বছর কয়েক আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছিলেন দেশের উন্নয়ন-উৎপাদনের শতকরা ৮৫ ভাগ কাজ করেন এদেশের ডিপ্লোমা প্রকৌশলীরা। অথচ এই সরকারের আমলেই ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সকে মানহীন করে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশ যেন পিছিয়ে পড়ে সেই লক্ষ্য হাসিলের উদ্দেশ্যে উঠেপড়ে লেগেছে একটি কুচক্রী মহল। সম্প্রতি পলিটেকনিক তথা ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তির যোগ্যতা ও বয়সসীমা বাতিল একটি জ্বলন্ত প্রমাণ।
১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে যুক্তফ্রন্ট সরকারের শিল্প মন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টির মাধ্যমে দেশকে সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে তৎকালীন পাকিস্তানের দুটি অংশে দুটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপন করেন। একটি করাচীতে এবং একটি ঢাকায়। দুটি পলিটেকনিকে চার বছর মেয়াদী ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স চালু করা হয়। একসময় চার বছরের কোর্সকে কমিয়ে তিন বছর করা হয়, পরে সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী ও ছাত্রদের আন্দোলনের পরিপেক্ষিতে আবার চার বছর করা হয়। আন্তর্জাতিক মানের কারিকুলামের এই কোর্সটিকে ষড়যন্ত্র করে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাদান পদ্ধতি থেকে বাংলা মাধ্যমে পরিণত করা হয়। কেন বারবার এই কোর্স নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে? কেন মিড লেভেল ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করার তাণ্ডবের মেতেছে কুচক্রী মহল? এই প্রশ্নগুলোর উত্তরের জন্য আমাদের একটু বিশ্লেষণে যেতে হবে।
আমাদের দেশে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স নিয়ে অনেকের মনে বিভ্রান্তি আছে। অনেকে এই কোর্সকে শুধুমাত্র কারিগরি প্রশিক্ষণ মনে করেন। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ এর দুটি আলাদা দর্শন আছে। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দুটি ক্ষেত্রের উদ্দেশ্য ভিন্ন, আয়োজন ভিন্ন, পাঠদান পদ্ধতি ভিন্ন, অ্যাসেসমেন্ট পদ্ধতি ভিন্ন, পরিচালনা ও ব্যবস্হাপনা পদ্ধতি ও কৌশলও ভিন্ন। এখন উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রশ্ন হচ্ছে পলিটেকনিকের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স কি শিক্ষা না প্রশিক্ষণ?
শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য মানুষের আচরণগত পরিবর্তন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আচরণগত পরিবর্তনের সাথে জীবিকা নির্বাহের সংস্থানসহ সমাজের সভ্য সুন্দর জীবনযাপনের উপযোগীকরণ। দীর্ঘমেয়াদী প্রোগ্রামের মাধ্যমে ভবিষ্যতের সুনাগরিক হিসেবে সমাজ ও কর্মক্ষেত্রের উপযুক্ত মানুষ তৈরি করা শিক্ষার মূল কাজ। যার প্রভাব সুদূরপ্রসারী, যেখানে তাত্ত্বিক বিষয়সমূহের উপর ভিত্তি করে দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের উপর বেশি জোর দেয়া হয়ে। শিক্ষার বাস্তবায়ন কৌশল হচ্ছে বিদ্যমান সমবয়সী সমমনোভাবাপন্ন শিক্ষার্থীদের সুদূরপ্রসারি চিন্তা, জাতীয় চেতনা বোধ ও বিশ্ব নাগরিক হিসেবে এমন একটি কাঠামো ও পরিবেশের মধ্য দিয়ে গড়ে তোলা যেখানে শিক্ষক, শ্রেণিকক্ষ, ল্যাব, ওয়ার্কশপ, বই ইত্যাদি ভৌত উপাদানই জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের একমাত্র উৎস নয়, প্রকৃতি, শিক্ষার্থীদের পারস্পরিক মেলামেশা, কথোপকথন, উঠাবসা আরও চালচলন, কৃষ্টি কালচার, ধর্মাচার, মানবিক মূল্যবোধের চর্চা শিক্ষার অন্যতম উপাদান হিসেবে কাজ করে। এখানে একটি নিদিষ্ট শ্রেণির শিক্ষা কার্যক্রমের একটি নিদিষ্ট বয়সের সময় মানসিকতার কাঙ্ক্ষিত আগ্রহীদের একত্র করা হয়ে। এর অনাগত প্রভাব দীর্ঘ মেয়াদী।
অন্যদিকে প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য সচরাচর লেখাপড়া থেকে ঝরেপড়া কিংবা কর্মসংস্থানে নিয়োজিত ব্যক্তিদের আপ স্কিলিং-রিস্কিলিং করার জন্য প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে গড়ে তোলা। এটা সাধারণত স্বল্প মেয়াদি এবং যে কোনো বয়সী লোকজন অংশ নিতে পারে। এখানে প্রায়োগিক বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়ে।
বয়সের বড় ধরনের পার্থক্য নিয়ে শিক্ষার্থী একই ক্লাসরুমে ক্লাস করলে শিক্ষকদের পাঠদান যেমন ব্যাহত হয় তেমনি নানা প্রকার সামাজিক সমস্যা দেখা দেয়। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ একই ক্লাসে চলে না, চালাতে হয়ে ভিন্ন ভেন্যুতে একই ভেন্যুতে হলেও ভিন্ন শিফটে।
