উপকূলীয় অঞ্চলে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধে করণীয় - দৈনিকশিক্ষা

উপকূলীয় অঞ্চলে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধে করণীয়

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

বিশ্বের সর্ববৃহৎ ব-দ্বীপ নদীমাতৃক বাংলাদেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের অবস্থান এবং সাগরের তীরে অবস্থিত এ দেশের ১৯টি জেলার শতাধিক উপজেলা উপকূলীয় অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃত। এসব অঞ্চলের বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে এখানকার জনগণের জীবনযাত্রাও বৈচিত্র্যময় এবং সংগ্রামমুখর। তাদেরকে কখনও যুদ্ধ করতে হয় প্রকৃতির সঙ্গে, আবার কখনও যুদ্ধ করতে হয় অর্থনীতির সঙ্গে। তাই এ অঞ্চলে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণেই বেশি। মঙ্গলবার (১৪ জানুয়ারি) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক সম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়। 

সম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, যেহেতু উপকূলীয় অঞ্চলের সামগ্রিক উন্নতি ও অগ্রগতির পেছনে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলো শিক্ষা; আর প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে শিক্ষার মূল ভিত্তি। তাই প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে এ অঞ্চলে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধকল্পে বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।

জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট-২০৩০ (Sustainable Development Goals-2030) -এর অভীষ্টে চার নম্বর ও টেকসই সর্বজনীন শিক্ষার পাশাপাশি অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা নিশ্চিতকরণে জোর দেওয়া হয়েছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা বলতে একটি দেশের সব প্রান্তের সব স্তরের ছাত্রছাত্রীকে শিক্ষাব্যবস্থার আওতায় আনা ও উপযুক্ত শিক্ষাদানকে বোঝায়। বাংলাদেশের সুবিস্তীর্ণ উপকূলীয় অঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য মানসম্মত শিক্ষাদানে একদিকে যেমন শতভাগ শিশুকে স্কুলে ভর্তি নিশ্চিত করতে হবে, একই সঙ্গে শিক্ষার্থীরা যেন কোনো অবস্থাতেই ঝরে না পড়ে সে বিষয়েও যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। এ জন্য প্রথমেই প্রয়োজন এ অঞ্চলে ড্রপ আউটের প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করে সে অনুযায়ী Need Based Assessment-এর ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

উপকূলীয় অঞ্চলে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার প্রধান কারণ অর্থনৈতিক সমস্যা। এ ছাড়া পূর্বপুরুষের দীর্ঘদিনের পেশা ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা গ্রহণের স্বাভাবিক আগ্রহকে অনেক সময় বিনষ্ট করে দিচ্ছে। পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এখানকার মানুষের প্রধান পেশা কৃষি, মাছ ও কাঁকড়া ধরা। দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করে এরা কালাতিপাত করে। যখন একটি পরিবারকে তিন বেলা তিন মুঠো ভাতের নিশ্চয়তা না দেওয়া যায়, তখন তারা বাচ্চাদের নিয়মিত স্কুলিং নিশ্চিত করতে পারে না। আর বাচ্চারাও জীবিকা নির্বাহের তাগিদে অভিভাবকের সঙ্গে কাজে বেরিয়ে পড়ে। ফলে ব্যাহত হয় শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ।

বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ। দুর্যোগগুলোর মধ্যে আছে পুনরাবর্তক ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন; সিডর, আইলা, ফণী ও বুলবুলের মতো বিবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এসব দুর্যোগের ফলে অনেক পরিবারই ছিন্নমূল পরিবারে পরিণত হয়। এতে তারা অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের মৌলিক চাহিদা পূরণের সংগ্রামে লিপ্ত হয়। এর ফলে সন্তানদের উপযুক্ত শিক্ষার পরিবেশ ব্যাহত হয়। সুপেয় পানির অপর্যাপ্ততা এ অঞ্চলের জনগণের অন্যতম দুর্ভোগের কারণ। যখন ৭ থেকে ১০ বছর বয়সী একটি শিশুর পড়ার টেবিলে থাকার কথা, তখন তাকে কলস বা পানির পাত্র হাতে নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয় পার্শ্ববর্তী পাড়া-মহল্লার পুকুর বা কূপ থেকে পানীয় জল সংগ্রহের জন্য। নদীভাঙনের কারণে অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর পরিবারগুলো অনেক সময় বাপ-দাদার সূত্রে প্রাপ্ত ভিটেবাড়ি ছেড়ে জীবিকার তাগিদে শহরে স্থানান্তরিত হয়। ফলে তাদের কোমলমতি সন্তানদের শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ বিনষ্ট হয়। তারা কিছু টাকার মোহে কর্মে নিযুক্ত হয়। এতে শিক্ষাজীবন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

