একাত্তর সালটা বাংলাদেশে মেয়েদের জন্য ছিল চরম দুর্দশার। পাকিস্তানি হানাদাররা হিন্দু-মুসলমান-নির্বিশেষে মেয়েদের ওপর অত্যাচার চালিয়েছে। রাষ্ট্র তাদের লেলিয়ে দিয়েছিল। ছাড়পত্র দিয়ে দিয়েছিল যা ইচ্ছা তা-ই করার। তারা সেটা করেছেও। রাষ্ট্রীয় সমর্থনে ক্ষমতাবান হয়ে হত্যা, অস্থাবর সম্পত্তি লুণ্ঠন এবং ধর্ষণ সমানে চালিয়েছে। বুধবার (২৭ নভেম্বর) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, এখন তো পাকিস্তান নেই, এখন তো আমরা স্বাধীন, বাঙালিই শাসন করছে বাঙালিকে। তাহলে এখন কেন মেয়েরা এভাবে নির্যাতিত হচ্ছে? পাচার হচ্ছে ভারতে, জীবিকার অন্বেষণে মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে লাঞ্ছিত হচ্ছে, ধর্ষিত হচ্ছে যেখানে-সেখানে, আত্মহত্যা করছে যখন-তখন, আটকা পড়ছে বাল্যবিয়ের ফাঁদে? কারণটি আমাদের অজানা নয়।
কারণ হচ্ছে পাকিস্তান বিদায় হয়েছে ঠিকই; কিন্তু ওই রাষ্ট্রের আদর্শ বিদায় হয়নি। আদর্শটা ছিল পুঁজিবাদী। সে আদর্শের এখন জয়জয়কার। আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি। দুর্বল লাঞ্ছিত হচ্ছে, হতে থাকবে। কেননা আমরা উন্নতি করতেই থাকব এবং অত্যন্ত অল্প কিছু মানুষের উন্নতি কাল হয়ে দাঁড়াবে বাদবাকিদের জন্য। এটাই ঘটছে।
পাকিস্তানের প্রেতাত্মা এখনো আমাদের পিছু ছাড়েনি, এমন কথা যাঁরা বলেন তাঁরা মোটেই মিথ্যা কথা বলেন না। কিন্তু তাঁদের বেশির ভাগই প্রেতাত্মাটাকে চিহ্নিত করেন না। প্রেতাত্মাটা অন্য কিছু নয়, প্রেতাত্মাটা পুঁজিবাদ। আর প্রেতাত্মাই বলি কী করে, সে তো ভীষণভাবে জীবন্ত। সে তো ব্যস্ত জীবিতদের জীবন কেড়ে নেওয়ার কাজে। ধর্মকে সে ব্যবহার করে উপায় ও আচ্ছাদন হিসেবে। না মেনে উপায় নেই যে আমাদের জাতীয়তাবাদীরা সবাই পুঁজিবাদী—পাকিস্তানিদের সঙ্গে তাদের নামে মস্ত পার্থক্য, চরিত্রে মৌলিক পার্থক্য নেই।
তাহলে উপায় কী? প্রতিবাদ? অবশ্যই। প্রতিবাদটা চলছে। বাল্যবিয়ে অসম্মত মেয়েরা কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ করছে, এমন খবর পাওয়া যাচ্ছে। কিশোরী মেয়েরা বিয়ের আসর থেকে সহপাঠিনীকে উদ্ধার করছে, আমরা জানতে পাচ্ছি। খবরের কাগজেই বের হয়েছে এমন খবর যে মাগুরায় এক মা তাঁর মেয়েকে উত্ত্যক্তকারী যুবককে চাপাতি দিয়ে কুপিয়েছেন। কিন্তু তাতে তো ব্যবস্থাটা বদলায় না। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আমেরিকায় বিক্ষোভ চলছে।
আমেরিকার অরেগনে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে যে দুজন আমেরিকান নিহত হয়েছেন তাঁদের একজনের মা বলেছেন, তাঁর ছেলে বীর ছিল, মৃত্যুর পরেও বীর থাকবে। মানুষের মনুষ্যত্ব কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে, সে চেষ্টা চলবে; কিন্তু মনুষ্যত্ব নষ্ট হওয়ার নয়, হবেও না। তবে একলা একলা প্রতিবাদ করে যে কাজ হবে না, সেটা তো প্রমাণিত সত্য।
