এইচএসসিতে ইংরেজির ম্যাজিকটি কী? - দৈনিকশিক্ষা

এইচএসসিতে ইংরেজির ম্যাজিকটি কী?

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

২০১৯ সালের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে ১৭ জুলাই, মাত্র ৫৫ দিনের মধ্যে এবারই প্রথম এইচএসসির ফল প্রকাশিত হলো। এটি প্রশাসনিক দক্ষতার পরিচয় বহন করে ঠিকই; কিন্তু যে উদ্দেশ্যে এই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় সেটি ঠিকভাবে অর্জিত হচ্ছে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যাচ্ছে। সোমবার (২২ জুলাই) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধনটি লিখেছেন মাছুম বিল্লাহ।

কারণ তাড়াহুড়া করে পাবলিক পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা মানে প্রচুর ভুলত্রুটিকে আশ্রয় দেওয়া। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, একজন শিক্ষার্থীর সারা জীবনের বিচার করছেন একজন শিক্ষক। তিনি অভিজ্ঞ হোক, অনভিজ্ঞ হোক, নতুন হোক, পুরনো হোক, খাতা মূল্যায়ন করতে জানুক আর না জানুক।

তাঁর কয়েক মিনিটের বিচার এবং রায় হচ্ছে একজন শিক্ষার্থীর ১২ বছরের সাধনার ফল এবং ভবিষ্যতের পথচলার নির্দেশক। এটি কি এত সহজ কাজ? একটি উত্তরপত্র, বিশেষ করে এই ধরনের পাবলিক পরীক্ষার খাতা কমপক্ষে দুজন পরীক্ষকের পরীক্ষণ করা উচিত, তা না হলে সেটি গ্রহণযোগ্য হয় না। এরপর হাজার হাজার ভুলত্রুটি ধরা পড়বে, সেখানে বোর্ড কিছু অর্থ উপার্জন করবে; কিন্তু কাজের কাজ খুব একটা কিছু হবে না। কারণ খাতা তো পুনর্মূল্যায়ন করা হয় না। শুধু ওপরের নম্বর দ্বিতীয়বার গণনা করা হয়।

২০১৮ সালের চেয়ে পাসের হার ও জিপিএ ৫ প্রাপ্তির সংখ্যা বেশি এবং মেয়ে শিক্ষার্থীদের পাসের হার ছেলে শিক্ষার্থীদের চেয়ে বেশি। এই তিনটি বৈশিষ্ট্যই এবারকার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলে লক্ষণীয়।

এবার কুমিল্লা বোর্ডে এবার এইচএসসিতে পাসের হার সবচেয়ে বেশি, ৭৭.৭৪ শতাংশ। অথচ এই শিক্ষার্থীরা ২০১৭ সালে যখন এসএসসি পাস করে তখন তাদের পাসের হার ছিল সর্বনিম্ন ৪৯.৫২ শতাংশ। হঠাৎ করে এই পরিবর্তন কিভাবে হলো? আমরা জানি, শিক্ষা বোর্ড একমাত্র শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশন ও পরীক্ষা গ্রহণ করা ছাড়া কিভাবে শিক্ষকরা পড়াবেন, কিভাবে শিক্ষার মানোন্নয়ন ঘটানো যায় বা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় ইত্যাদি নিয়ে তাদের কোনো তৎপরতা থাকে না।

একসময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনুমোদনের বিষয়ে তাদের একটি বড় ভূমিকা ছিল, যা এখন পুরোপুরি মন্ত্রণালয়ের হাতে। একটি বোর্ডের অধীনে কয়েকটি জেলায় কয়েক হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকে। সেগুলোর শিক্ষাদান, শিক্ষক উন্নয়ন ও শিক্ষার্থী উন্নয়ন নিয়ে বোর্ডের কোনো তৎপরতা বা কাজ আমরা কখনো দেখি না। যদিও শিক্ষা বোর্ড হিসেবে শুধু পরীক্ষা গ্রহণ ছাড়াও একটি করে উচ্চমাত্রার ‘শিক্ষা গবেষণা সেল’ থাকা প্রয়োজন। যাদের গবেষণাকর্ম জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসা কুড়াবে। এগুলো কোনো বোর্ডেই নেই।

