সম্প্রতি বাংলাদেশের জাতীয় পত্রিকাগুলোতে বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতি নিয়োগকৃত ‘উপাচার্য’, ‘উপউপাচার্য’ ও ‘কোষাধ্যক্ষ’ কর্তৃক পরিচালিত না হওয়ার বিষয়টি বেশ প্রাধান্য পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক হিসেবে সম্পৃক্ত হওয়ার পর থেকেই দেখে আসছি বেশির ভাগ সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন উপাচার্য তাঁর মেয়াদ শেষ করলেও নতুন উপাচার্য নিয়োগ পেতে বেশ কিছু মাস অপেক্ষা করতে হয়। উপাচার্যহীন একটি বিশ্ববিদ্যালয় মাঝিবিহীন একটি নৌকার মতো, যার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক-প্রশাসনিক সার্বিক পরিবেশসহ হাজার হাজার শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর দৈনন্দিন জীবন। একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে দাঁড়িয়ে বিষয়টি বড়ই বেমানান। উপাচার্য না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা দেখা দেয়, যা উচ্চশিক্ষার উন্নয়নের অন্যতম অন্তরায়। শনিবার (২৮ ডিসেম্বর) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধে আরও জানা যায়-
দুই.
আচার্যের অনুমোদনক্রমে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বনির্ধারিত সমাবর্তন অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করার কথা থাকলেও মহামান্য রাষ্ট্রপতি নিয়োগকৃত ‘উপাচার্য’, ‘উপউপাচার্য’ ও ‘কোষাধ্যক্ষ’ কর্তৃক পরিচালিত না হওয়ায় অনুষ্ঠানে উপস্থিতির বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী অপারগতা প্রকাশ করে প্রশংসার যোগ্য কাজ করেছেন। এভাবে কি কোনো বিশ্ববিদ্যালয় চলতে পারে? পত্রিকায় প্রকাশ, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সর্বশেষ তথ্য মতে, বর্তমানে একাডেমিক কার্যক্রম চলছে এমন ১০৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৮টিতে (২৬.৬৭ শতাংশ) উপাচার্য নেই, ৮২টিতে (৭৮.০৯ শতাংশ) উপউপাচার্য নেই এবং ৫৫টিতে (৫২.৩৮ শতাংশ) কোষাধ্যক্ষ নেই। আর উপাচার্য, উপউপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ কেউ নেই এমন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ২০ (১৯.০৫ শতাংশ)। তিনটি পদ পূর্ণ আছে এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা মাত্র ১০ (০৯.৫২ শতাংশ)। (কালের কণ্ঠ, ৫ ডিসেম্বর, ২০১৯)। অথচ প্রচলিত আইন হলো, যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগকৃত উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ পদে জনবল সার্বক্ষণিক থাকা অপরিহার্য।
তিন.