তাহলে কি পালাতে হবে? কিন্তু পালাবেন কোথায়? একাত্তরে বাংলাদেশ থেকে মানুষকে পালাতে হয়েছিল, ফিরে এসে তারা দেখেছে এ কী পাকিস্তান তো রয়েই গেছে! বদলটা শুধু নামেই। মানুষ এখনো পালাচ্ছে। ধনীরা এরই মধ্যে বিদেশে বাড়িঘর তৈরি করেছেন, সময়মতো চলে যাবেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দলীয় সংঘর্ষ থামানোর লক্ষ্যে দলীয় লোকদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে দল যদি ক্ষমতায় না থাকে, তাহলে টাকা-পয়সা নিয়ে পালানোর পথ পাওয়া যাবে না।
এই সতর্কবাণীর দরকার ছিল কি? যারা পেরেছে তারা তো এরই মধ্যে ব্যবস্থা করেছে, অন্যরাও তৎপর আছে। আর যাদের টাকা-পয়সার অভাব, দলের লোক নয়, সাধারণ মানুষ, তাদেরও একটা অংশ কিন্তু পালাচ্ছে। রিপোর্টে বলছে, নৌপথে ইউরোপে যারা পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করে তাদের মধ্যে সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশিরা এখন শীর্ষস্থানে। হতভাগা এসব মানুষ অবশ্য টাকা পাচারের জন্য যায় না, টাকা উপার্জনের জন্যই যায়। কিন্তু যাচ্ছে তো।
জীবন বাজি রেখে যাচ্ছে। ঝাঁপ দিচ্ছে সমুদ্রে। যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, আফগানিস্তান, ইরিত্রিয়া থেকে মানুষ পালাবে সেটা স্বাভাবিক; কিন্তু যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে এবং উন্নতিতে পুলকিত বাংলাদেশ থেকে এত মানুষ পালাচ্ছে কেন? পালাচ্ছে এখানে জীবিকার নিরাপত্তা নেই বলে এবং মেয়েদের দুরবস্থা বলছে এখানে নিরাপত্তা নেই জীবনেরও।
সিদ্ধান্তটা তো তাই অপরিহার্য। করণীয় হচ্ছে পুঁজিবাদকে বিদায় করা। কিন্তু সে কাজ তো একা কেউ করতে পারবে না, করতে গেলে শুধু হতাশাই নয়, বিপদ বাড়বে। বিদায় করার জন্য দরকার হবে আন্দোলন এবং আন্দোলনের জন্য চাই রাজনৈতিক দল। শুধু দলেও কুলাবে না, শত্রুকে যদি সঠিকভাবে চিহ্নিত করা না হয় এবং সঠিক রণনীতি ও রণকৌশল গ্রহণ করা না যায়। বাংলাদেশে এবং বিশ্বের অনেক দেশেই জাতীয়তাবাদী যুদ্ধটা শেষ হয়েছে, বাকি রয়েছে সমাজতন্ত্রের জনযুদ্ধ।
এই যুদ্ধটা যে সহজ হবে না সেটা তো স্পষ্ট। জবরদস্ত পুঁজিবাদের দখলে অনেক অস্ত্র রয়েছে—খুবই শক্তিশালী একটি অস্ত্র হচ্ছে মিডিয়া। মিডিয়া পুঁজিবাদের নৃশংসতার খবর ছিটেফোঁটা দেয়; কিন্তু আসল খবর দেয় না, ঢেকে রাখে, বিভ্রান্ত করে এবং নানা কিসিমের রূপকথা তৈরির কারখানা চালু রাখে। ১০ জুন বাংলাদেশের সব খবরের কাগজের প্রথম পাতায় মস্ত করে ছাপা হয়েছে একটি রূপকথার খবর। ক্রিকেটে বাংলাদেশ নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে দিয়েছে। রূপকথাই বলা হয়েছে খবরটিকে। কেননা এ বিজয় ছিল অপ্রত্যাশিত, প্রায় অসম্ভব।
