এই শিক্ষাই কি আমরা চেয়েছিলাম? - দৈনিকশিক্ষা

এই শিক্ষাই কি আমরা চেয়েছিলাম?

মো. মাসুদ রানা |

বেশ কিছু দিন আগে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্স অনুষদের বড় ভাইয়া-আপুরা ভারতের রাজীব গান্ধী ইনস্টিটিউট অফ ভেটেরিনারি অ্যাডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ থেকে ১৫ দিনের এক্সটার্নশিপ প্রোগ্রাম করে দেশে ফিরেছে। আগামী বছর আমাকেও ঐ একই উদ্দেশ্যে ভারতের ঐ ইনস্টিটিউশনে যেতে হবে। তাই বড় ভাইদের রুমে গেলাম, তাদের অভিজ্ঞতা শুনতে। তারা যা বললো তাতে অবাক না হয়ে আর পারলাম না। তারা বলল, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা পঞ্চমবর্ষে এসেও যা শিখতে পারিনি ব্যবহারিক দিক দিয়ে, সেখানকার শিক্ষার্থীরা তা তৃতীয়বর্ষে শিখে ফেলে। আমরা পরীক্ষার খাতায়  রেশন (রেশন হচ্ছে প্রাণী ও পশুপাখির খাবারের মিশ্রণ যেখানে বিভিন্ন প্রকার খাদ্য উপাদান একটা নির্দিষ্ট পরিমাণে থাকে) কিভাবে তৈরি করে তা লিখছি মুখস্থ করে, কিন্তু ওরা তা প্র্যাক্টিক্যালি করেছে দ্বিতীয়বর্ষেই। তাতে যা বুঝলাম, ওরা আমাদের চেয়ে ব্যবহারিক জ্ঞানের দিক দিয়ে অনেক বেশি এগিয়ে, আর অন্যদিকে আমরা তত্ত্বীয় দিক থেকে এগিয়ে। কিন্তু ভেটেরিনারি পেশায় তত্ত্বীয় জ্ঞানের চেয়ে ব্যবহারিক জ্ঞান অনেক বেশি কাজে দেয়।’

উপরের কথাগুলো থেকে আমরা সহজেই বুঝতে পারি, বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা যারা টেকনিক্যাল সাবজেক্টে পড়াশোনা করছে তাদের ব্যবহারিক শিক্ষার  অভাব রয়েছে। এরা হয়ত এই অভাবটা পূরণ করে কর্মজীবনে। কিন্তু যারা সাধারণ বিষয়ে (যেমন :ইসলামের ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান প্রভৃতি) পড়াশোনা করছে তাদের চাকরির ক্ষেত্রটা কোথায় এ দেশে? তাদের বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানগুলো কর্মজীবনে কোথায় কাজে লাগে, তার উত্তরটা আজো বের করতে পারিনি আমি।

আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে যেসব স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী শিক্ষার্থী বের হচ্ছে তাদের অধিকাংশই অন্যান্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারীদের চেয়ে কর্মদক্ষতা কিংবা গুণগতমানের দিক থেকে নিম্নমানের। এর পেছনে বহুবিধ কারণ  রয়েছে। আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা শুধুমাত্র কেরানি তৈরি করার জন্য উপযুক্ত, দক্ষ কর্মী সৃষ্টি করার জন্য নয়।

চার বছরের স্নাতক জীবনে তারা যেসব বিষয় পাঠ করে সম্ভবত তাদের একটিও কাজে লাগে না কর্মজীবনে। ফলে কর্মজীবনে গিয়ে আবার নতুন করে শিখতে হয় তাদের। যে বিষয়ের সঙ্গে কর্মজীবনের কোনো সম্পর্ক নেই সে বিষয় পড়ে লাভটা কি? ফলস্বরূপ এদেশের কর্মজগতের অনেক বড় একটা অংশ দখল করে আছে বিদেশিরা। আমেরিকার গবেষণা সংস্থা পিউ রিচার্স সেন্টারের তথ্যানুযায়ী, বছরে সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকা নিয়ে যায় বিদেশিরা। সরকারি হিসেব মতে, বাংলাদেশে প্রায় ৮৫ হাজার বিদেশি নাগরিক কাজ করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই সংখ্যা ১০ লক্ষের মত (সূত্র :দৈনিক ইত্তেফাক, ১৮ই এপ্রিল, ২০১৮)। কিন্তু সরকারি হিসেবে এত কম হওয়ার কারণ কী? কারণ হচ্ছে, অনেকেই এই দেশে পর্যটক ভিসায় এসে কাজ করে থাকেন। আর তখন এরা সরকারি নথিভুক্ত হয় না। দেশের প্রচুরসংখ্যক বেকার যখন একটা চাকরি পাওয়ার জন্য হন্যে হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে তখন এদেশের বেসরকারি খাতে বিপুলসংখ্যক বিদেশি কাজ করছে এবং তাদের আয় অবৈধভাবে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর সর্বশেষ  হিসেব অনুযায়ী, এদেশে কর্মোপযোগী মানুষের সংখ্যা ১০ কোটি ৯১ লাখ। এদের মধ্যে কর্মে নিয়োজিত আছে ৬ কোটি ৮ লাখ মানুষ এবং বাকি ৪ কোটি ৮২ লাখ ৮০ হাজার মানুষ কর্মক্ষম কিন্তু শ্রমশক্তির বাহিরে রয়েছে। অর্থাত্ বাংলাদেশে বর্তমানে ৪ কোটি ৮২ লাখেরও বেশি মানুষ কর্মহীন রয়েছে।