অন্যদিকে এটি ভালো যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি অনেক দিন ধরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শৃঙ্খলিত নিয়মের মধ্যে আনার চেষ্টা করছে। তবে দুঃখজনক বিষয় হলো, ‘বোর্ড অব ট্রাস্টিজ’ বা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার সঙ্গে সংযুক্ত ব্যক্তিরা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় কাঙ্ক্ষিত ও ইতিবাচক কিছু করা যাচ্ছে না। প্রায় প্রতিবছর ইউজিসি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বেসরকারি কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যাপারে ভর্তীচ্ছু শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের সতর্কতা জারি করে থাকে। এতে একদিকে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি ইউজিসির দৈন্যও প্রকাশ পায় এই অর্থে যে তারা এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক কোনো কিছু করতে পারছে না। আদালতে রিট করে হোক, আর যেভাবেই হোক ওই সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ঠিকই শিক্ষার্থী ভর্তি করে একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। আর প্রয়োজন যেহেতু কোনো আইন মানে না, তাই কিছু শিক্ষার্থী যেকোনো কারণেই হোক ভর্তি হয়ে থাকেন। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক ও প্রশাসনিকভাবে প্রতিষ্ঠিত নিয়ম হলো, মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগ দেওয়া উপাচার্য ব্যতীত শিক্ষার্থীদের সনদপত্রে অন্য কেউ স্বাক্ষর করতে পারেন না। তাঁর স্পষ্ট অর্থ হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বোর্ড অব ট্রাস্টিজ’ কর্তৃক নিয়োগ দেওয়া ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যের স্বাক্ষর করা সনদপত্র বৈধ নয়। এখন প্রশ্ন হলো, ‘উপাচার্য’, ‘উপউপাচার্য’ ও ‘কোষাধ্যক্ষ’ পদে ‘ভারপ্রাপ্ত’ হিসেবে কাউকে নিয়োগ দেওয়ার এখতিয়ার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট বা রিজেন্ট বোর্ডের না থাকলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সেই এখতিয়ার আছে কি? অথচ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সুবিধা হলো, ‘উপাচার্য’, ‘উপউপাচার্য’ ও ‘কোষাধ্যক্ষ’ প্রতিটি পদে নিয়োগের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বোর্ড অব ট্রাস্টিজ’ কর্তৃক প্রস্তাবিত তিনজনের নাম থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ও মহামান্য রাষ্ট্রপতি একজনকে পরবর্তী চার বছরের জন্য নিয়োগ দেন। পছন্দমতো কাউকে নিয়োগ প্রদানে সুবিধা বেশি থাকায় এ নিয়মটি পরিপূর্ণভাবে তাঁদের অনুসরণ করা উচিত। আর তাই এটি ধ্রুব সত্য যে প্রচলিত আইন পরিবর্তন না করলে ইউজিসি ইতিবাচক কিছু করতে পারবে না। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ মানুষের মৌল মানবিক অধিকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত কোনো বিষয় নিয়ে ‘যেমন খুশি, তেমন সাজো’ ধরনের কোনো ব্যবস্থা যেন গড়ে উঠতে না পারে, রাষ্ট্রকে তার দায় নিতে হবে এবং যথাযথ উপায়ে তা নিয়ন্ত্রণও করতে হবে। কেননা একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ উপযোগী দেশপ্রেমিক দক্ষ জনবল তৈরি করতে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি রাষ্ট্রের দায়ভারও কম নয়।
চার.
গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) উপাচার্য গত ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ পদত্যাগ করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যৈষ্ঠতম অধ্যাপককে উপাচার্যের চলতি দায়িত্বে নিয়োগদানে সহযোগিতা করে মন্ত্রণালয় নিঃসন্দেহে বাস্তবসম্মত কাজ করেছে। যিনি ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল বিষয় ‘ভর্তি পরীক্ষা’ সুন্দরভাবে সম্পন্ন করেছেন এবং প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত থাকার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার অনেক কিছু তিনি ভালো বোঝেনও বটে। ভাগ্য ভালো যে বশেমুরবিপ্রবিকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দীর্ঘদিন (প্রায় পাঁচ মাস) উপাচার্যশূন্য থাকতে হয়নি। কেননা দেশের উচ্চশিক্ষার কল্যাণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একটি দিনও উপাচার্যহীন থাকা কাম্য নয়। ইউজিসির তথ্য মতে, দেশের ৪৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটিতে (০২.