মিডিয়া রূপকথাকে খুব পছন্দ করে; কিন্তু রূপকথা তো নারকীয় বাস্তবতাকে অবলুপ্ত করতে পারবে না, যার একটি খবর ওই দিনের পত্রিকায়ই আছে এবং প্রথম পাতায়ই। সেটি হলো তিন শিশুসহ এক মায়ের লাশ উদ্ধার। এই রাজধানীতেই। ধারণা করা হচ্ছে, মা নিজেই খুন করেছেন নিজের সন্তানদের, একের পর এক—তারপর খুন করেছেন নিজেকে। মৃত মায়ের ভাই অবশ্য বলছেন, অসম্ভব, তাঁর বোন এ কাণ্ড করতে পারেন না, অন্যরাই ঘটিয়েছে—এটি একটি হত্যাকাণ্ড।
যেভাবেই ঘটুক, হত্যা তো বটেই। এবং তিনটি সন্তান নিয়ে মা যে চরম হতাশায় ভুগছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁর স্বামীর একসময় ভালো আয় ছিল, প্রতারক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ডেসটিনিতে ৫০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন, মার খেয়েছেন; নিজে ব্যবসা করার চেষ্টা করেছেন, সফল হননি, সন্তানদের স্কুলের বেতন দিতে পারেন না, তাদের এমনকি ভালোমতো আহারও জোটে না, পারিবারিক বিরোধ আছে সম্পত্তি নিয়ে।
কোথাও কোনো আলো ছিল না আশার। আর সব বোঝা গিয়ে চেপে বসেছিল বিপন্ন মেয়েটির ঘাড়ের ওপর। মেধাবী ছাত্রী ছিলেন তিনি, এমএ পাস করেছেন, চাকরি খুঁজেছেন, পাননি। স্বামীর তবু বাইরে একটা জীবন ছিল, স্ত্রীর জীবন তিন কামরার। জীবন তাঁর জন্য দুঃসহ এক যন্ত্রণা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
উন্নতির রূপকথার খবর চিৎকার করে প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা এখন এমনই বিকট যে তা ঢেকে রাখার উপায় নেই। ওই দিনের পত্রিকায় বাংলাদেশের মানুষের নরকবাসের আরো খবর আছে। ১. সাতক্ষীরায় দ্বিতীয় মেয়ে হওয়ায় বাবার হাতে নবজাতক খুন। ২. বরগুনায় যৌতুক না পেয়ে অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূকে পিটিয়ে হত্যা। ৩. রৌমারীতে ক্লাসরুমে ঢুকে ছাত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টা। ৪. আড়াইহাজারে বিয়ের কথা বলে ছাত্রীকে ধর্ষণ। ৫. গাজীপুরে তিন সন্তানসহ নিখোঁজ প্রবাসীর স্ত্রী। ৬. ঢাকায় মেয়ে হত্যার বিচার চেয়ে মায়ের সংবাদ সম্মেলন।
পরের দিনের অর্থাৎ ১১ জুনের খবর : ১. রাজধানীতে শিশু ধর্ষণের অভিযোগে দুজন গ্রেপ্তার। ২. শায়েস্তাগঞ্জে ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে বিধবাকে পিটিয়ে হত্যা। ৩. কালিয়াকৈরে স্বামীকে বেঁধে স্ত্রীকে গণধর্ষণ। ৪. হবিগঞ্জে প্রকাশ্যে সড়কে ধর্ষণের পর পিটিয়ে হত্যা। প্রতিটি ঘটনাই ভয়াবহ। ‘উন্নতি’ অব্যাহত রয়েছে।
এই উন্নতির অন্তর্গত কান্না বলছে ব্যবস্থার বদল চাই। হতাশা কাটবে না পরিবর্তনের আন্দোলন যদি জোরদার না হয়।
লেখক : সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।