পরীক্ষা, খেলাধুলা, নাচ-গান, বিতর্ক, কুইজ- এককথায় আমরা সহ-পাঠ্যক্রমিক অনেক ধরনের কার্যক্রম বিদ্যালয়গুলোতে অত্যন্ত প্রফুল্লচিত্তে করিয়ে থাকি।
আবার এসব বিষয়ে প্রতিযোগিতারও আয়োজন করি। প্রতিযোগিতার উদ্দেশ্য হল শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব গড়ে তোলা। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থায় প্রতিযোগিতা প্রধান উপাদান হিসেবে কাজ করে।
বিশ্বের দরবারে বা আমাদের জাতীয় শিক্ষা পদ্ধতিতে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে নিজেকে তুলে ধরার প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব সৃষ্টি করা হয়। এক্ষেত্রে বৃত্তি প্রদান অন্যতম মানদণ্ডস্বরূপ। তবে উপবৃত্তি কী?
উপবৃত্তি হল মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য সরকার কর্তৃক প্রদানকৃত একটি প্রকল্প। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর এক বিশাল অংশ বা অর্ধেক অংশই হচ্ছে নারী। তাদের মধ্যে আবার বিশাল একটি অংশ দারিদ্র্য, বাল্যবিবাহ, আর্থ-সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ইত্যাদি কারণে শিক্ষালাভ থেকে বঞ্চিত ছিল বিধায় দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে তাদের যথাযথ অংশগ্রহণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে সরকার নারী শিক্ষাকে উৎসাহিত করার উপায় হিসেবে বেসরকারিভাবে ১৯৮২ সালে পরীক্ষামূলকভাবে ছাত্রী উপবৃত্তি প্রকল্প চালু করে, বর্তমানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্নাতক পর্যন্ত যার ৫টি প্রকল্প চালু রাখা হয়েছে। এক্ষেত্রে মেয়ে ও ছেলেদের মাধ্যমিক পর্যায়ে ভর্তির অনুপাত দাঁড়িয়েছে ৫৩ঃ ৪৭।
এই উপবৃত্তি একসময় সব মেয়ে শিক্ষার্থী পেত। কিন্তু পরবর্তীকালে তা ছেলেদের মাঝেও বিতরণের ব্যবস্থা করা হয়। এখন এ উপবৃত্তি মেয়েদের দেয়া হচ্ছে ৩০ শতাংশ এবং ছেলেদের ১০ শতাংশ।
প্রশ্ন হল, উপবৃত্তিপ্রাপ্তির জন্য যে শর্তগুলো দেয়া হয়েছে তা কি আদৌ ‘বৃত্তি’ শব্দটির কাছাকাছি অর্থ বহন করে? বৃত্তির একটাই শর্ত- সবচেয়ে ভালো ফলাফল অর্জনকারী শিক্ষার্থীরাই বৃত্তি পাওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হবে।
পক্ষান্তরে উপবৃত্তিপ্রাপ্তির জন্য যেসব শর্ত চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে তার সঙ্গে বৃত্তির কোনো মিল নেই। যদিও একটা শর্তে উল্লেখ রয়েছে ‘মেধাবী’ কথাটির, কিন্তু আবার একই ফরমে লেখা রয়েছে, শিক্ষার্থীকে ৩৩ শতাংশ নম্বর পেতে হবে। তাহলে যে শিক্ষার্থী ৩৩ শতাংশ নম্বর পাবে তাকেও কি আমরা মেধাবী বলে ধরে নেব?
এসব শর্ত উপবৃত্তির ক্ষেত্রে জুড়ে দেয়াটা আদৌ সমীচীন কিনা তা ভেবে দেখার বিষয়। শর্ত জুড়েই যদি পড়ালেখায় বা শিক্ষায় অগ্রগতি আনতে হয়, তবে কি সেই শিক্ষার মানোন্নয়ন আমরা আশা করতে পারি? ‘
উপবৃত্তি’ শব্দটির উপ একটি উপসর্গ, যা মূল শব্দে বৃত্তি শব্দটির আগে বসেছে। উপ উপসর্গটি সাধারণত মূল শব্দের আগে বসে সমীপে বা সামীপ্য অর্থ প্রকাশ করে।
তাহলে এখানে বৃত্তির সঙ্গে উপবৃত্তির সামীপ্যটা কোথায়? এ উপবৃত্তিটা যদি এভাবে না দিয়ে প্রতিটি বিদ্যালয়ে গরিবদের জন্য আর্থিক সুবিধা বা গরিব, এতিম, অনাথ ছেলেমেয়েদের জন্য সুনির্দিষ্ট করে দেয়া হতো তাহলে হয়তো শিক্ষার হার বাড়ত, তবে মানোন্নয়ন নয়।
তাই ‘উপবৃত্তি’র নাম পরিবর্তন করার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতি বিনীত সুপারিশ করছি। নামকরণটা যদি সাহায্য বা সহযোগিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে তাহলে হয়তো শিক্ষকরা, বিশেষ করে প্রধান শিক্ষকরা রাজনৈতিক চাপ, ম্যানেজিং কমিটির চাপ, সমাজের বিত্তবানদের চাপ থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি পেতেন। সেই সঙ্গে মেধাবীদের জন্য যে বৃত্তি প্রদান করা হয়, তার সংখ্যাটাও বাড়ানো যেতে পারে। এতে আর্থিক সহযোগিতা ও প্রতিযোগিতা বাড়বে এবং শিক্ষার মানোন্নয়নও হবে।
আনোয়ারা নীনা : প্রধান শিক্ষক, হালিমুন্নেছা চৌধুরাণী মেমোরিয়াল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, ভালুকা, ময়মনসিংহ।
সৌজন্যে: যুগান্তর