২২ শতাংশ) উপাচার্য নেই; উপউপাচার্য নেই ২৯টিতে (৬৪.৪৪ শতাংশ) এবং কোষাধ্যক্ষ নেই ২৮টিতে (৬২.২২ শতাংশ)। (সমকাল, ০৪ নভেম্বর, ২০১৯)। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেবর তুলনামূলক বড় না হলে সেখানে ‘উপউপাচার্য’ না থাকাটা দোষের কিছু নয়; বরং ‘উপউপাচার্য’ থাকলে উপাচার্য ও উপউপাচার্যের ক্ষমতার অন্তর্দ্বন্দ্ব, পারস্পরিক রেষারেষি, দলীয় কোন্দল প্রভৃতি বৃদ্ধি পাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থেকে যায়। তবে অত্যন্ত দুঃখের এবং অপ্রত্যাশিত বিষয় হলো, ‘উপাচার্য’ ও ‘কোষাধ্যক্ষ’ এই দুই পদ শূন্য থাকা। একটু দেরিতে হলেও ‘উপাচার্য’ পদে হয়তো কেউ নিয়োগ পান, তবে ‘কোষাধ্যক্ষ’ পদ দীর্ঘদিন শূন্য থাকাটা অযৌক্তিক, যা কোনোভাবেই বাস্তবসম্মত নয়। প্রশাসনিক ও একাডেমিক সব দায়িত্বের পাশাপাশি কোষাগারের অতিরিক্ত দায়িত্ব থাকলে একজন উপাচার্যের জন্য যেমন তা বাড়তি চাপের সৃষ্টি করে, তেমনি পরোক্ষভাবে হলেও উপাচার্যকে ‘একনায়কতান্ত্রিক’ মনোভাবাপন্ন করে তুলতে পারে। শত শত কোটি টাকার আয়-ব্যয় ও কোষাগার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকার কর্তৃক নিয়োগকৃত একজন ‘কোষাধ্যক্ষ’ থাকাটা শুধু যৌক্তিকই নয়; বরং তা অধিক বাস্তব ও বিজ্ঞানসম্মত এবং অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
বাংলাদেশের তুলনামূলক পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শত শত অধ্যাপক আছেন, যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার যোগ্যতা রাখেন। রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততার গভীরতার ওপর যদিও নির্ভর করে সব কিছু। তবে সার্চ কমিটি করে হোক আর অন্য যেভাবেই হোক অতিদ্রুত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শূন্য পদগুলো পূরণ করা জরুরি। পাশাপাশি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে যেন ‘কোষাধ্যক্ষ’ পদটি পূরণ করা হয়, সে ব্যবস্থা নিশ্চয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় নেবে; যদিও ইতিমধ্যে ইউজিসি শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে শূন্য পদগুলো পূরণ করার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ করেছে। তবে একসঙ্গে প্রায় দেড় শ থেকে দুই শ ‘একাডেমিক এক্সিলেন্স’ ও প্রথিতযশা গবেষকমনস্ক অধ্যাপক পাওয়া কঠিন হলেও অসম্ভব কিছু নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো শূন্য থাকলে হতাশার পাশাপাশি একাডেমিক ও প্রশাসনিক কাজে যে প্রভাব ও ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি হয়, তা উচ্চশিক্ষার জন্য মোটেও কল্যাণকর নয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মান, পারদর্শিতা ও দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন; একাডেমিক ও গবেষণার ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রয়েছে—এমন অনেক সাবেক উপাচার্য, প্রথিতযশা অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, বর্তমানে দায়িত্বরত উপউপাচার্য রয়েছেন, যাঁদের বেসরকারি ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চশিক্ষা ও রাষ্ট্রের উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। একজন উপউপাচার্যকে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয়বার একই পদে নিয়োগ দেওয়ার অর্থ হলো, তিনি তাঁর আগের মেয়াদে সফল হয়েছেন। তাহলে তাঁকে দ্বিতীয়বার উপাচার্য পদে কেন নয়? এই খুঁটিনাটি বিষয়গুলোও সরকার ভেবে দেখবে বলে বিশ্বাস করতে চাই। মেধা সৃষ্টিতে মেধাকে কাজে লাগানো জরুরি।
মোহাম্মাদ আনিসুর রহমান : পিএইচডি গবেষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও বৈশ্বিক সুশাসন, ঝেজিয়াং ইউনিভার্সিটি, চীন এবং শিক্ষক ও সাবেক চেয়ারম্যান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, বশেমুরবিপ্রবি, গোপালগঞ্জ।