ছায়াঢাকা মায়াঘেরা প্রকৃতির অপরপ সৌন্দর্যে ভরপুর। নানা প্রজাতির পাখির কিচির মিচির সুর। শহরের কোলাহল মুক্ত। সবুজের বুকে রঙ-বেরঙের সুউচ্চ দালান। প্রকৃতির এমন মনোলোভা সৌন্দর্যমণ্ডিত পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (পবিপ্রবি) ক্যাম্পাস। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এই সবুজ ক্যাম্পাস পার করেছে দীর্ঘ ১৮টি বছর। ক্যাম্পাসটি নিজস্ব ঐতিহ্য ও স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে প্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে আজ পদার্পণ করেছে গৌরবময় সাফল্যের ১৯ বছরে।
পটুয়াখালী জেলা শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার উত্তরে এবং বরিশাল বিভাগীয় শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দক্ষিণে বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়কের ৫ কিলোমিটার পূর্বে দুমকি উপজেলা সদরের প্রাণকেন্দ্রে ৮৯ দশমিক ৯৭ একর জমির ওপর অবস্থিত পবিপ্রবি ক্যাম্পাস। ১৯তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষ্যে এই দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনা রঙ-বেরঙের ব্যানার ফেস্টুন দিয়ে সাজানো হয়েছে। শিক্ষক-কর্মকর্তা ও শিক্ষার্থীরা এককাট্রা হয়ে আনন্দ উৎসবে মুখর করে তুলবেন বন্যাকবলিত দক্ষিণাঞ্চলের এ বিদ্যাপীঠকে।
১৯তম প্রতিষ্ঠা দিবস উৎসবে আয়োজন করা হয়েছে ব্যাপক কর্মসূচির। সকাল ১০টায় প্রশাসনকি ভবনের সামনে জাতীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় পতাকা উত্তোলন করবেন এবং বেলুন ও শান্তির প্রতীক পায়রা আকাশে উড়িয়ে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্ধোধন করবেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. হারুন-অর-রশীদ এবং উপ-উপার্চায অধ্যাপক মোহাম্মাদ আলী। সকাল সোয়া ১০টায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যে পুস্পস্তবক অর্পণ এবং সাড়ে ১০টায় ক্যাম্পাস পরিবারের সকল শিক্ষক-কর্মকর্তা এবং শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হবে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার গল্প : ৯০ এর দশকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের প্রাণের দাবি হয়ে ওঠে পটুয়াখালী কৃষি কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার। এই লক্ষ্যে স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন পরিষদ। পরিষদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ মার্চ সরকার পটুয়াখালী কৃষি কলেজকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীতকরণের ঘোষণা দেয়। আর ২০০০ খ্রিষ্টাব্দের আজকের এই দিনে (৮ জুলাই) পটুয়াখালী কৃষি কলেজের অবকাঠামোতেই পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে ২০০১ খ্রিষ্টাব্দের ১২ জুলাই জাতীয় সংসদে পবিপ্রবি আইন পাস হয়।
ক্যাম্পাস পরিচিতি : মূল ক্যাম্পাস ৩৮ একর, কৃষি গবেষণা খামার ৩৯ একর ও বহিঃক্যাম্পাস (বাবুগঞ্জ, বরিশাল) ১২ দশমিক ৯৭ একরসহ মোট ৮৯ দশমিক ৯৭ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত এই দৃষ্টিনন্দন বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবিশাল মনোরম ক্যাম্পাস। ক্যাম্পাসের উত্তর-পশ্চিমাংশে অত্যাধুনিক ছাত্র-ছাত্রী হল শোভা পায়। এর পাশেই রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ। আর মসজিদের পাশেই রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র বা হেলথ কেয়ার সেন্টার। এর উল্টো দিকে রয়েছে গ্রন্থাগার ভবন।
একটি প্রশস্থ রাস্তা ক্যাম্পাসের ওপর দিয়ে পূর্বের পীরতলা থেকে পশ্চিমের বরিশাল-পটুয়াখালী-বাউফল মহাসড়কের সাথে সংযোগ স্থাপন করেছে। এ সড়কের দক্ষিণ দিকে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের আবাসিক ভবন। মূল ক্যাম্পাসের পূর্বদিকে পীরতলা বাজার পেরোলেই ৩৭ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত কৃষি গবেষণা খামার ও এম কেরামত আলী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্র হল। এখানে আরও রয়েছে ‘সৃজনী বিদ্যানিকেতন’ নামের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক-মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
বর্তমান অবস্থা : বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি পাবার পর এ পর্যন্ত সাফল্যের সাথে এ বিশ্ববিদ্যালয় তার শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। বর্তমানে ৮টি অনুষদে ৫৮টি বিভাগে ২৫১২ জন ছাত্র-ছাত্রী, ২৫৫ জন শিক্ষক, ১৬০জন কর্মকর্তা ও ৩৮৭ জন কর্মচারী রয়েছে। এখানে উচ্চতর ডিগ্রি হিসেবে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি ডিগ্রি রয়েছ। কেবল কৃষি অনুষদ নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে দেশ ও জাতির সময়োপযোগী চাহিদা পূরণে বিশ্ববিদ্যালয়ে খোলা হয়েছে ব্যবসায় প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা (বিবিএ), কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) অনুষদ, অ্যানিমাল সায়েন্স অ্যান্ড ভেটেরিনারি মেডিসিন (এএনএসভিএম) অনুষদ, মৎস্যবিজ্ঞান অনুষদ, পরিবেশ বিজ্ঞান ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অনুষদ, খাদ্য ও পুষ্টি বিজ্ঞান অনুষদ, ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অনুষদ।
