একজন শিক্ষকের ‘আইকন’ হওয়ার গল্প - দৈনিকশিক্ষা

একজন শিক্ষকের ‘আইকন’ হওয়ার গল্প

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

একসময় ছিলেন কোরআন ও আরবি ভাষার শিক্ষক এবং পরবর্তী সময়ে যার নাম ছড়িয়ে পড়েছিল লিবিয়ার ভৌগোলিক সীমানা ছাড়িয়ে আরব বিশ্বের একজন সাহসী গেরিলা যোদ্ধা ও বেদুইন নেতা হিসেবে, তিনি ওমর আল মুখতার (পুরো নাম ওমর আল মুখতার মোহাম্মদ বিন ফারহাত আল মানিফি)। তার জন্ম লিবিয়ার পূর্বাঞ্চল এলাকায়, ১৮৫৮ সালে। শৈশবে ইসলাম ধর্ম নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং অল্প বয়সে কোরআনে হাফেজ হন। তিনি ছিলেন সেনুসি আন্দোলনের অন্যতম নেতা। তিনি কোরআন ও আরবি ভাষার শিক্ষক হিসেবে ১৯১১ সাল পর্যন্ত নিয়োজিত ছিলেন। উল্লেখ্য, সেই বছর ইতালীয় সেনাবাহিনী লিবিয়া আক্রমণ করে। শুক্রবার (৩ জানুয়ারি) বণিক বার্তা পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। 

নিবেন্ধ আরও জানা যায়, তিনি শিক্ষকতা ছেড়ে ঔপনিবেশিক শক্তির হাত থেকে মাতৃভূমিকে মুক্ত করার জন্য ‘লিবিয়ান রেজিস্ট্যান্স মুভমেন্ট’ দল গঠন করেন এবং পরবর্তী সময়ে প্রায় কুড়ি বছর দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। বলা হয়, ইতালি সরকার দলবলসহ তাকে বশ্যতা স্বীকার করার জন্য অনেকবার সন্ধি করতে এবং ঘুষ দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তিনি বারবার সেসব প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন; বরং বলেছেন, ‘আমরা কখনই আত্মসমর্পণ করব না। আমরা জিতব নতুবা মরব।’ তবে দুর্ভাগ্য যে অনেক প্রচেষ্টার পরে ইতালীয় সেনাবাহিনী ৭৩ বছর বয়সী আল মুখতারকে আহত অবস্থায় গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছিল। ইতালির স্বৈরাচারী সরকার এবং সেনাবাহিনী পুরো বিশ্বকে রীতিমতো বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বিশেষ আদালতে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে এবং ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে হত্যা করে।

বাস্তব জীবনে ওমর আল মুখতারের প্রভাব ছিল অনেক বিস্তৃত, যেমন লিবিয়ার তিন শাসনতন্ত্র—রাজতান্ত্রিক, বিপ্লবী এবং সামরিক বাহিনী—তাকে জাতীয় বীর হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং লিবিয়ার ১০ দিনারের নোটে তার ছবি ছাপা হয়েছে। তিনি লিবীয়দের শিক্ষা দিয়েছেন যে তারা যেন মাতৃভূমিকে ভালোবাসে, স্বাধীনতা রক্ষা করে এবং যেকোনো ধরনের আগ্রাসন প্রতিহত করে। পরবর্তী সময়ে তার মহত্তর ত্যাগ স্বীকার আরব জাতীয়তাবাদের বিভিন্ন রূপ গঠনে অবদান রাখতে সক্ষম হয়। তার অসীম সাহস ও গেরিলা যুদ্ধের কলাকৌশল জানা এবং পরিচালনার দক্ষতার কোনো তুলনা হয় না। তাই শত্রপক্ষও তার বীরত্ব ও নিপুণ রণকৌশলের ভূয়সী প্রশংসা করেছে ।

ওমর আল মুখতারের জীবনের শেষ কয়েক বছর নিয়ে লিবিয়ার অনুদানে ১৯৮১ সালে নির্মিত হয় ঐতিহাসিক চলচ্চিত্র ‘লায়ন অব দ্য ডেজার্ট’। এতে ওমর আল মুখতারের ভূমিকায় দুর্দান্ত অভিনয় করেন বিশ্বনন্দিত অভিনেতা অ্যান্টনি ক্যুইন এবং ইতালীয় সেনাবাহিনীর জেনারেল বোদলফো গ্রাজিয়ানির ভূমিকায় অভিনয় করেন অলিভার রিড। যদিও ১৯৮২ সালে চলচ্চিত্রটি ইতালিতে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল কিন্তু ২০০৯ সালের ১১ জুন তত্কালীন লিবীয় নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফি সরকারি সফরে ইতালি গিয়েছিলেন এবং সেই অছিলায় সে দেশের স্কাই টিভিতে চলচ্চত্রটি প্রদর্শিত হয়। সমালোচকের মতে, এটি ‘চিরকাল মনে রাখার মতো চলচ্চিত্র।’

