একজন বুবলী আজ শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই নয়, বরং আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধমেও আলোচনার জন্ম দিয়েছেন। তিনি একজন সংসদ সদস্য। সংরক্ষিত নারী আসনে তিনি সরকারি দলের সম্মানিত সদস্য। তিনি আলোচনার জন্ম দিয়েছেন একটি কারণে। আর তা হচ্ছে অবৈধ পন্থা ও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে তিনি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিএ পরীক্ষা দিচ্ছিলেন। একে একে সাতজন 'নকল পরীক্ষার্থী' তার হয়ে পরীক্ষা দিল। আটকে গেল 'অষ্টম পরীক্ষার্থী'। একটি টিভি চ্যানেল আমাদের জানিয়ে দিল, ওই বুবলী নিজে পরীক্ষায় অংশ না নিয়ে নকল পরীক্ষার্থী দিয়ে তার হয়ে পরীক্ষা দিতে পাঠিয়েছিলেন। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যে তাকে বহিস্কার করেছে এবং জানিয়ে দিয়েছে- তিনি আর কোনোদিন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় কোনো পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবেন না। নকল পরীক্ষার্থী সাজিয়ে পরীক্ষা দেওয়ার এই যে ঘটনা এবং তা যদি হয় একজন সংসদ সদস্যের, তাহলে ভাবতে অবাক লাগে, আমরা শিক্ষা ব্যবস্থাকে কোথায় নিয়ে গেছি! রোববার (২৭ অক্টোবর ) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
একজন সংসদ সদস্য গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি নিতেই পারেন। এটা তার নাগরিক অধিকার। একজন আইন প্রণেতা হিসেবে নিশ্চয় এটা জানেন- তার কী করা উচিত, কী করা উচিত নয়। তিনি দেশের জন্য আইন প্রণয়ন করবেন; আইন প্রণয়নে সরকারকে সহযোগিতা করবেন। এখন কি-না তিনি নিজেই জালিয়াতির আশ্রয় নিলেন? যদিও তিনি জানিয়েছেন, আগের সাতটি পরীক্ষা তিনি নিজেই বোরকা পরে দিয়েছেন। এ জন্য কেউ তাকে চিনতে পারেনি। কথাটা কি আদৌ সত্যি? অষ্টম পরীক্ষা তিনি দেননি, তিনি অসুস্থ ছিলেন। তার এপিএস তাকে না জানিয়ে অন্য একজনকে বসিয়ে পরীক্ষা দেওয়ায়! প্রশ্ন হচ্ছে, তার এই বক্তব্য কি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় খতিয়ে দেখবে? অবশ্যই এটা খতিয়ে দেখা সম্ভব। তদন্ত কমিটি বুবলীর হাতের লেখার সঙ্গে উত্তরপত্রগুলো মিলিয়ে দেখতে পারে। কিন্তু উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় কি এটি পারে? উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় একজন সংসদ সদস্যকে কি তদন্ত কমিটির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে তার হাতের লেখা পরীক্ষা করাতে পারবে? তবে স্বচ্ছতার স্বার্থেই বুবলী নিজের হাতের লেখা উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিতে পারেন। এর মাধ্যমে হয়তো তার সম্মান কিছুটা হলেও ফিরে পাওয়া সম্ভব। না হলে তিনি নিজের, দলের, এমনকি সংসদের যে ক্ষতি করলেন, সেই ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয়। এমনিতেই সাম্প্রতিক সময়ে বহির্বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি খুব উজ্জ্বল নয়। এখন এর সঙ্গে যোগ হলো সংসদ সদস্যের পরীক্ষা সংক্রান্ত দুর্নীতি ও জালিয়াতির বিষয়টি।