জাতীয়ভাবে ‘পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিট’ বা বেডু ঢাকা বোর্ডের সঙ্গে সংযুক্ত আছে। তারা জাতীয় পর্যায়ে কাজ করে, পরীক্ষার উত্তরপত্র কিভাবে মূল্যায়ন করা হবে, সেটি নিয়ে বেশি কাজ করে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা যদি খাতায় না লেখে বা আজেবাজে লিখে বসে থাকে, সেটি উন্নয়নের জন্য তো বেডু কিছু করতে পারছে না বা করে না। এটির জন্য প্রয়োজন শিক্ষা প্রশাসনে ব্যাপক পরিবর্তন, প্রয়োজন শিক্ষকদের ‘নিড বেইসড ট্রেনিং’।

সেই চিরাচরিত বা ট্র্যাডিশনাল প্রশিক্ষণ দিয়ে পরিবর্তন সম্ভব নয়। কিন্তু পাবলিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর বোর্ডগুলোর মধ্যে একটি প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যায়—কোন বোর্ডে কত বেশি শিক্ষার্থী পাস করেছে। বোর্ড যেন এক ধরনের কৃতিত্ব দেখাতে চায়। আসলে আমাদের দেশে শিক্ষা বোর্ডগুলো একমাত্র শিক্ষার্থী রেজিস্ট্রেশন আর খাতা মূল্যায়ন ছাড়া তেমন কোনো কাজ করে না। কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা একটি জেলার কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরীক্ষায় ভালো করলে তা ওই প্রতিষ্ঠান পরিচালনাকারীদের এবং একই জেলার কিছু প্রতিষ্ঠান ভালো করলে শিক্ষা প্রশাসন কিছুটা কৃতিত্ব নিতে পারে। বোর্ড কেন? বোর্ড কি শিক্ষকদের কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ দেয়? বোর্ড কি শিক্ষকদের ক্লাস পর্যবেক্ষণ করে? বোর্ড কি শিক্ষার্থীদের মানসম্মত পড়ালেখা করার জন্য কোনো ধরনের নির্দেশনা দেয়? এর কোনোটিই করে না। বোর্ড যেটি করে তা হচ্ছে, বোর্ডে উত্তরপত্র নিতে গেলে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকরা বলেন, ‘অত্যন্ত সহানুভূতির সঙ্গে খাতা দেখবেন। নম্বর একটু বেশি বেশি দেবেন।’ যতবারই বোর্ডে খাতা আনতে গিয়েছি অনেক কথার মধ্যে এই দুটি ছিল সাধারণ কথা। তাহলে বোর্ডগুলো ফল ভালো বা কম খারাপ হওয়ার কৃতিত্ব দেখাতে চায় কেন?

যশোর বোর্ডে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা এগিয়ে আছে এবং এই বোর্ডের ১৮টি কলেজের পাসের হার শতভাগ। প্রশ্ন হচ্ছে, এই ১৮টি কলেজে যশোর বোর্ড কি কোনো বিশেষ শিক্ষাদান পদ্ধতি ব্যবহার করেছে, নাকি শিক্ষকদের আলাদা করে কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে? দিনাজপুর বোর্ডেও ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা এগিয়ে আছে। এ দুটি বোর্ডে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা কি বেশি পড়াশোনা করেছে, নাকি বোর্ড দুটি মেয়েদের জন্য আলাদা কোনো ক্লাসের ব্যবস্থা করেছিল? মেয়েরা কী কারণে ছেলেদের চেয়ে ভালো করে, সেটি গবেষণার মাধ্যমে জানা প্রয়োজন। ২০১৫ সাল থেকে পাঁচ বছর ধরে ছাত্রীরা ধারাবাহিকভাবে ছাত্রদের চেয়ে বেশি পাস করে আসছে। এ বছর ছাত্রীদের পাসের হার ৭৬.৪৪ শতাংশ আর ছাত্রদের ৭১.৬৭ শতাংশ অর্থাৎ ছাত্রদের তুলনায় ছাত্রীদের পাসের হার ৪.৭৭ শতাংশ বেশি।

