর চাকরি করে অবসর নিয়েছেন এমন অনেক অধ্যাপক আছেন যারা অধ্যাপনাকালীন সময়ে কোনো মৌলিক বই প্রকাশ, গুরুত্বপূর্ণ বই বাংলায় অনুবাদ কিংবা আন্তর্জাতিক জার্নালে মানসম্মত কোনো গবেষণাপত্র প্রকাশ করেননি। অবস্থাদৃষ্টে তাত্পর্যসংখ্যক বয়োকনিষ্ঠ শিক্ষকগণও বয়োজ্যেষ্ঠদের দেখানো পথেই হাঁটছেন।

অন্যদিকে, দুঃখজনক বিষয় হলো, দেশে অনুমোদিত ও প্রতিষ্ঠিত অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাতৃভাষায় মৌলিক জ্ঞানচর্চার পর্যাপ্ত কোনো সুযোগই নেই। পাঠদানের মাধ্যম ইংরেজি হওয়ায় রাষ্ট্রভাষা বাংলা একপ্রকার উপেক্ষিত। তাই, মাতৃভাষায় চর্চার জন্য স্বল্প ক্রেডিটের ‘নন-মেজর কোর্স’ হিসেবে ‘বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস’, ‘বাংলাদেশের সমাজ, সংস্কৃতি ও সভ্যতা’ এবং ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য’ আবশ্যক অন্তর্ভুক্তি, পঠন ও অনুশীলন যৌক্তিক দাবি রাখে। যদিও ‘বাংলাদেশ স্ট্যাডিজ’ নামে একটি কোর্স পড়ানো হয়, যার মাধ্যমও ইংরেজি। মাতৃভাষা চর্চার অবারিত সুযোগ প্রতিষ্ঠায় আমাদের উদাসীনতা, দায়িত্বহীনতা ও অবহেলা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

জাতি হিসেবে ‘আত্মপরিচয়’, ‘প্রমিত মাতৃভাষার চর্চা’ এবং দেশের ‘সমাজ, সংস্কৃতি ও সভ্যতা’ জানা ও তার সংস্পর্শে থাকা একজন সুনাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। ১.৪২ বিলিয়ন (২০১৮) চীনা জনগোষ্ঠী তাদের মাতৃভাষা ‘মান্দারিন’ চর্চার বিকল্প আজও ভাবতে পারেন না। এমনকি তারা সুযোগ পেলে অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় বৃত্তি দিয়ে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের শিক্ষার্থীকে ‘মান্দারিন’ শিক্ষা দেন । চিকিত্সাবিদ্যা, প্রকৌশলবিদ্যা, বিজ্ঞানসহ জ্ঞানের সকল স্তরের শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষা চর্চার বিকল্প তাদের কাছে অদ্যাবধি নেই। অথচ গোটা পৃথিবীর সকল শাখায় আজ তারা নেতৃত্ব দেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করেছেন।

বিস্ময়ের সঙ্গে দেখলাম, আমার পিএইচডি তত্ত্বাবধায়ক ‘পুঁজিবাদ ও বিশ্বায়ন’ এর একটি ইংরেজি বই মান্দারিন ভাষায় অনুবাদ করার জন্য চীন সরকার তাকে ৮০ হাজার ইউয়ান (প্রায় ১০ লাখ ১৫ হাজার টাকা) বরাদ্দ দিয়েছেন। এজন্য যে সকল ভাষায় বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মানুষ কথা বলেন সেই সকল ভাষায় কিংবদন্তিতুল্য বাংলা সাহিত্যগুলোকে অনুবাদ করে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার নৈতিক দায়িত্ব নিতে পারে বাংলা একাডেমি। দেশের খ্যাতনামা অধ্যাপক-সাহিত্যিক, অনুবাদে পারদর্শী এমন বরেণ্য ব্যক্তিবর্গকে তাদের পছন্দসই সাহিত্যকর্মের শাখাভিত্তিক অনুবাদের দায়ভার দেওয়া যেতে পারে। অন্যদিকে উচ্চশিক্ষার প্রতিটি শাখার জন্য (চিকিত্সা, বিজ্ঞান, প্রকৌশলবিদ্যাসহ) প্রথম ধাপে কমপক্ষে ১০টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইংরেজি মৌলিক বই বাংলায় অনুবাদ শুরু করার গৌরবময় দায়িত্ব নিতে পারে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। রাষ্ট্রের এখন এমন শিক্ষাগুরু প্রয়োজন, যারা স্বপ্ন দেখাবেন ‘শিক্ষায়’ আর বাস্তবায়ন ঘটাবেন ‘গবেষণায়’।

লেখক : পিএইচ.ডি গবেষক, ঝেজিয়াং ইউনিভার্সিটি, চীন এবং শিক্ষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, বশেমুরবিপ্রবি, গোপালগঞ্জ

 

সৌজন্যে: ইত্তেফাক

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.008012056350708