এই যখন পরিস্থিতি তখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জানিয়েছেন একটি 'সুখবর'- জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গত ২৭ বছরে ৫০ লাখ শিক্ষার্থীকে 'গ্র্যাজুয়েশন' ডিগ্রি দিয়েছে (দৈনিক শিক্ষা, ২১ অক্টোবর)। বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। এই ৫০ লাখ সার্টিফিকেট বিতরণ করে তিনি যদি কৃতিত্ব নিতে চান, আমি বিনীতভাবে তার সঙ্গে দ্বিমত করব। শত শত কলেজ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায়। কলেজগুলোতে অনার্সসহ মাস্টার্স কোর্স চালু রয়েছে। কিন্তু এই শিক্ষা ব্যবস্থা কতটুকু মানসম্মত? কলেজগুলোতে কি নিয়মিত ক্লাস হয়? অনেক দিন থেকেই এটা বলা হচ্ছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বাহ্যত একটি 'সার্টিফিকেট বিতরণ' কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে! সারাবছর ক্লাস না করে, চাকরি করেও যে ডিগ্রি নেওয়া যায়- জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তার বড় প্রমাণ। সেখানে নিয়মিত ক্লাস হয় না। ছাত্রদের প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করানো- মফস্বল ও জেলা শহরের সরকারি কলেজগুলোর এটা সাধারণ চিত্র। নিজ জেলা শহরে দেখেছি, শিক্ষকরা কলেজে ক্লাস নেওয়ার চেয়ে বাসায় 'ব্যাচ বাই ব্যাচ' ছাত্র পড়াতে আগ্রহী হন বেশি। ইংরেজি, বাংলা তো বটেই; সমাজবিজ্ঞান কিংবা ইসলামের ইতিহাসের মতো বিষয়েও অনার্স পর্যায়ে প্রাইভেট পড়তে হয়। ঢাকার নিউমার্কেটের 'বাকুশা মার্কেটের গাইড বইগুলো হচ্ছে এখন সাধারণ ছাত্রদের একমাত্র ভরসা। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব কোনো শিক্ষা কার্যক্রম নেই। অর্থাৎ নিজেরা ক্লাস নেয় না। কিন্তু শিক্ষক আছেন অনেক। তাহলে তাদের কাজ কী? তাদের কাজ হচ্ছে শত শত, হাজার হাজার উত্তরপত্র পরীক্ষা করা। এতে শিক্ষার্থীর সঠিক মূল্যায়ন কখনোই হয় না। আর কলেজ পর্যায়ে যারা উত্তরপত্র মূল্যায়ন করেন, তারা প্রায় ক্ষেত্রেই আশ্রয় নেন অসততার। অন্যদের এমনকি শিক্ষার্থীর আত্মীয়স্বজনকে দিয়েও খাতা দেখান।
এ ধরনের ঘটনা শত শত, যার কোনোটাই কেউ জানে না। তাই উপাচার্যের ৫০ লাখ সার্টিফিকেট দেওয়ার মাঝে কোনো কৃতিত্ব নেই। বরং সময় এসেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার। মুশকিল হচ্ছে, আমরা প্রতিটি সিদ্ধান্তের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকি। অথচ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দু'জন মন্ত্রী আছেন। ইউজিসি আছে; ইউজিসির সদস্যরা আছেন। মন্ত্রণালয়ে সিনিয়র সচিব আছেন। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে হয় প্রধানমন্ত্রীকে। উচ্চশিক্ষার স্বার্থেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে ভেঙে সাত বিভাগে ৭টি অথবা প্রস্তাবিত পদ্মা বিভাগসহ ৮টি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় চালু করা যেতে পারে। প্রতিটি বিভাগে যেসব কলেজ রয়েছে (সরকারি ও বেসরকারি) সেসব কলেজকে একেকটি প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় আনা যেতে পারে। পুরোনো অনেক ভালো কলেজ আছে। সেসব কলেজে অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধাও রয়েছে। ওই সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব। প্রস্তাবিত নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা কাঠামোতেও পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। সাধারণ শিক্ষার চাহিদা ফুরিয়ে গেছে। সাধারণ শিক্ষা