এ বিশ্ববিদ্যালয়টি দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। ছাত্রদের জন্য শের-ই-বাংলা (ডি ১, ডি ২) ও এম. কেরামত আলী হল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ছাত্রীদের জন্য কবি বেগম সুফিয়া কামাল ও বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল নামে ২টি ছাত্রী হল রয়েছে। বরিশালের বাবুগঞ্জের বহিঃস্থ ক্যাম্পাসে রয়েছে বীর শ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর ছাত্র হল ও বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছাত্রী হল। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে রয়েছে একটি সমৃদ্ধ ডিজিটাল লাইব্রেরি। দু’তলা বিশিষ্ট লাইব্রেরি ভবনে ৫৫ হাজারেরও বেশি বিভিন্ন ধরনের বই, ইন্টারনেট ব্যবস্থা, আর্ন্তজাতিক ভলিউম ও সাময়িকী রয়েছে।
অত্যাধুনিক শিক্ষাদান পদ্ধতি ও ডিজিটাল ক্যাম্পাস : অত্যাধুনিক শিক্ষাদান পদ্ধতি হিসেবে খ্যাত আমেরিকার ক্রেডিট কোর্স সিস্টেম পদ্ধতি চালু রয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে। দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এ বিশ্ববিদ্যালয়েই ২০০২ খ্রিষ্টাব্দে সর্বপ্রথম চালু করা হয় স্নাতক পর্যায়ে কৃষি শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি ভাষা। হাতে-কলমে শিক্ষা দানের জন্য এখানে রয়েছে ৩২টি সমৃদ্ধ গবেষণাগার বা ল্যাবরেটরি। রয়েছে অত্যাধুনিক সরঞ্জাম সম্বলিত একটি সুবৃহৎ কেন্দ্রীয় গবেষণাগার। এটির মাধ্যমে কৃষি ক্ষেত্রে নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে বিশ্ববিদ্যালয়টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীর জন্য ডিজিটাল পরিচয়পত্র (ইলেকট্রনিক চিপ) করা হয়েছে। ক্যাম্পাসের সব হলসহ সর্বত্র হাইস্পিড ওয়াইফাই নেট চালু করা হয়েছে। এতে করে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার ক্ষেত্রে এক নব অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের কথা : পবিপ্রবি’র শিক্ষার্থী মোশায়দুল ইসলাম সাদি, রাকিবুল ইসলাম রাকিব, রেজওয়ানা হিমেল ও রওশন আরা শমি বলেন, এই সবুজ ক্যাম্পাসে আমাদের স্বপ্ন সুন্দর, স্নিগ্ধ একতার উচ্ছ্বাস, অফুরান তারুণ্যের শান্তির প্রয়াস, সাম্য, প্রীতির অনন্য আলোয় উজ্জীবিত থাকুক আমাদের প্রিয় ডিজিটাল পবিপ্রবি ক্যাম্পাস।
বিশ্ববিদ্যালয়কে আরও প্রাণবন্ত ও মুখোরিত করার জন্য যুগোপযোগী অনুষদ ছাড়াও বিভাগ ভিত্তিক ডিগ্রি চালু করে ছাত্র-ছাত্রী বাড়ানোর পদক্ষেপ নেয়া দরকার। আমাদের শিক্ষার্থীদের মানসিক প্রশান্তির জন্য পর্যটন নগরী কুয়াকাটাকে কাজে লাগিয়ে দক্ষিণ বঙ্গের মানসম্মত সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বর্তমান সরকারসহ সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের এখনই বৃহৎ পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। তাছাড়া বর্তমান বিশ্বের চাহিদাসম্নত নতুন নতুন বিভাগ খোলার জন্য সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষকে আবেদন জানাচ্ছি। কেননা মনে রাখতে হবে পুরো বরিশাল বিভাগের কোটি মানুষের সন্তানদের উচ্চশিক্ষার জন্য এটি অন্যতম প্রধান বিদ্যাপীঠ। পবিপ্রবি’র আগামী হোক কন্টকমুক্ত, প্রস্ফুটিত, আজকের এই দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি কামনা করছি।
উপাচার্যের কথা : স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য দেশ বরেণ্য কৃষি বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মো. হারুনর অর রশীদ বলেন, একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দক্ষ ও যোগ্য মানবসম্পদ তৈরি করাই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য। গত ৫ জানুয়ারী ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব নেয়ার পর ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী, সাংবাদিকবৃন্দ ও এলাকার জনগনের সহযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয়টিকে একটি আদর্শ ও বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য আমি আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রিধারী শিক্ষার্থীরা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিলাভের ক্ষেত্রে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে চলেছে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়টিকে দেশের অন্যতম উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে চাই।
পরিশেষে : পবিপ্রবি’র কাছে দক্ষিণাঞ্চলবাসীর অনেক প্রত্যাশা। এর ছাত্র-ছাত্রীদের চোখে অনেক স্বপ্ন। সে প্রত্যাশা পূরণের এবং সে-স্বপ্ন বাস্তবায়নের দায়িত্ব এর শিক্ষক-কর্মকর্তা ও ছাত্র-ছাত্রীদেরই নিতে হবে। দক্ষতা, কর্তব্যনিষ্ঠা ও সততায় দিক্ষিত হোক এই ক্যাম্পাসের সকল কার্যক্রম, ধাবিত হোক জাতীয় উন্নয়নের মহা সড়কে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক-কর্মকর্তা ও শিক্ষার্থীর এটাই কামনা।
লেখক: সহকারী রেজিস্ট্রার (ছাত্র বিষয়ক উপদেষ্টার কার্যালয়),পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।