ওমর মুখতারকে নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি ও ইতিহাসবিষয়ক গবেষক ও লেখক জোসেফ এ. কেচিশিয়ানের The Teacher turned to Icon শিরোনামের লেখাটি ২০০৮ সালের ১৩ নভেম্বরে Gulf News-এ ছাপা হয়। এ পর্যায়ে জোসেফ কেচিশিয়ানের লেখাটির অনুবাদের মাধ্যমে ওমর মুখতারের জীবন ও ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:

যখন ১৯১১ সালের অক্টোবরে অ্যাডমিরাল ক্যাপো ফারাফেলি এবং তার যুদ্ধজাহাজের বহর ত্রিপোলির অদূরে উত্তর আফ্রিকার সমুদ্রতীরে পৌঁছে, তখন ইতালির সামরিক বাহিনী তুর্কিদের আপত্তি এবং বিরোধীদলীয় আদিবাসীদের প্রতিবাদ তোয়াক্কা না করে অটোম্যান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত প্রদেশগুলোর সার্বভৌম কর্তৃত্ব দখল করার মনস্থির করে ।

কনস্টান্টিনোপল লোকলস্করদের প্রতি হুকুম জারি করেন যে তারা যেন আত্মসমর্পণ করে। সেই লোকজনের অনেকেই ত্রিপোলিতে ইতালীয় বিমানের তিনদিন একনাগাড়ে বোমা বর্ষণের ঠিক আগে পালিয়ে গেছে। রোম বিজয় ঘোষণা করে।

ইতালীয় কর্মকর্তারা দাবি করেন, লিবিয়ার জনগণ ‘প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং ইতালির সঙ্গে দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ।’ কিন্তু সেই সময়ে দখলকারী সৈন্য এবং গেরিলাদের মধ্যে একাধিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সুসংবদ্ধ সেই গেরিলা যুদ্ধের সমর নায়ক ছিলেন এক অসাধারণ মানুষ—ওমর আল মুখতার।

আল মুখতার অনুসারীদের মধ্যে দেশপ্রেম ও কর্তব্যের সচেতনতা জাগিয়ে তোলেন এবং পশ্চিমা দেশ মাঝেমধ্যে দাবি করে যে আরবরা স্বদেশকে ভালোবাসে না, তা যেন লোকজন মন থেকে সম্পূর্ণ মুছে ফেলে।

গেরিলা যুদ্ধের সুদক্ষ সেনাপতি

আল মুখতার ১৯১২ সালে সংঘবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়ার লক্ষ্যে বির হাল্ঘ বারগার পথে যাত্রা করেন। জায়গাটি বেনগাজি থেকে খুব বেশি দূরে নয় এবং মিসরীয় সীমান্তের কাছাকাছি। এই শান্ত-শিষ্ট শিক্ষক অতি অল্প সময়ের মধ্যে মরুভূমির বুকে সংঘটিত গেরিলা যুদ্ধের কলাকৌশলের দিক থেকে একজন দক্ষ সেনাপতি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। কেননা অন্যদের তুলনায় তিনি তার দেশের ভৌগোলিক অবস্থান এবং পরিবেশ সম্পর্কে বেশি ওয়াকিবহাল ছিলেন। মরুভূমিতে, যা ছিল ইতালীয় সৈন্যদের কাছে অজানা এবং রহস্যময়।

শত্রুসেনার ছাউনি এবং অতর্কিত হামলা করার জন্য অপেক্ষারত শত্রুবাহিনীর ওপর আক্রমণ করে এবং রসদ জোগান ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দলবল নিয়ে আল মুখতার অনুপ্রবেশকারীদের পরাভূত করেন।

একসময় আল মুখতার ছিলেন সেনুসি প্রতিরোধ আন্দোলনের এক অবিসংবাদী নেতা। পরবর্তীতে সেই আন্দোলন আদর্শ হিসেবে আরব বিশ্বে পরিচিতি লাভ করে। সেনুসি একটি সুফি মতবাদ। সিদি (বাংলায় ‘জনাব’) মোহাম্মাদ বিন আলী আল সেনুসি ১৮৪৩ সালে সাইরেনিকায় (বারক্বা) এ মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেন।