দেশে বেকারত্বের জন্ম দিচ্ছে। এরা সমাজের জন্য বোঝা হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। আইটি সেক্টরের এক বিশাল চাহিদা রয়েছে দেশে ও বিদেশে। জাপান বাংলাদেশ থেকে নির্দিষ্ট কিছু সেক্টরে জনবল নিচ্ছে। আমাদের শিক্ষা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা এটা ভেবে দেখতে পারেন। শুধু জাপান বলি কেন? আগামী ১০ বছরে ইউরোপের অনেক দেশ দক্ষ জনবল সংকটের মুখে পড়বে। সেই 'শূন্যস্থান' আমরা পূরণ করতে পারি। এ জন্য দরকার সুষ্ঠু পরিকল্পনা।
বিদেশি ভাষা শিক্ষার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় এ কাজটি করতে পারে। এতে অনেকে উৎসাহিত হবেন এবং সীমিত আর্থিক সুযোগে তরুণ প্রজন্ম জাপানিসহ অন্যান্য ভাষা শিখতে পারবে, যা তাদের বিদেশে কর্মসংস্থানে সহায়তা করবে। আমাদের দুঃখটা এখানেই, উপাচার্যরা 'রাজনৈতিক বিবেচনায়' নিয়োগ পান বটে, কিন্তু তাদের দূরদর্শিতা নেই। ১০০ কোটি টাকা দিয়ে উপাচার্য ভবন নির্মাণকে (বণিক বার্তা) আমরা গুরুত্ব দিই, কিন্তু শিক্ষার মানোন্নয়ন কিংবা যুগোপযোগী শিক্ষাকে আমরা গুরুত্ব দিই না।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বড় বিশ্ববিদ্যালয়। তাদের সুযোগ ছিল অনেক কিছু করার। গাজীপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে বিশাল একাডেমিক ভবন রয়েছে, তা অনেকটাই অব্যবহূত। মাঝে মাঝে সেখানে শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। অথচ এখানে একটি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটি (এএনইউ) এ ক্ষেত্রে একটি মডেল হতে পারে। এএনইউ একটি গবেষণামূলক বিশ্ববিদ্যালয়। আমাদের শিক্ষা প্রশাসকরা এটা ভাবেন না, বোঝেনও না যে, এ দেশে বিশাল এক জনগোষ্ঠী তরুণ। এরা এখন ছোটে বিসিএসের পেছনে। সকালে লাইব্রেরিগুলোতে গেলে দেখা যায়, ছাত্ররা বিসিএসের সিলেবাস অনুসরণ করে তাদের পড়াশোনা চালাচ্ছে; নিজের যে বিষয়, তার প্রতি কোনো আগ্রহ নেই। এই 'বিসিএস প্রজন্ম' আমাদের জন্য কোনো মঙ্গল বয়ে আনবে না। অথচ এরাই আমাদের স্বপ্ন। এই বিশাল জনশক্তিকে আমরা কাজে লাগাতে পারছি না। রাখতে পারছে না সমাজ উন্নয়নে তারা কোনো বড় অবদান। ৪৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, একশ'র ওপরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। আমরা 'সার্টিফিকেটসর্বস্ব' একটি জাতি তৈরি করছি! অথচ একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনার আওতায় আমরা একটি দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে পারতাম। সেই সুযোগ এখনও আছে। তাই ৫০ লাখ সার্টিফিকেট ইস্যু করার মধ্যে কোনো সফলতা নেই। এই ৫০ লাখ সার্টিফিকেটধারী সমাজে কী অবদান রাখছে, এটা খোঁজ নিলেই বোঝা যাবে আমাদের সফলতাটুকু কোথায়। একজন বুবলী এমপি হয়ে অনেকের মতো একখানা সার্টিফিকেট চেয়েছেন। তাতে দোষের কী? স্বামীর হত্যাকাণ্ডই তাকে সামনে নিয়ে এসেছে। আওয়ামী পরিবারের সদস্য তিনি। তবে এ কাজটি তিনি না করলেও পারতেন। একজন বুবলীর ঘটনা কিংবা ৫০ লাখ সার্টিফিকেটের বিষয়টি নিয়ে যদি মন্ত্রী ভাবেন, যদি প্রধানমন্ত্রীর নজরে আসে, যদি 'চিন্তা-ভাবনা' করার একটা দুয়ার খুলে যায়, একজন শিক্ষক হিসেবে আমি তাতেই বেশি খুশি হবো।
লেখক: ড. তারেক শামসুর রেহমান, অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্নেষক