বেসরকারি খাতে দেশের চাকরি প্রত্যাশীদের কেন নিয়োগ দেওয়া হয় না, তার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা এদেশের তরুণদের কর্মদক্ষতার অভাবকেই দায়ী করেছেন। তরুণদের এই কর্মদক্ষতাহীনতার জন্য দায়ী কি শুধুমাত্র তরুণরা? এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালগুলোর উপরও কিছুটা দায় বর্তায়।

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগে প্রকৃত মেধাবীদের জায়গা হয় না। শিক্ষক নিয়োগ শুধুমাত্র ভালো রেজাল্ট ও মৌখিক পরীক্ষার উপর ভিত্তি করে দেওয়া হলে উপযুক্তপ্রার্থী শিক্ষকতায় আসার সুযোগ পায় না। ভাইভা বোর্ডে প্রশ্ন কর্তারা ইচ্ছে করলেই যে কাউকে সহজ প্রশ্ন করে চাকরি পেতে সাহায্য করতে পারেন আবার যে কাউকে কঠিন প্রশ্ন করে কাবু করতে পারেন। আর তাছাড়া শিক্ষক নিয়োগে যেটা সবচেয়ে বেশি কাজে দেয় তা হলো প্রার্থীর রাজনৈতিক পরিচয়, মামা-খালু এবং টাকার তদবির। এভাবে যেসব শিক্ষক নিয়োগ পায় তারা পরে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে। সারাদিন উপর মহলের কাছে চাটুকারিতায় ব্যস্ত থাকেন তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা ভালো পদ পাওয়ার জন্য। তখন তাদের আর ক্লাস নেওয়ার সময় থাকে না।

আবার অনেক শিক্ষক আছে যারা ক্লাসে এসে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরে তৈরিকৃত লেকচার স্লাইড দেখে ক্লাস নেন এবং সর্বশেষ, বাপ-দাদার আমলে বানানো একটা দলীল (শিট) হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে যান। শিক্ষার্থীরা সেই শিট ফটোকপি করে অন্ধের মত মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় বমি করে দিয়ে আসে। ক্লাসের মধ্যে যে যত বেশি মুখস্থ বিদ্যায় পারদর্শী, সে ততবেশি সিজিপিএর অধিকারী। এভাবে চললে কি শিক্ষার্থীদের দক্ষতা কখনো বাড়বে?

দেশে এখন ৪০টা সরকারি ও ৯৭টা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশতেই শিক্ষার্থীর সংখ্যা এতই বেশি যে তাদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে দক্ষ শিক্ষক, ক্লাসরুম, ল্যাব ফ্যাসিলিটিস নেই। অন্যদিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যেসব সরকারি কলেজ রয়েছে তাদের শিক্ষার গুণগত অবস্থা পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়েও আরো করুণ। তাদের সারা বছরে সর্বোচ্চ দুই থেকে তিন মাস ক্লাস হয়ে থাকে। অনগ্রসর অঞ্চলের কলেজগুলোতে ভালো শিক্ষকের অভাব। নেই শেখার জন্য তেমন কোনো উপকরণ। এসব সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা কতটুকু ভালোভাবে শিখতে পারবে তা বুঝতে কাউকে রকেট সায়েন্টিস্ট হতে হবে না।

আমার মনে একটা প্রশ্ন জাগে, দেশের সবাইকেই কেন উচ্চশিক্ষিত হতে হবে? যেহেতু উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যেই বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি, ১৬.৪ শতাংশ (সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট রিচার্স এর মতে) সেহেতু উচ্চশিক্ষা নিয়ে কি লাভ? অনেকেই বলতে পারেন, লেখাপড়ার মূল উদ্দেশ্য তো চাকরি পাওয়া নয়, ভালো মানুষ হওয়া। কিন্তু কেউ মানুক আর না মানুক এটাই সত্যি যে,  বাংলাদেশে লেখাপড়া করার মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে ভালো একটা চাকরি পাওয়া, ভবিষ্যতে পরিবার-পরিজন নিয়ে সুখে থাকা। কিন্তু উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিরা যদি তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ না পায় তাহলে উচ্চশিক্ষার সার্টিফিকেট দিয়ে তারা কী করবে? তাদের পরিবারকে কিভাবে সুখ দিবে?

আমার মনে হয় বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনা দরকার। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত পড়াশোনার পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাধারণ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের প্রবেশ সীমিত করা উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে টেকনিক্যাল সাবজেক্টগুলো বেশি বেশি চালু করতে হবে। উচ্চ মাধ্যমিক পাসের পর সবাইকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না হয়ে ছয় মাস থেকে শুরু করে দুই তিন বছর মেয়াদী বিভিন্ন প্রফেশনাল কোর্স করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে হবে। শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়াতে প্রাথমিকভাবে অস্থায়ীভিত্তিতে শিক্ষকদেরকে নিয়োগ দিতে হবে। পরে ছয় মাস অথবা এক বছরে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত ঐ শিক্ষকের পড়ানোর দক্ষতা, ছাত্রদের বোঝানোর ক্ষমতা কি রকম এ সম্পর্কিত একটি আউটপুট অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হবে তিনি স্থায়ীভাবে নিয়োগ পাবেন কি না? বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে হবে, শেখার জন্য সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করে দিতে হবে। সরকারকে নতুন নতুন কর্মক্ষেত্রের সৃষ্টি করতে হবে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ আরো বাড়াতে হবে। তাহলে হয়ত আজকের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণ-তরুণীরা আগামীতে বেকার না থেকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে যাবে। দেশ এগিয়ে যাবে দ্রুতগতিতে, অর্জিত হবে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য ও সাফল্য।

লেখক : শিক্ষার্থী, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

 

সৌজন্যে: ইত্তেফাক
 

হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য - dainik shiksha হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক - dainik shiksha সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি - dainik shiksha ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার - dainik shiksha রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0037209987640381