শুরুর দিকে ইতালীয় সৈন্যদের আক্রমণ ঘনীভূত হয়েছিল সমুদ্র-তীরবর্তী এলাকায়, যেমন ত্রিপোলি, বেনগাজি, মিসরাতা ও ডেরনায়। তবে আক্রমণের বিরুদ্ধে লিবিয়ার জনগণ রুখে দাঁড়ালে অল্প সময়ের মধ্যে অন্যত্র বড় ধরনের যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে।

মরুভূমির কয়েকটি গ্রাম অথবা পাহাড়ি এলাকা রক্ষা পেয়েছিল। ১৯১৫ সালের এপ্রিলের ঘারতাবিয়াহ্ যুদ্ধের পরে, যে যুদ্ধে ইতালীয় শত সহস্র সৈন্য নিহত হয়, ঔপনিবেশিক সৈনিকেরা পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ লাভে ব্যর্থ হলেও অনেকটুকু এলাকা নিজেদের আওতায় নিতে সক্ষম হয়েছিল।

লিবিয়ার নাগরিকদের কৃতিত্ব যে তারা নির্ভয়ে যুদ্ধ করেছে। কয়েক হাজার নাগরিক আল মুখতার সংগঠিত প্রতিরোধ বাহিনীতে যোগদান করে। বেশির ভাগ গেরিলা উত্তর-পূর্বে অবস্থিত লিবিয়ার জাবাল আল আখদারে (সবুজ পর্বত) লুকিয়ে ছিল এবং সেখান থেকেই তারা অকুতোভয়ে অসহায় ইতালীয় সৈন্যদের ওপর সাঁড়াশি আক্রমণ করেছিল।

পরাজয়ের ভয়ে এবং লিবিয়াকে শান্ত করার জন্য রোম এক কুখ্যাত সেনা কর্মকর্তা পিয়েত্রো বাদোওলিওকে পাঠিয়েছিল। অমানবিক পদক্ষেপসহ যেকোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করে চটজলদি গেরিলাদের শায়েস্তা করার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তাকে সর্বময় ক্ষমতা প্রদান করে।

কর্তৃপক্ষের সেই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করার উদ্দেশ্যে ইতালীয় সেনা কর্মকর্তা লিবীয় গেরিলাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং সাধারণ নাগরিকের ওপর কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। সাধারণ 

নাগরিকের একটিই অপরাধ যে তারা গেরিলাদের সাহায্য করে।

বিস্তারিত আলাপ-আলোচনার পরে বাদোওলিও আল মুখতারের সঙ্গে একটা সমঝোতায় পৌঁছে, যদিও ইতালীয় সূত্র পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে মিথ্যাচার করে বলেছে যে প্রতিরোধ নেতা সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করেছেন।

আল মুখতার সেই সমঝোতা বর্জন করেন ১৯২৯ সালের অক্টোবরের শেষ দিকে এবং তারপর তিনি পুনরায় তার লোকজনকে সংগঠিত করেন। যেই বাদোওলিওর বর্বর পন্থা অসম্পূর্ণ প্রমাণিত হয়, তখন ইতালির স্বৈরাচার রাষ্ট্রপ্রধান বেনিটো মুসোলিনি, যাকে কিনা ‘Il Duce’, অর্থাত্ ফ্যাসিবাদের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল, জেনারেল বোদলফো গ্রাজিয়ানিকে নৃশংস পদ্ধতিতে লিবিয়া দমন করার জন্য প্রেরণ করেছিলেন।

গ্রাজিয়ানি বনাম আল মুখতার

গ্রাজিয়ানির লিবিয়া যাওয়া নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতানৈক্য আছে। গ্রাজিয়ানির শর্ত ছিল যে স্বৈরাচার রাষ্ট্রপ্রধান বেনিটো মুসোলিনি যদি তাকে যাচ্ছেতাই বর্বরোচিত দুষ্কর্ম করার জন্য ইতালির সব আইন-কানুনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সর্বোচ্চ ক্ষমতা দেন, তবেই তিনি যুদ্ধের নেতৃত্ব দিতে লিবিয়ায় যাবেন। গ্রাজিয়ানির সেই শর্ত ছিল প্রশ্নাতীতভাবে খুবই ভয়ংকর। লিবিয়া দমন করার জন্য প্রয়োজন হলে তিনি অর্ধেক জনসংখ্যা হাপিশ করে দেবেন।

