এশিয়ার মধ্যে দ্রুত উন্নতি করা সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার উন্নয়নের প্রধান কারণ হিসেবে ধরা হয় কারিগরি শিক্ষার উন্নয়ন। সিঙ্গাপুরে এই শিক্ষার হার ৬৫ শতাংশ আর মালয়েশিয়ায় ৪০ শতাংশ। বাংলাদেশে এই শিক্ষার হার সরকার ১৪ শতাংশ দাবি করলেও বাস্তবে তা আরো কম। যদিও সরকার ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে কারিগরিতে ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী করার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু সেই ঘোষণা অনুযায়ী কাজের অগ্রগতি অল্প। রোববার (৬ অক্টোবর) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন শরীফুল আলম সুমন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, পদ্ধতিগত কারণেই বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা কারিগরি শিক্ষাবিমুখ। অন্য দেশে একজন শিক্ষার্থীর প্রতিষ্ঠানই নির্ধারণ করে দেয় সে কারিগরি শিক্ষায় যাবে কি না। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ভিন্ন রকম। কারিগরি শিক্ষার সুযোগ খুবই কম। একজন শিক্ষার্থীর ইচ্ছা থাকলেও সে অনেক সময় কারিগরিতে যেতে পারে না। আর যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেগুলোতে প্রকৃত কারিগরি শিক্ষার সুযোগ কম। ফলে দক্ষতা ছাড়া কারিগরি শিক্ষা শেষ করে শিক্ষার্থীরা ভালো চাকরির সুযোগ পায় না। এ ছাড়া কারিগরি শিক্ষায় ইংরেজিতে খুব একটা জোর দেয়া হয় না। ফলে কারিগরি শিক্ষা শেষ করে অনেকে ভাষাগত কারণে ভালো চাকরি পান না।
এ ছাড়া আমাদের দেশের মানুষের চিন্তাভাবনাও অনেকটা সেকেলে। বেশির ভাগ মানুষ মনে করে দরিদ্র অথবা মেধায় পিছিয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের জন্যই কারিগরি শিক্ষা। আর এই খাতে মেধাবী লোকের বড় অভাব। কারিগরি শিক্ষায় সরকারের বিনিয়োগও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
ব্রিটেনের কারিকুলাম ঘেঁটে জানা যায়, তাদের শিক্ষাপদ্ধতিই ঠিক করে দেয় একজন শিক্ষার্থীর গতিপথ। সব শিক্ষার্থীর জন্য অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত একই শিক্ষাব্যবস্থা থাকলেও নবম শ্রেণি থেকে মেধা অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের দুই ভাগে ভাগ করা হয়। অর্থাৎএকই ক্লাসে পড়লেও দুই ধরনের শিক্ষার্থীদের জন্য দুই ধরনের প্রশ্ন হবে। একটি গ্রুপ থাকে ‘উচ্চতর গ্রুপ’ যারা ভবিষ্যতে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে। আরেকটি গ্রুপ হচ্ছে ‘ফাউন্ডেশন গ্রুপ’ যাদের আর উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ নেই। ‘জিসিএসই’ বা ‘ও লেভেল’ শেষ করার পর তাদের কারিগরি অথবা ভোকেশনাল শিক্ষায় যেতে হবে। ‘ফাউন্ডেশন গ্রুপে’র শিক্ষার্থীরা ‘এ লেভেলে’ ভর্তি হতে পারবে না। অন্যদিকে ‘উচ্চতর গ্রুপে’র শিক্ষার্থীরা ‘এ লেভেল’ শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে। আবার তারা ইচ্ছা করলে কারিগরি শিক্ষায়ও যেতে পারবে।
ব্রিটেনের ইস্ট বুরি কমপ্রিহেনসিপ হাই স্কুলের অ্যাসিস্ট্যান্ট সায়েন্স টিচার দীন মোহাম্মদ মহসীন বলেন, ‘ব্রিটেনের শিক্ষাব্যবস্থাই শিক্ষার্থীদের মেধা ক্রমানুসারে তাদের স্ব-স্ব গন্তব্যে নিয়ে যায়। একজন শিক্ষার্থী শিক্ষাব্যবস্থা থেকেই দিকনির্দেশনা পায় সে সাধারণ শিক্ষায় থাকবে নাকি কারিগরি শিক্ষায় যাবে।’
২০১০ খ্রিষ্টাব্দে প্রণীত বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষানীতিতেও কারিগরি শিক্ষাকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত হবে প্রাথমিক শিক্ষা। প্রাথমিক স্তর শেষ করার পর একজন শিক্ষার্থীর কারিগরি শিক্ষায় যাওয়ার সুযোগ থাকতে হবে। এতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত হবে ১:১২। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়াতে হবে এবং দক্ষতা অর্জনে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। তবে এসবের বেশির ভাগই এখনো কাগজে-কলমে বন্দি।
অবশ্য কারিগরি শিক্ষার উন্নয়নে সরকার কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। প্রতিটি উপজেলায় একটি করে সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ১০০ উপজেলায় প্রতিষ্ঠান স্থাপনে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। ২৩টি সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার প্রকল্পও পাস হয়েছে। নির্বাচিত ৬৪০টি সাধারণ প্রতিষ্ঠানে ভোকেশনাল ট্রেড খোলার পরিকল্পনাও হাতে নিয়েছে সরকার।
শিক্ষাবিদ ও গবেষক অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘কারিগরি কাজকে আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ সম্মানজনক মনে করেন না। উৎপাদনের সঙ্গে জড়িতরা অবহেলার স্বীকার। এই সামাজিক অস্বীকৃতি কারিগরি শিক্ষা না এগুনোর অন্যতম কারণ। এ ছাড়া আমাদের শিল্প খাতও তেমনভাবে বিকশিত হয়নি। এত দিন এই খাতে সরকারের নজরও খুব একটা ছিল না। এখন আমাদের সচেতন হতে হবে। প্রয়োজনীয় কারিগরি স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বিশেষ করে এই খাতে বড় বড় উদ্ভাবক, গবেষকদের আনতে হবে। যাতে তারা পরিকল্পনা করে এই খাতকে এগিয়ে নিতে পারেন।’
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, ‘বাংলাদেশ যদি সত্যি সত্যি উন্নত দেশের কাতারে যেতে চায় তাহলে অবশ্যই কারিগরি শিক্ষায় জোর দিতে হবে। আমরা কথায় কথায় চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কথা বলছি, তা কারিগরি শিক্ষার ওপর ভর করেই আসবে। আর এখন যেসব চাকরি আছে, ১০ বছর পর হয়তো তা থাকবে না। ফলে আগামীর কথা চিন্তা করে বিষয় নির্ধারণ করতে হবে। কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাড়াতে হবে।’
বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর আবুল কাশেম বলেন, ‘কারিগরি শিক্ষায় পর্যাপ্ত দক্ষ শিক্ষকের প্রচণ্ড সংকট। এমনকি পর্যাপ্ত টেকনিক্যাল স্টাফও নেই। ল্যাবরেটরিগুলোর আধুনিকায়ন করতে হবে এবং সেগুলো পরিচালনায় দক্ষ জনবল থাকতে হবে। এ ছাড়া কারিগরি শিক্ষার উচ্চ পদগুলো এই খাতের জনবল দিয়েই পূরণ করতে হবে। সরকারের আন্তরিকতার অভাব নেই। এখন প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা ও এর বাস্তবায়ন করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।’