যাতায়াত ব্যবস্থা ও অবকাঠামোগত প্রতিকূলতার কারণে অনেক শিক্ষার্থী স্কুলে গেলেও শেষ পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করতে পারে না। সমতল ভূমিতে একজন শিক্ষার্থী যেখানে হেঁটে বা বাইসাইকেল বা ভ্যানে স্কুলে যেতে পারে; উপকূলীয় এলাকার একজন শিক্ষার্থীকে কাঁচা বা ইটের রাস্তায় হেঁটে গিয়ে ঝপঝপিয়া, চুনকুড়ি, শিবসার মতো বড় নদী খেয়ায় পার হয়ে স্কুলে যেতে হয়। এ ব্যবস্থা শিক্ষার্থীর কোমল মন ও শরীরের জন্য যেমন কষ্টসাধ্য, তেমন ঝুঁকিপূর্ণ। এ জন্য অনেক সময় মা-বাবা তাদেরকে স্কুলে যেতে নিরুৎসাহিত করে, যা প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে ঝরে পড়ার অন্যতম কারণ। অর্থাৎ নিরবচ্ছিন্ন যাতায়াতের ক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতা প্রাথমিক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ায় ভূমিকা রাখে।

ঝরে পড়া রোধকল্পে উপকূলীয় উপজেলাগুলোতে মাসে একবার রুটিনমাফিক ছাত্রছাত্রীসহ শিক্ষার্থীদের মা-বাবা, সরকারি কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াকর্মীর সমন্বয়ে সামাজিক উদ্বুদ্ধকরণ সভার আয়োজন করতে হবে। এ সভার মাধ্যমে অভিভাবকদের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে যেন তারা সব অবস্থায় সন্তানদের স্কুলে পাঠায়। এলাকাভিত্তিক স্কুলবান্ধব যানবাহন ও নিরবচ্ছিন্ন যাতায়াত ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারলে শিক্ষার্থীরা নিয়মিত স্কুলে যাবে বলে আশা করা যায়। এ জন্য সরকারি-বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে স্কুলভ্যান ও খেয়া পারাপারে ইঞ্জিন-নৌকার সংখ্যা বাড়াতে হবে।

যেহেতু দারিদ্র্য এ অঞ্চলের প্রধান সমস্যা, সে জন্য উপকূলীয় অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের বিশেষ উপবৃত্তি ও মেধাবীদের জন্য স্বতন্ত্র শিক্ষাবৃত্তির ব্যবস্থা করা যেতে পারে, যাতে তারা শিশুশ্রমে লিপ্ত না হয় এবং পড়াশোনার প্রতি উৎসাহিত হয়। 'মিড ডে মিল' শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়মুখী করার অন্যতম কার্যকরী ব্যবস্থা। এ জন্য উপকূলীয় শিক্ষার্থীদের শতভাগ 'মিড ডে মিল' নেটওয়ার্কের আওতায় আনতে হবে। ছাত্রছাত্রীদের মাঝে স্কুল ড্রেস ও শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করা হলে তারা নিয়মিত স্কুলে যেতে আগ্রহী হবে।

উপকূলীয় অঞ্চলের শিক্ষকদের বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদান করা যেতে পারে, যেন তারা উদ্ভাবনী ও চিত্তাকর্ষক উপায়ে বাচ্চাদের পড়াশোনার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে সক্ষম হন। উপকূলীয় অঞ্চলের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ। এর মাধ্যমে উপকূলীয় দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস ও তৎপ্রেক্ষিতে দারিদ্র্য বিমোচনে দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হবে, যা শিশুদের স্কুলমুখী করা ও ঝরে পড়া রোধে পরোক্ষভাবে অত্যন্ত ফলদায়ক ভূমিকা পালন করবে।

একটি জাতির সামগ্রিক উন্নয়নের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার মানসম্মত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ। এ ক্ষেত্রে উপকূলীয় অঞ্চলের বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে এ অঞ্চলের জন্য আলাদাভাবে বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে, যেন শতভাগ শিশুর স্কুলমুখী হওয়ার পাশাপাশি তাদের ড্রপ আউটের হার উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পায়। কেননা, টেকসই শিক্ষাব্যবস্থার জন্য এ দুটি বিষয়ের যুগপৎ সমন্বয় ঘটানো অত্যাবশ্যক। আর টেকসই শিক্ষাব্যবস্থার ভিতের ওপরেই গড়ে উঠবে আগামী দিনের সুখী, সমৃদ্ধ, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের 'সোনার বাংলা'।

লেখক: মোহাম্মদ হেলাল হোসেন

এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ - dainik shiksha এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ - dainik shiksha পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী - dainik shiksha ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ - dainik shiksha প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0072150230407715