প্রতিবেশী মিসর থেকে যুদ্ধের সরঞ্জাম ও রসদ আসা বন্ধ করার জন্য গ্রাজিয়ানি আল মুখতার এবং তার গেরিলা বাহিনীর সীমানা সংকুচিত করতে চেয়েছিলেন। শেষের দিকে সে মিসরের সীমান্ত বরাবর দক্ষিণে অবস্থিত বারদিয়াত স্লেইমান বন্দর থেকে আল জাগবৌব পর্যন্ত প্রাচীর নির্মাণ করার হুকুম দেন। সেই প্রাচীর ছিল ৩০০ কিলোমাটার দীর্ঘ, দুই মিটার উঁচু এবং তিন মিটার প্রশস্ত।

এছাড়া গ্রাজিয়ানি কয়েক জায়গায়, যেমন আল আগহাউলহা, আল  মাঘরুন, সালুক এবং আল আবিইয়ার, বন্দিশিবির নির্মাণ করার অনুমতি দেন। সেসব বন্দিশিবিরে লিবিয়ার হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে সম্পূর্ণ ইতালীয় সৈন্যদের তত্ত্বাবধানে জোরপূর্বক আটক করে রাখা হয়েছিল।

তবে যেসব লিবীয় নাগরিক বন্দিশিবির থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল, তারা জাবাল আল আ খদারে গেছে অথবা মরুভূমির গহিনে লুকিয়ে থেকেছে। প্রচণ্ড বৈরী পরিবেশে তারা বসবাস করে। সেই অস্বাভাবিক পরিবেশের জন্য হাজার হাজার পলাতক মানুষের মৃত্যু হয়। এদের মধ্যে ছিল পুরুষ, নারী, বয়স্ক ও শিশু-কিশোর। তাদের হয় সরাসরি ফাঁসি দিয়ে অথবা গুলি করে হত্যা করা হয়েছে নতুবা তাদের মৃত্যু হয়েছে ক্ষুধায় বা অসুখে।

গ্রাজিয়ানি ১৯২৯ থেকে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত সেসব বন্দিশিবিরে এক লাখেরও বেশি লিবিয়ার নাগরিককে আটক করে রেখেছিলেন। তবে লেখক হালা কাশিম নসর ও মার্কো বজেরোর নিবন্ধ (‘দ্য জার্নাল অব নর্থ আফ্রিকান স্টাডিজ’, জুন ২০০৮-এ প্রকাশিত লিগ্যাসি অব লিবিয়ান ফ্রিডম ফাইটার—ওমর আল মুখতার) অনুযায়ী সেসব বন্দিশিবিরে আনুমানিক ৪০ হাজার লিবিয়ার নাগরিকের মৃত্যু হয়।

বন্দিশিবিরের জীবন ছিল দুর্বিষহ এবং হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে ক্ষুধায় অথবা অসুখে। ‘ইতালিয়ান আর্মি হেলথ ডিপার্টমেন্ট’-এর চেয়ারম্যান ড. টোডেস্কির ভাষায়: ‘১৯৩০ সালের মে থেকে একই বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮০ হাজারেরও বেশি লিবিয়ার নাগরিককে জোরপূর্বক অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে এবং তাদের বন্দিশিবিরে রাখা হয়েছিল। প্রতিবার ৩০০ জনকে নেয়া হয় এবং ইতালীয় সৈন্যরা তাদের প্রতি কড়া নজর রাখে যেন সবাইকে সরাসরি বন্দিশিবিরে আটক করা হয়... ১৯৩০ সালের শেষ অবধি সমস্ত লিবিয়ার নাগরিক, যারা তাঁবুতে ছিল, তাদেরকেও বন্দিশিবিরে যেতে বাধ্য করা হয়; ৫৫ শতাংশ লিবিয়ার নাগরিক বন্দিশিবিরে মারা যায়।’

লিবিয়ার একজন প্রথম সারির ইতিহাসবিদ মাহমুদ আলি আল তায়েব বলেছেন, ১৯৩০ সালের নভেম্বরে সেসব বন্দিশিবিরে নিদেন হলেও প্রতিদিন ১৭টি মরদেহের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে।

বন্দিশিবিরে লিবিয়ার আটক নাগরিকদের অপুষ্টিকর খাবার পরিবেশন করা হয়েছিল। তবে গেরিলাদের অবস্থা ছিল আরো বেশি শোচনীয়। বলতে গেলে, আল মুখতার এবং তার অনুসারীদের অধিকসংখ্যক জনবল সংগ্রহ করা থেকে বঞ্চিত করা হয়, তাদের ওপর গোপনে নজরদারি করে, যুদ্ধবিমানের আঘাতে জর্জরিত করে তোলে এবং স্থানীয় গুপ্ত সংবাদদাতার সাহায্যে ইতালীয় সৈন্যরা তাদের ধাওয়া করে। এসব অত্যাচারের কাহিনী বলা হয়তো কম হয়ে যাবে।