উক্ত আলোচনার পরে বলার অবকাশ রাখে না ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং প্রোগ্রাম একটি একাডেমিক কোর্স, প্রশিক্ষণ কোর্স নয়। সুতরাং ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে যারা অধ্যয়ন করে তারা শিক্ষার্থী, প্রশিক্ষণার্থী নয়। কাজেই পলিটেকনিক ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে কোমলমতি সদ্য এসএসসি পাস ভর্তি ইচ্ছুকদের সাথে যে কোনো বয়সের শিক্ষার্থী ভর্তি কোনোভাবেই যুক্তিসংগত নয়। বিভিন্ন পলিটেকনিক ও কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বয়স্কদের জন্য স্বল্প মেয়াদী বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কোর্স চালু রয়েছে বহু আগে থেকে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ড পলিটেকনিক ভর্তি নিয়ে কিছু হাস্যকর যুক্তি দেখিয়েছেন। তাদের মতে করোনাকালীন বিদেশ ফেরতদের প্রশিক্ষিত করা এবং পলিটেকনিকের শূন্য আসন পূরণের জন্য জিপিএ মান কমিয়ে দিয়ে বয়সসীমা উঠিয়ে দিয়েছেন। এখন দেখা যাক ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে কী কী বিষয় পড়ানো হয়? ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলকভাবে এইচএসসির ম্যাথ, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রিসহ বিভাগ অনুযায়ী ডিগ্রি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো স্ট্রাকচারাল ডিজাইন, মেশিন ডিজাইন, টুলস ডিজাইন, এসি সার্কিট, ডিসি সার্কিট, মেটালার্জিকাল, মেট্রোলজির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো অধ্যয়ন করে পাস করতে হয়ে। এখন কথা হচ্ছে স্টাডি ব্রেক যাওয়া বয়স্ক শিক্ষার্থীরা এসব জটিল কঠিন বিষয়গুলো কীভাবে আয়ত্ত করবে? আর বিদেশ ফেরত পরিবারের উপার্জনশীল মানুষগুলো কোনো যুক্তিতে চার বছর মেয়াদী দীর্ঘ কোর্সে ভর্তি হবে? মন্ত্রণালয় পলিটেকনিকের কিছু আসন খালি থাকার কথা বলছেন। পলিটেকনিকসমূহে কিছু ইমার্জিন টেকনোলজি নামের কিছু টেকনোলজি চালু করা হয়েছে সেসব অনেক টেকনোলজির সরকারি/বেসরকারি কোনো পদ সৃষ্টি হয়নি। যেমন: এনভায়রনমেন্ট টেকনোলজি থেকে একযুগেরও বেশি সময় আগে শিক্ষার্থীরা পাস করে বেরুলেও আজ পর্যন্ত কোনো নিয়োগে উক্ত টেকনোলজির কোনো পদ ছিল না। তাই সচরাচর এইসব টেকনোলজিগুলোতে শিক্ষার্থী ভর্তি হতে অনীহা প্রকাশ করে আবার ভর্তি হলেও ভবিষ্যৎ চিন্তা করে সাধারণ শিক্ষায় চলে যায়। এইসব টেকনোলজিগুলো চালু করার পূর্বে সংশ্লিষ্ট মহলের কর্মসংস্থানের সম্ভাব্যতা যাচাই-বাছাই করা উচিত ছিল। গুটিকয়েক টেকনোলজির জন্য পুরো শিক্ষা কার্যক্রমকে মানহীন করে ফেলা একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।
আমাদের শিক্ষামন্ত্রী একজন চিকিৎসক। তাই চিকিৎসা বিজ্ঞানের একটা উদাহরণ দেয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। চিকিৎসা শাস্ত্রে পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট কিংবা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি চিকিৎসকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি ডিগ্রি। প্রায় প্রতিজন চিকিৎসকের স্বপ্ন থাকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করা। তীব্র প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এই কোর্সে চিকিৎসকদের ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করতে হয়ে। তীব্র প্রতিযোগিতার মাঝেও কয়েকটি বিভাগে কাম্য সংখ্যক শিক্ষার্থী কিংবা চিকিৎসক পাওয়া যায় না। এরকম একটা বিভাগ হলো ফরেনসিক বিভাগ। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আ ম সেলিম রেজা গত ডিসেম্বরে একটি জনপ্রিয় নিউজ পোর্টালে সাক্ষাৎকারে বলেন, উনার বিভাগে অর্ধেকেরও বেশি শিক্ষক ও চিকিৎসকের পদ শূন্য। উক্ত পদগুলোতে স্নাতকোত্তর চিকিৎসক পাওয়া যাচ্ছে না।কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন উক্ত বিষয়ে প্রাইভেট প্রাকটিস করার সুযোগ না থাকায় চিকিৎসকরা উক্ত বিষয়ে পড়াশোনা করতে অনীহা প্রকাশ করেন। তিনি আরও উল্লেখ করেন, দেশের চারটি বড় মেডিকেলে তিনিই একমাত্র অধ্যাপক। বিশেষ কারণে গুটিকয়েক বিভাগে চিকিৎসা শাস্ত্রে স্নাতকোত্তর কোর্সে কাম্যসংখ্যক শিক্ষার্থী পাওয়া না যাওয়া মানে উক্ত কোর্সকে মানহীন করে যেনতেন কোর্সে পরিণত করা নয়।
দেশের পলিটেকনিক শিক্ষাঙ্গনকে অশান্ত না করে ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের পলিটেকনিক ভর্তিনীতি বহাল রেখে নিয়মিত মেধাবী শিক্ষার্থীদের ভর্তির অগ্রাধিকার দিয়ে দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখতে হবে।
লেখক : ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক, চট্টগ্রাম জেলা নির্বাহী কমিটি, ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনির্য়াস, বাংলাদেশ।
[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন।]