এবার ঢাকা বাদে বাকি সাতটি বোর্ডেই ইংরেজি বিষয়ে গড় পাসের হার ৯১ থেকে ৯৬ শতাংশের বেশি, যা গত বছর ছিল ৬৫ থেকে ৮২ শতাংশ। ঢাকা বোর্ডেও ইংরেজিতে পাসের হার গতবারের চেয়ে বেড়েছে। মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীরা ইংরেজিতে বেশি খারাপ করে। গত বছরের তুলনায় মানবিকে গড় পাসের হার প্রায় ১০ শতাংশ বেড়েছে, যার প্রভাব পড়েছে সার্বিক পাসের হারে।

এই বিষয়টিকে কয়েকটি পত্রিকায় লিখেছে এভাবে—‘ইংরেজির ম্যাজিকে এবার ভালো ফল হয়েছে।’ আমার জানতে ইচ্ছা করে সেই ম্যাজিকটি কী? কেউ কেউ বলেছে, ইংরেজির প্রশ্ন তুলনামূলক সহজ হয়েছে। তাই বেশি শিক্ষার্থী পাস করেছে। সহজ বলতে কী বোঝানো হয়েছে? বিভিন্ন কলেজের পরীক্ষায় যেসব আইটেম বেশি বেশি এসেছে, সচেতন শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, কোচিং—সবাই ওই আইটেমগুলোই শিক্ষার্থীদের বারবার প্র্যাকটিস করিয়েছে, বেশি বেশি ‘মক টেস্ট’ বা ‘মডেল টেস্ট’ নিয়েছে। বোর্ড পরীক্ষায়ও ওই আইটেমগুলোই এসেছে এবং সচেতন শিক্ষার্থীরা ভালো করেছে। এ ছাড়া তো সহজ বলতে অন্য আর কিছু বোঝাতে পারছি না, অন্তত ইংরেজির ক্ষেত্রে। পাঠ্যপুস্তক ও পড়ানোর পদ্ধতিতে তো আর হুট করে কোনো পরিবর্তন আসেনি। আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা কিন্তু শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার্থী বানাচ্ছি। পরীক্ষায় কিভাবে আরো বেশি ভালো করা যায় সেই চেষ্টাই হচ্ছে সর্বত্র। বলা যায়, এ ক্ষেত্রে ইনফরমাল ও নন-ফরমাল পর্যায়ে গবেষণা হচ্ছে কিভাবে শিক্ষার্থীকে কম পড়িয়ে বেশি ভালো করানো যায়। অর্থাৎ শ্রেণিকক্ষের চেয়ে কোচিংগুলোতে যাঁরা পড়ান তাঁরা এই পদ্ধতিগুলো নিয়ে বেশি বেশি চিন্তা করছেন, নতুন নতুন পদ্ধতি বের করছেন। তাই এই পরিবর্তন! শিক্ষার্থীরা পুরো একটি বিষয়ের ওপর দখল নিতে পারল কি না, সেটি তো দেখা হচ্ছে না। আমাদের পরীক্ষাপদ্ধতিতেও সেটি নেই। ‘ও’ লেভেল ও ‘এ’ লেভেল পরীক্ষায় যে প্রশ্ন জীবনে একবার এসেছে, সেটি আর দ্বিতীয়বার আসে না। আর আমাদের পরীক্ষা? তিন-চার বছরের প্রশ্ন ঘাঁটাঘাঁটি করলেই কমন, আর কমন পড়া মানে শিক্ষকের ক্রেডিট, কোচিংয়ের ক্রেডিট এবং পাসের হার ও জিপিএ ৫ পাওয়ার হার বেড়ে যাওয়া।

লেখক : ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন (বেল্টা), সাবেক ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজ শিক্ষক

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.026535987854004