গেরিলাদের মধ্যে খাদ্য সংকট দেখা দেয় ১৯৩০ সালের শুরুর দিকে। কিন্তু তার অনেক আগেই তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ আগ্নেয়াস্ত্র ফুরিয়ে গিয়েছিল।

গ্রেফতার এবং ফাঁসি

পরাক্রমশালী শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই এবং দীর্ঘ কুড়ি বছর গেরিলা যুদ্ধের সময় আল  মুখতারকে পাকড়াও করার জন্য ইতালীয় বাহিনী ওঁত্ পেতে থেকেছে এবং বারবার চেষ্টা করেছে। অবশেষে বেনগাজির ১৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত জালতান শহরের কাছাকাছি মরুভূমিতে ইতালীয় সেনাবাহিনী তাকে ১৯৩১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আহত অবস্থায় গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। ক্লান্তি এবং তার সহজাত স্বভাবের জন্য সেই দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে আল মুখতার নিজেকে শান্ত রেখেছিলেন।

আল মুখতার নিজের অবস্থা বুঝতে পেরেছিলেন এবং ভাগ্যকে মেনে নিয়েছিলেন। কারাগারের ভেতর অন্যসব বন্দি তার ধৈর্য ও শান্ত ভাব দেখে অভিভূত হয়েছিল। পরবর্তীতে কয়েকজন জেরা করার লোক স্বীকার করেছে যে আল মুখতার তাদের চোখে চোখ রেখেছিলেন এবং যখন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ ও নির্যাতন করা হতো, তখন তিনি পবিত্র কোরআন থেকে শান্তির আয়াত পাঠ করতেন।

ইতালীয় সেনাবাহিনী প্রত্যাশিতভাবেই তড়িঘড়ি করে ‘ক্যাঙ্গারু কোর্ট’১ বসিয়ে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে এবং মৃত্যুদণ্ড দেয়। আল মুখতার সেই রায়কে স্বাগত জানিয়ে পবিত্র কোরআন থেকে আয়াত উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন, ‘নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর জন্য এবং আমরা সবাই তাঁরই সান্নিধ্যে ফিরে যাব।’২

রোম আশা করেছিল যে গ্রেফতারের পর পাঁচদিনের মধ্যে বুড্ডা লড়াকুর রায় কার্যকর করা হলে হয়তো গেরিলাদের প্রতিরোধ স্তিমিত হয়ে যাবে। যাহোক, ১৯৩১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর সালুকের বন্দিশিবিরে প্রকাশ্যে তার অগণিত অনুগামীর সম্মুখে ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

লক্ষণীয় বিষয়, লিবিয়ার প্রতিরোধ সংগ্রাম থেমে যায়নি, যদিও তা উল্লেখযোগ্যভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিল।

বিশ্বযুদ্ধের চুক্তিগুলো, আন্তর্জাতিক আইন-কানুন বা মানবিক বিবেচনার সব উপাদান ভঙ্গের দায়ে ইতালি বিশ্বের কাছে হেয়প্রতিপন্ন হয়। এমনকি সেই দুর্বল সময়ের মধ্যেও আল মুখতার, যিনি ‘নিমর আল সাহরাহ’ অর্থাত্ ‘মরুভূমির সিংহ’ নামে সুপরিচিত ছিলেন, অধিকাংশ ইতালীয় নাগরিকের মনে এমন ভয়-ভীতির সঞ্চার হয়েছিল যে তাকে ফাঁসিতে ঝোলানোর নির্মম সিদ্ধান্তে আরব বিশ্বের কোথাও খুব একটা ক্ষোভ প্রকাশ পাবে না।

টীকা:

১ ‘ক্যাঙ্গারু কোর্ট’ এক ধরনের বিশেষ আদালত, যেখানে প্রথাসিদ্ধ আইন এবং ন্যায়বিচার স্বীকৃত মানদণ্ড গ্রহণ করা হয় না। এ ধরনের আদালতে অভিযুক্তদের প্রায়ই আইনি প্রতিনিধিত্বের সুযোগ এবং কিছু ক্ষেত্রে সঠিক প্রতিরক্ষা ও আবেদনের অধিকার অস্বীকার করা হয়।

২ সূরা আল বাকারা, আয়াত ১৫৬; ‘পবিত্র কোরআনুল করীম’, বাংলা অনুবাদ: মাওলানা মহীউদ্দীন খান

লেখক : ফজল হাসান, অনুবাদক।

দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0075521469116211